
দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলার দর্শনীয় স্থান দেখা ও বেড়ানোর জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪তম ব্যাচের আমরা ৮ বন্ধু যেই স্থির করলাম, তখনি দিনক্ষণ ঠিক করে বেরিয়ে পড়লাম। আমরা ৮ বন্ধু হলাম জাফর ছাদেক, জামসেদ আলম, রাশেদ মনোয়ার, কবির আহমদ মজুমদার, শীলাব্রত, মো. ইউসুফ, মো. লোকমান ও আমি। যাত্রার দিনটা ছিল গত ২৬ সেপ্টেম্বর। একসাথে বেড়াবো তাই ব্যাচ সংগঠনের লোগো সম্বলিত আকাশী কালারের টিশার্ট করা হলো সবার জন্য।
সেই টি-শার্ট পরে সবাই সকালে সূবর্ণ এক্সপ্রেসে ঢাকা রওনা হলাম এবং ঐদিনই বেলা ৩টায় মধুমতি এক্সপ্রেসে কুষ্টিয়া সদর কোট স্টেশনে রাত সাড়ে ৮টায় নেমে ইজিবাইকে চড়ে হোটেলে গিয়ে হালকা রেস্ট নিয়ে রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরেরদিন ২৭ সেপ্টম্বর শনিবার সকালে কুষ্টিয়ার এবং ২৮ তারিখ মেহেরপুর বেড়ানোর পর ২৯ সেপ্টেম্বর আমরা সেই বনলতা সেনের নাটোরে রওনা হলাম। নাটোর নামটা শুনলেই কবি জীবনানন্দের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘বনলতা সেন’ চোখের সামনে ভেসে উঠে। রবীন্দ্রত্তোর সময়ে প্রেম ও বেদনার অনুভূতিতে কবি জীবনানন্দ দাশ এই বনলতা সেন কবিতাটি লিখেছিলেন ১৯৩৪ সালে এবং তা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ সালে। কবির কাল্পনিক চরিত্রের এই বনলতা সেন কবিতাটি বাংলাসাহিত্যে বহুল পঠিত এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক রোমান্টিক কবিতা। কবির কল্পনায় বনলতা সেন নামে এক নারী অসামান্য চিত্রকল্পে বার বার তার কবিতায় স্থান করে নিয়েছে। নাটোরের আরেকটি হলো সেই বিখ্যাত মুখরোচক মিষ্টি কাঁচা গোল্লা’। তাও আমাদের খাওয়া থেকে বাদ যায়নি।
নাটোরে রানী ভবানী রাজবাড়ি, পুঠিয়া রাজবাড়ী, উত্তরা গণভবন বা নাটোরে কাচাগোল্লা খেতে গিয়ে অনেকেরই মুখে শুনছি নাটোর মিনি কক্সবাজার দেখার কথা। আবাসিক হোটেলে, খাবার হোটেলে, ইজিবাইক ড্রাইভারের কাছে এমনি কোথাও বেড়াতে গেলে সেখানে কারো সাথে কথা হলেও বলেন, ভাই পারলে একবার মিনি কক্সবাজারটা দেখে আসতে পারেন। মিনি কক্সবাজার নামটা শুনেই নিজের মধ্যে কেমন এক অন্যরকম অনুভূতি জাগলো। নিজেদের কক্সবাজার আবার নাটোরে? নাটোরে সমুদ্র নেই, তবু মিনি কক্সবাজার হয় কিভাবে? এটা দেখতে কেমন? দেখার জন্য খুব আগ্রহ জাগলো।
তাই একধরণের অনুভূতি ও মায়াবী টানে নাটোর মিনি কক্সবাজার দেখার জন্য ৩১ সেপ্টম্বর সকালে বেরিয়ে পড়লাম। আসা যাওয়া রিজার্ভ একটা ইজিবাইক ভাড়া নিলাম, আমরা ঘণ্টাতিনেক সময় নিয়ে মিনি কক্সবাজার দেখে ফিরে আসবো, একসাথে ৮ জন আসাযাওয়া ভাড়া ঠিক করা হলো ১১শত টাকা। সকাল ৯টায় রওনা দিয়ে আধঘণ্টার মধ্যে প্রায় সাড়ে ৯টায় আমরা ঐ ইজিবাইকে পাটুল নামক স্থানে পৌঁছে গেলাম। পাটুল হলো নলডাঙা উপজেলার একটি জায়গা, যেখান থেকে লোকজন তাদের গ্রামে ইঞ্জিন চালিত বোটে আসাযাওয়া বা পারাপার হয়।
আমাদেরও সেখান থেকেই বোটে করে মিনি কক্সবাজার দেখতে যেতে হবে। পাটুলে নেমেই দেখি বিশাল হাওর এলাকার মত নলডাঙা উপজেলার পাটুলে সারি সারি ইঞ্জিনচালিত বোট চারিদিকে পানি আর পানি। পাটুলে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি ইঞ্জিন চালিত বোট। এই বোটে চড়েই পর্যটকরা মিনি কক্সবাজার বেড়ায়। বোট চালকের সাথে কথাবার্তা ঠিক করা হলো আমরা বোট নিয়ে পানিতে ঘুরবো এবং কোন একটা জায়গায় নেমে তা দেখবো। এতে বোটচালক জানালো তিনঘণ্টা সময় লাগবে। আসাযাওয়া রিজার্ভ বোট ভাড়া ঠিক করা হলো ৮ শত টাকা। দলবেঁধে সব বন্ধুরা বোটে উঠে পড়লাম। বোট চলছিল খোলাবারিয়া জিরো পয়েন্টের দিকে, যেখানে দোকানপাট বাজার রয়েছে। চারিদিকে থই থই পানি আর পানি। পরিস্কার স্বচ্ছ জলরাশি আর দুধারে অপূর্ব শোভা পেরিয়ে আমাদের বোট চলছে আর আমাদের মাঝে একধরনের আনন্দ ও উচ্ছ্বাস। এই বুঝি মিনি কক্সবাজার।
বোট চালকদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাদের একজনের নাম মোঃ আলী আরেকজন বকুল মাঝি। তারা জানায় সব বোটে দুজন করে থাকেন। একজন বোট চালায় আরেকজন সহযোগি। তাদের বাড়ি কোথায় জানতে চাইতেই বকুল মাঝি হাত তুলে তার গ্রামের দিকে আঙুল উচিয়ে বলেন ঐ যে দেখছেন ঘরবাড়ি ঐটাই আমাদের গ্রাম। নাম একডালা। আমরা দুজন একপাড়ার মানুষ, সম্পর্কে চাচাভাতিজা। ভোর ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।
বোট চালায়, সিজনে পর্যটক বেশি আসে, তখন ভাড়া বেশি হয়। আগে এত এত বোট ছিল না। গ্রামের লোকজন নিয়মিত আসাযাওয়া করার জন্য ৪০টার মত বোট ছিল, এখন এই এলাকা মিনি কক্সবাজার নাম হয়ে তা প্রচার হওয়ায় বহু মানুষ এখানে দেখতে আসে। তাই বোটের সংখ্যাও বেড়ে এখন শতাধিক। পর্যটক ছাড়াও ৪ গ্রামের লোকদের আনা নেওয়ায় জনপ্রতি ৪০ টাকা ভাড়া নেয় তারা। বোট ভাড়া ও খরচ বাদ দিয়ে তাদের দৈনিক দুই আড়াই হাজার টাকা থাকে।
নানা কথার মাঝে আমাদের বোট খোলাবারিয়া বাজারে এসে থামলো। আমরা বোট থেকে নেমে বাজারে উঠলাম এবং এদিক ওদিক দেখতে লাগলাম। আমরা একটা দোকানের সামনে চেয়ার ও টেবিলে বসলাম এবং দোকানদারকে চা বিস্কুটের অর্ডার দিলাম। দোকানদারেরনাম আবদুর রহিম পিন্টু। সেই ফাঁকে আমাদের এক বন্ধু কাসুন্দি মাখা পেয়ারা নিয়ে এলো, তা আমরা শেয়ার করে খেলাম। তখন দোকানদার বললো স্যার, চা টা একটু পরে দেই, পেয়ারা খেয়ে নেন। আবার বললো আপনারা কি মিনি কক্সবাজার দেখতে এসেছেন? আমরা বললাম হাঁ, আমরা চট্টগ্রাম থেকে এসেছি। সে বললো, স্যার তা আপনাদের কথায় বুঝতে পেরেছি। সে চা বানাতে বানাতে গল্প জুড়ে দিল। লোকটাকে বেশ শিক্ষিতভদ্র ও আন্তরিক মনে হলো। সে জানালো বিকালের দিকে পর্যটকরা বেশি আসেন, তখন বেচাবিক্রিও বেশি হয়। ঐ যে দেখছেন সুন্দর উঁচু দালান। ঐটা খোলাবাজারি হাইস্কুল ও মাদ্রাসা। আমি সেখান থেকে এসএসসি পাস করেছি। শহরে গিয়ে আর লেখাপড়া হয়নি। বাবা মারা যাবার পর থেকে বাবার এই দোকানটা করি। মোটামুটি মন্দ না, ভালই চলে ।
তবে জানেন স্যার, এই এলাকা বছরে ৫ মাস কোমর পানিতে ডুবে থাকে। তখন এলাকার লোকজন শহরে যেতে বোট এবং একগ্রাম থেকে অন্যগ্রামে যেতে বা ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে নৌকা ব্যবহার করে। এলাকায় চারখানা গ্রাম রয়েছে, একটার থেকে আরেকটার দূরত্ব আধ বা এক কিলোমিটার এমনই। এই চারগ্রামের নাম হল- হালতি, খোলাবাজারিয়া, একডালা ও দীঘির পাড়। হালতিতে তিনহাজার, খোলাবাজারিয়ায় পাঁচহাজার, একডালায় তিনহাজার ও দীঘির পাড়ে তিনহাজার মানুষ বাস করে। এলাকায় পঞ্চাশ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত। তিনি জানান এদের অনেকে বড় বড় চাকুরী ও ব্যবসা করেন।
কিন্তু পাটুল থেকে খোলাবারিয়া বাজার পর্যন্ত ছয় ফুট প্রস্তের আট কিঃমিঃ একটা ইটেরসলিন করা রাস্তা আছে। এখন পানিতে ঐ রাস্তা ডুবে যাওয়ায় তা আপনারা দেখতে পারছেন না। তিনি আরো জানান নদীর উজান পানিতে প্রতি বছরের নাকি জুন, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর এই ৫ মাস কোমর সমান পানিতে তলিয়ে যায়। তখন চাষবাস গবাদিপশু, ব্যবসাবাণিজ্য ও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ভীষণ ক্ষতি হয়। ঐ রাস্তাটা তিন ফুট উঁচু করে নির্মাণ করলে পুরো এলাকার প্রায় ১৫ হাজার মানুষ এই চরম দুর্ভোগ থেকে রেহাই পেত। তিনি হাসিমুখে বলেন, এই কষ্ট ছাড়া আমাদের গ্রামবাসীর আর তেমন বড় কোন কষ্ট নেই। অন্যদিক দিয়ে আমরা ভাল ও সুখে আছি। চারগ্রামে চারটা প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। আছে একটা হাই স্কুল ও মাদ্রাসা আছে। চারগ্রামে পল্লীবিদ্যুও আছে। সব মিলিয়ে আমরা খুব শান্তিতে আছি। পানিবন্দী এক অজপাড়াগাঁয়ে এভাবে বাস করেও তার মধ্যে যে নির্মল আনন্দ ও সুখ দেখতে পেলাম, রাজধানীসহ বড় বড় শহরের আলীশান আধুনিক দালানে বাস করেও তার মত কজন সুখে আছে, ভাবতে লাগলাম। দোকানদার পিন্টু আরো বলেন স্যার আমাদের এই সব গ্রামে তেমন কোন মারামারি হানাহানি কলহ-বিবাদ, চাঁদাবাজি সন্ত্রাসী কিছু নাই। হালকা ঝগড়াঝাটি হলে আমরাই তা মিটিয়ে ফেলি।
সুখগাঁথা জীবনের গল্প শুনতে শুনতে আর তার অনাবিল মায়াময় প্রচ্ছন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে বিদায় নিলাম এবং আবারো বাজারখানা ঘুরে দেখে এবার ফিরার জন্য বোটে উঠলাম। পানির মাঝে আমাদের এদিক ওদিক ঘুরে পাটুলের পথে চলতে লাগলো। পথে বিশাল আকারের একটা বিল্ডিং দেখে চালক মোঃ আলী তা কি জিজ্ঞেস করতেই সে জানাল, বিল্ডিংটা একটা রেস্টুরেন্ট ও কমিউনিটি সেন্টার।
বোট থামিয়ে আমরা তাতে উঠে দেখলাম তিনতলা ভবনের নীচ তলায় বিরাট হলরুম ও রেস্টুরেন্ট। দ্বিতীয় তলায় খাওয়াদাওয়া ব্যবস্থা। তৃতীয় তলায় কয়েকটা থাকার রুম আছে। এতে গ্রামবাসীর বিয়েশাদি আচার অনুষ্ঠান হয়। এছাড়াও পর্যটকরা আসলে রাতে থাকেন, খাওয়াদাওয়া ও গানবাজনা করেন। দেখে খুব ভাল লাগল। সেখানে আমরা লেমনজুস খেলাম এরপর নেমে বোটে চড়ে পাটুলে পৌঁছলাম। এই জার্নিতে আমাদের প্রায় সাড়ে তিনঘণ্টা সময় লাগলো। পাটুলে আমাদের রিজার্ভ করা ইজিবাইকে চড়ে আমরা সববন্ধুরা হোটেলের দিকে যাত্রা করলাম আর ভাবতে লাগলাম পুরো পাঁচমাস চারখানা গ্রামসহ বিস্তীর্ণ এলাকার পনর হাজার মানুষ জীবনযাত্রা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আরেক নাম মিনি কক্সবাজার।
সাইফুদ্দিন আহমদ সাকী
প্রাবন্ধিক; সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন
পূর্বকোণ/পারভেজ