চট্টগ্রাম বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

সর্বশেষ:

পবিত্র শবে মিরাজের প্রকৃত শিক্ষা

২৬ জানুয়ারি, ২০২৫ | ১:৪৯ পূর্বাহ্ণ

আগামী ২৭ জানুয়ারি, ২৬ রজব দিবাগত রাতে বাংলাদেশে ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে পবিত্র শবে মিরাজ পালিত হবে।
ফারসি ‘শব’ শব্দের অর্থ রাত ও আরবি ‘মিরাজ’ শব্দের অর্থ সিঁড়ি, সোপান, ঊর্ধ্বারোহণ বা ঊর্ধ্বগমন। আরবিতে এ রাত্রিকে বলা হয় ‘লাইলাতুল মিরাজ’ মহিমান্বিত রজনি।
পবিত্র এ রাতে দুনিয়া ও আখিরাতের সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক আল্লাহ তায়ালার হুকুমে প্রিয় নবী ও রসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) আরশে আজিম পর্যন্ত ঊর্ধ্বলোক গমনের সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। এ সময় তিনি মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের দিদার লাভ করেন এবং আল্লাহর কাছ থেকে ফরজ ইবাদত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধান নিয়ে একই রাতে আবার দুনিয়াতে ফিরে আসেন। এজন্য নামাজকে মুমিনদের মিরাজ বলা হয়। শবে মিরাজ শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সা.-এর একটি বিশেষ মুজিযা ও সম্মাননা। কারণ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও রাসুল হজরত মোহাম্মদ সা. ছাড়া অন্য কোনো নবী এ পরম সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেননি।
মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত। যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি। যাতে আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল’। (সুরা বনি ইসরাইল-১)
‘ইসরা’ অর্থ রাতে নিয়ে যাওয়া। আয়াতে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত সফরকে ইসরা বলা হয়। আর সেখান থেকে আসমান পর্যন্ত যে সফর, তাই মিরাজ। এ আয়াতে ‘ইসরা’ আর মিরাজ কুরআন ও হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণিত।
সুরা বাকারার শেষের দুটি আয়াত মিরাজেই অবতীর্ণ হয়। এ আয়াতগুলোতে উম্মতে মুহাম্মদির প্রতি আল্লাহর অশেষ রহমত ও অনুগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে। মুসলমানদের মধ্যে যারা কখনো শিরক করেনি, তাদের ক্ষমা করার সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে মিরাজে। ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মিরাজের রাতে তিনটি জিনিস দেওয়া হয়েছে : ১. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। ২. সুরা বাকরার শেষ কয়েকটি আয়াত ৩. নবিজির উম্মতের মধ্যে যারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করেনি, তাদের ক্ষমা করার প্রতিশ্রুতি। (সহিহ মুসলিম : ২৭৯)। নামাজে যে ‘আত্তাহিয়্যাতু’ পড়া হয়, সেটিও শবে মিরাজের উপহার।
হজরত আনাস ইবনে মালিক রা. বর্ণনা করেন, মিরাজের রাতে প্রিয় নবি সা.-এর উপর ৫০ (পঞ্চাশ) ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়েছিল। তারপর কমাতে কমাতে ৫ (পাঁচ) ওয়াক্তে সীমাবদ্ধ করা হয়। তারপর (আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে) ঘোষণা করা হল- ‘হে মুহাম্মাদ! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম; আমার কাছে কথার কোনো অদল-বদল নেই। আপনার জন্য এই পাঁচ ওয়াক্তের মধ্যে পঞ্চাশ ওয়াক্তের সওয়াব রয়েছে।’ (তিরমিজি, বুখারি ও মুসলিম)
হজরত মুহাম্মদ (সা.) নবুওত লাভের একাদশ বছরের রজব মাসে (৬২০ খ্রিস্টাব্দে) রাতে হজরত জিবরাইল (আ.) এর সঙ্গে বুরাক নামক বাহনে চড়ে প্রথমে পবিত্র কাবা থেকে পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত সফর করেন। সেখানে অন্যান্য নবী-রসুলের সঙ্গে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। তারপর সেখান থেকে সপ্তম আসমান পেরিয়ে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত সফরে হজরত জিবরাইল (আ.)-এর নবীজির (সা.) সঙ্গে পরিভ্রমণ করেন। এ সময় নবীজি (সা.) নভোমণ্ডল, বেহেশত-দোজখ ও সৃষ্টির বিভিন্ন রহস্য প্রত্যক্ষ করেন এবং পূর্ববর্তী নবীদের সাক্ষাৎ লাভ করেন। পরে রফরফ নামক বাহনে চড়ে নবীজি (সা.) আল্লাহ রব্বুল আলামিনের আরশে আজিম পর্যন্ত যাওয়ার ও মহান রব্বুল আলামিনের দিদার লাভের সৌভাগ্য লাভ করেন। নবীজি (সা.) আল্লাহর কাছ থেকে উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধান নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসেন। প্রতিদিন নামাজে আত্তাহিয়্যাতু পাঠের মাধ্যমে উম্মতে মুহাম্মদী সেই ঘটনার সাক্ষ্য প্রদান করেন। বিভিন্ন হাদিসে এর বিশদ বিবরণ রয়েছে।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘শপথ নক্ষত্রের যখন তা বিলীন হয়। তোমাদের সাথী ( হজরত মুহাম্মাদ সা.) বিপথগামী হননি এবং বিভ্রান্ত হননি। আর তিনি নিজে থেকে কোনো কথা বলেন না। (বরং তিনি যা বলেন) তা প্রদত্ত ওহি (ভিন্ন অন্য কিছু) নয়। তাকে শিখিয়েছেন মহাশক্তিধর (জিবরাইল আ.)। সে (জিবরাইল আ.) পাখাবিশিষ্ট, সে স্থিত হয়েছে দূর ঊর্ধ্বে। অতঃপর নিকটবর্তী হলো, পরে নির্দেশ করল। তারপর হলো দুই ধনুকের প্রান্তবর্তী বা আরও নিকট। পুনরায় তিনি ওহি করলেন তার বান্দার প্রতি যা তিনি ওহি করেছেন। ভুল করেনি অন্তর যা দেখেছে। তোমরা কি সন্দেহ করছ তাকে, যা তিনি দেখেছেন সে বিষয়ে। আর অবশ্যই দেখেছেন তিনি তাকে দ্বিতীয় অবতরণ স্থলে; সিদরাতুল মুনতাহার কাছে; তার নিকটেই জান্নাতুল মাওয়া। যখন ঢেকে গেল সিদরা যা ঢেকেছে; না দৃষ্টিভ্রম হয়েছে আর না তিনি বিভ্রান্ত হয়েছেন; অবশ্যই তিনি দেখেছেন তাঁর রবের বড় বড় নিদর্শনসমূহ।’ ( সুরা নাজম : ১-১৮)

হযরত মুহাম্মদ সা. মেরাজ থেকে ফিরে আসার পর সুরা বনি ইসরাইলের ২২ থেকে ৩৭ নং আয়াতের মাধ্যমে ১৪ দফা জনগণের সামনে পেশ করেন। সেগুলো হলো:-
 ১. আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করো না, তাহলে তুমি নিন্দিত ও অসহায় হয়ে পড়বে। আর তোমরা কেবল আল্লাহরই ইবাদত করো (সুরা বনি ইসরাইল ২২) ২. বাবা-মার সাথে ভালো ব্যবহার করো। তাদের একজন বা উভয়ে বৃদ্ধ অবস্থায় যদি তোমাদের সামনে উপনীত হয় তাহলে তাদের সাথে উহ্ শব্দটি পর্যন্ত করো না। তাদের ধমকের সুরে জবাব দিয়ো না; বরং তাদের সাথে মর্যাদা সহকারে কথা বলো। আর তাদের সামনে বিনয়ী থেকো আর দোয়া করতে থাকো- ‘হে আমার প্রতিপালক, তাদের তেমনিভাবে লালনপালন করো, যেমনি তারা শৈশবে আমাদের লালনপালন করেছেন (সুরা বনি ইসরাইল ২৩-২৪)।
 ৩. তোমাদের কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে তওবা করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চই আল্লাহ তোমাদের মনের খবর জানেন (সুরা বনি ইসরাইল ২৫)। ৪. আত্মীয়স্বজনকে তাদের অধিকার দাও আর মিসকিন ও মুসাফিরদের হক আদায় কর (সুরা বনি ইসরাইল ২৬)। ৫. অপব্যয় করো না, নিশ্চয়ই অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই, আর শয়তান স্বীয় প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ (সুরা বনি ইসরাইল ২৭)। ৬. হকদারদের হক আদায়ে তুমি যদি অপারগ (অসমর্থ) হও তাহলে তাদের সাথে অত্যন্ত নম্রভাবে কথা বলো (সুরা বনি ইসরাইল ২৮)।
৯. জিনা-ব্যভিচারের কাছেও যেও না। নিশ্চই এটি নিকৃষ্ট ও গর্হিত কাজ (সুরা বনি ইসরাইল ৩২)। ১০. কোনো জীবনকে অন্যায়ভাবে হত্যা করো না। কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হলে তার উত্তরাধিকারীকে আমি এই অধিকার দিয়েছি (চাইলে রক্তের বিনিময় চাইতে পারে), তবে প্রতিশোধের ব্যাপারে সে যেন বাড়াবাড়ি না করে (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ৩৩)।
১৩. যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই সেগুলোর পেছনে লেগো না। নিশ্চয়ই চোখ, কান, অন্তর সব কিছুই জিজ্ঞাসিত হবে (সুরা বনি ইসরাইল ৩৬)। ১৪. জমিনে দম্ভসহকারে চলো না। তুমিতো কখনও জমীনে ফাটল ধরাতে পারবে না ও উচ্চতায় কখনও পাহাড় সমান হতে পারবে না। (সুরা বনি ইসরাইল ৩৭)। আর এগুলো হলো শবে মিরাজের প্রকৃত শিক্ষা যা আমলের মাধ্যমে একজন মুসলমান তার ইহকাল ও পরকালীন শান্তি নিশ্চিত করতে পারে।
ইসলামের ইতিহাসে লাইলাতুল মিরাজ বিস্ময়কর ও অলৌকিক একটি ঘটনা। এ কারণেই রাতটি মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। মহানবী সা.-এর এ অলৌকিক সফরের সন-তারিখ নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও মূল ঘটনা সম্পর্কে কারও দ্বিমত নেই। অধিকাংশ আলেম ওলামাদের মতে, মিরাজ হয়েছিল হিজরতের আগে, আর সর্বাধিক প্রচলিত মত অনুযায়ী হিজরতের ১ বছর আগে, তারিখ ছিল ২৬ রজব দিবাগত রাতে। পবিত্র কুরআনুল কারিমে সুরা বনি ইসরাইল ও সুরা নাজমে মিরাজের প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। বিপুল সংখ্যক হাদিসে তার বিশদ বিবরণ রয়েছে। কাজেই মিরাজ অস্বীকার করলে কেউ মুসলমান থাকবে না। বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, মহানবী (সা.) এর মিরাজ সশরীরে ও জাগ্রত অবস্থায় হয়েছে, আত্মিকভাবে কল্পনার ডানায় ভর করে বা স্বপ্নযোগে হয়নি।
মুসলিম বিশ্ব অলৌকিক ও ঐতিহাসিক এ ঘটনার স্মারক দিবস হিসেবে প্রতিবছর ২৬ রজবের দিবাগত রাতটিকে শবে মিরাজ হিসেবে পালন করে থাকে। বাংলাদেশেও ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এ মহিমান্বিত রাতটি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত, নফল নামাজ আদায়, জিকির-আসকার, দোয়া-দরুদ ও ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে পালন করেন। যেহেতু মিরাজের মাধ্যমে আমরা ফরজ ইবাদত পাঁচ ওয়াক্ত সালাত বা নামাজ পেয়েছি, সুতরাং ওয়াক্তে ওয়াক্তে মনোযোগ সহকারে সালাত আদায়ের মাধ্যমে তা কায়েম করতে হবে। পাশাপাশি পবিত্র কুরআন-হাদিসের আলোকে মুসলমানদের জীবন গড়তে হবে। মহান রব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে নেকআমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাংবাদিক।

‍পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট