কবিতা নিভৃতির শিল্প। এ শিল্পকে আনন্দ-বিষাদের গমকে কলকলিয়ে তোলে আবৃত্তি। আবৃত্তি শ্রুতিমুগ্ধ মধুর শিল্প। এই শিল্পকে আত্মীকরণ দুরূহ হলেও মানুষের বোধে কবিতার অনুরণন তোলা কাব্যজনই আস্বাদন করেন কবিতার স্বাদ ও স্বেদ। কবিতা লিখে কবি তার দায় সারেন বটে। কিন্তু কবিতাকে পুনর্নিমাণ করেন, শ্রোতার কানে, কবিতারপ্রেমির অভিসারে উপভোগ্য করেন আবৃত্তিকাররা।
কবিতা মাধাব আর তার মাধবী হলো আবৃত্তি। যার নুপুর নিক্কণ কবিতার অষ্টরসকে প্রস্ফুটিত করে ভোরের সোনালী প্রভায়। কবি মযুখ চৌধুরীর কাব্যভাষায় ‘শব্দ আছে, শব্দ থাকবে, শব্দহীন ডিমের মতো’। সত্যিই কবিতার গতরে সুপ্ত ডিমের মতো শব্দকে কণ্ঠের কারুকর্মে কলরোল তোলেন একজন দক্ষ জহুরী আবৃত্তিকার।
বাংলাদেশে আবৃত্তি চর্চার ইতিহাস সুপ্রাচীন না হলেও একেবারে নবীন নয়। স্বাধীনতা উত্তর সময়ে এ শিল্প বেশ এগিয়ে যায়। কাজী সব্যসাচী ইসলাম, শিশির কুমার ভাদুড়ী, গোলাম মোস্তফা এঁদেরকে কবিতা চর্চার প্রাণপুরুষ বলে ধরা যায়।
রাজধানী ঢাকার বাইরে সম্ভবত একমাত্র শহর চট্টগ্রামে এ শিল্পকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়। রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম হয়ে ওঠে আবৃত্তি চর্চার পাদপীঠ। চট্টগ্রামে এ শিল্পকে যে বা যারা বয়ে নিয়েছেন তাদের অন্যতম সারথী মোসতাক খন্দকার। এ প্রসঙ্গে বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ বলেন- ‘আমি আরো কিছু আবৃত্তিকারের নাম জানি, যারা তাদের কণ্ঠমাধুর্যে আমাকে অভিভূত করে রেখেছেন। এদের একজন চট্টগ্রামের মোসতাক খন্দকার আর অন্যজন ঢাকার প্রজ্ঞা লাবনী। চট্টগ্রামে রাজনীতিনিরপেক্ষ অনেক আবৃত্তিচক্র অনেক দিন ধরে তাদের উচ্চারণবিভূতিকে উচ্চকিত রেখেছে। এর মধ্যে নিঃসন্দেহে আওয়ামী উচ্চারণশিল্পীদের চেয়ে মধুরতর আবৃত্তিকার রয়েছে। একজনের নাম আমি অকপটে বলতে পারি। তার নাম মোসতাক খন্দকার। মোসতাক খন্দকারের আবৃত্তিকলা ও তার দলের স্বরক্ষেপ কৌশল চট্টগ্রামের বিদগ্ধ মানুষের স্মৃতির মণিকোঠায় জমা আছে। – কবি আল মাহমুদ (দৈনিক নয়াদিগন্ত- ১১ মে, ২০০৬)
মোসতাক খন্দকার তার আবৃত্তি চর্চা এবং কবিতাপ্রেম দিয়ে কাব্যভ‚ বনে নির্মাণ করেছেন পোক্ত ভিত। যার তারিখ অভিধান তুলে ধরে
প্রখ্যাত চিকিৎসক এবং সংস্কৃতিজন ডা. আবু সাঈদ শিমুল লিখেন- ‘১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম কলেজ কেন্টিনে ২৯ জন আবৃত্তি প্রেমীকে নিয়ে মোসতাক খন্দকারের প্রশিক্ষণ কর্মশালাটি আমরা আপাতত প্রথম আবৃত্তি কর্মশালা বলতে পারি। বর্তমানে চট্টগ্রামে বেশ কয়েকজন ভাল আবৃত্তির প্রশিক্ষক আছেন, এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, রণজিৎ রক্ষিত, এ. কে. এম আসাদুজ্জামান, মাহবুব হাসান, সহিদুর রহমান, শান্তনু বিশ্বাস এবং অধুনা মোসতাক খন্দকার। সবচেয়ে সম্ভাবনা নিয়ে আবির্ভূত হন মোসতাক খন্দকার। আবৃত্তি বোধে, ধারণের ক্ষমতায় তিনি এ অঞ্চলের বর্তমান আবৃত্তিকারদের চেয়ে অনেক এগিয়ে।” (‘চট্টগ্রামে আবৃত্তি’- ডা. আবু সাঈদ শিমুল, দৈনিক আজাদী, ১০ অক্টোবর, ১৯৯৭)
মোস্তাক খন্দকার জীবনের সপ্তদশ বসন্তের দ্বারপ্রান্তে। কবিতার কারুশিল্পী মোসতাক খন্দকার । চার দশকের কাছাকাছি সময় অতিবাহিত করেছেন কবিতার পুনর্নির্মাণে। বাংলা কবিতায় তবক দেয়া পানের কবি এবং বিখ্যাত আবৃত্তিকার কবি আসাদ চৌধুরী এতদবিষয়ে মন্তব্য করেন- ‘আবৃত্তিকাররা কবিতাকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছেন। এই সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ক্বণন শীর্ষদের অন্যতম।
আর এই কৃতিত্ব ক্বণন’র সভাপতি ও প্রশিক্ষক মোসতাক খন্দকারকে দিতেই হবে।’ – কবি ও বাচিক শিল্পী আসাদ চৌধুরী
কবিতা ধ্যান, কবিতা জ্ঞান, কবিতা প্রেয়সি এ ত্রিব্রত নিয়ে পথ চলছেন মোসতাক। কবিতাপ্রেমের কন্টকে বিক্ষত হচ্ছেন হামেশা।
পথের প্রসূণস্পর্শ যেমন পেয়েছেন তেমনি সয়েছেন বোলতার হুল, কাঁটার আঘাত। জীবনের ভয়ংকর মুহূর্তেও কবিতা চর্চা এবং আবৃত্তিকে ছাড়েননি, অথচ স্ত্রী সন্তান ফেলে অন্তরীন ছিলেন ফ্যাসিবাদের কৃষ্ণ প্রকোষ্ঠ কারান্তরালে। মিথ্যা মামলায় জেল খেটেছেন, মামলা ঘানি টেনেছেন বহুদিন। কবিতা ও ক্বণন এই ধ্যানেই অনুরণন তার জীবনবীণায়। চারদশকের বর্ণাঢ্য তার আবৃত্তি চর্চা ও আবৃত্তি সংগঠন ক্বণন শুদ্ধতম আবৃত্তি অঙ্গন পরিচালনার ক্যারিয়ার। প্রখ্যাত অভিনেতা এবং আবৃত্তিকার জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় বলেন- ‘বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দর চট্টলার কতিপয় শিল্পী বাকশিল্পের সৌন্দর্যচর্চচায় দীর্ঘকাল ধরে ব্রতী আছেন। তাদের মধ্যে সার্থক একজনের নাম মোসতাক খন্দকার।’
তিনি কবিতার মতো পেলব স্পর্শে নিপুণ কৌশলে তৈরি করেছেন তিন সহস্রাধিক ভাষাকর্মী। যারা বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধিতে নিরলস প্রয়াস চালাচ্ছেন। বাংলা কবিতা আবৃত্তির ইতিহাসে, কবিতার নির্মাণ ইতিহাসে, চট্টগ্রামের আবৃত্তি চর্চার ইতিহাস নির্মাণে মোসতাক এক অত্যুজ্জ্বল নাম। মোসতাক খন্দকারকে এড়িয়ে চট্টগ্রামের কবিতা চর্চার ইতিহাস অসম্পূর্ণ। এ বিষয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক- দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেকের উদ্বৃতিটি প্রণিধানযোগ্য- ‘আবৃত্তি শিল্প সুন্দর ও শুদ্ধতার চর্চা করতে শেখায়। শুধু আবৃত্তি চর্চার জন্য ৩৬ বছর একটি সংগঠনকে টিকিয়ে রাখা সহজ ব্যাপার নয়। সবকিছু ঢাকায় হয়, একথা সত্য নয়, চট্টগ্রামেও হয়। অন্তত মোসতাক খন্দকার তা প্রমাণ করেছে। ‘ক্বণন শুদ্ধতম আবৃত্তি অঙ্গনের তিন যুগপূর্তি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক।
মোসতাক খন্দকার আবৃত্তি, আবৃত্তির চর্চা এবং কবিতা কর্মীর মূল্যায়নে উদারহস্ত। পুরস্কৃত করেছেন এপার বাংলা ওপার বাংলার বহু বিদ্বৎজনকে। প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছেন তরুণ ও নবীন কবিতা ও সাহিত্যকর্মীদের। কতজন কতভাবে পুরস্কার এবং প্রাপ্তির ঝোলা পূর্ণ করে এবং করছে। মোসতাক খন্দকার এসবের পেছনে না ছুটে নিরন্তর প্রয়াস চালাচ্ছেন কবিতার নতুনতর বিনির্মাণে এবং আবৃত্তিশিল্পের উৎকর্ষ সাধনে। কবি আল মুজাহিদীর বয়ানে বলতে হয়- ‘মোসতাক খন্দকার ক্বণন’র বাতিঘর। তার সহযাত্রীদের অভিযাত্রিকতায় এই ক্বণন একদিন নতুনতর মাত্রা অর্জন করবে।’
মোসতাক খন্দকার আবৃত্তি ও কবিতা চর্চা করেছেন বহুকাল, পাশাপাশি লিখেছেন ছড়া, প্রবন্ধ এবং আবৃত্তি চর্চা ও আবৃত্তির ইতিহাস।
কিন্ত আবৃত্তি বেচে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করেননি। লালায়িত হননি সহজপ্রাপ্যে। আবৃত্তি চর্চার মোড়কে নিজেকে বিকিয়ে দেননি স্বার্থের দরজায়। পোষাকের মতো বদল করেননি আদর্শ-চৈতন্য। সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলেছেন জীবনব্যাপী।
মোসতাক খন্দকার বাংলাদেশের আবৃত্তি চর্চা ও আবৃত্তি লালনের কর্ণধার। তার অন্তহীন প্রয়াস বাংলা কবিতার নবতর মূল্যায়ন এবং পেলব দেহবল্লরী নির্মাণের পাশাপাশি এ শিল্পকে নিয়ে যাবে অন্তহীন উজ্জ্বল ভবিষ্যে।
পূর্বকোণ/এএইচ