আর একটু হলেই সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা হাতছাড়া হতে যাচ্ছিল বাংলাদেশের। প্রথমার্ধে ভারত এগিয়ে যায়। ম্যাচ শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে মোসাম্মত সাগরিকা লক্ষ্যভেদ করে স্বাগতিকদের হাজারো দর্শকদের মাঝে স্বস্তি এনে দেন। ওই গোলটি না হলে হয়তো যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা কঠিনই ছিল। এমন পারফরম্যান্সের পর সাগরিকার মধ্যে ভবিষ্যতের তারকার হওয়ার সম্ভাবনাটা বেশি দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
সবশেষ নারী লিগ থেকে সাগরিকাকে বয়সভিত্তিক দলে টানেন তৎকালীন কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। কিন্তু সেসময় তার শারীরিক গঠন দেখে কেউ কেউ অনাগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ছোটন অনেকটা জোর করেই বাফুফের আবাসিক ক্যাম্পে নিয়ে নেন তাকে।
মাত্র বছর দুয়েক যেতে না যেতেই ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল থেকে উঠে আসা এক দরিদ্র পরিবারের সেই কন্যা এখন দেশের নারী ফুটবলে আলোচিত মুখ। ছোটন তাই নিজেকে সার্থক মনে করছেন। সাংবাদিকদের কাছে স্মৃতি রোমন্থন করে বলেছেন, ‘সাগরিকার খেলা দেখে তখনই ভালো লেগে যায়। তখনই বুঝতে পারছিলাম ওকে ঠিকমতো পরিচর্যা করলে দেশের ফুটবলে একদিন সম্পদ হবে। সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ ফুটবল দিয়ে অন্তত তা পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। যদিও শুরুতে সাগরিকাকে নিতে চাননি তখনকার টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পল স্মলি, বিশেষ করে তার শারীরিক গঠনের দিকে তাকিয়ে। আমি জোর করে ঝুঁকি নিয়েই দলভুক্ত করি। আজ সাগরিকা তার পারফরম্যান্স দিয়ে সবাইকে আনন্দে ভাসিয়েছে। এটা দূর থেকে দেখে অনেক ভালো লাগছে। সামনের দিকে ও নারী ফুটবলে বড় তারকা হবে, এটা এখন প্রত্যাশা করাই যায়।’
বাংলাদেশের চারটি ম্যাচের তিনটিতে ৪ গোল সাগরিকার। ভুটানের বিপক্ষে ম্যাচে খেলা হয়নি। সব গোলই ছিল দৃষ্টিনন্দন। সাগরিকার বড় গুণ হলো ঠান্ডা মাথায় দারুণ ফিনিশিং করতে পারেন। প্রতিপক্ষের বক্সে গিয়ে খেই হারান না। যতই চাপ থাকুক না কেন, ফিনিশিংটা তার চমৎকার।
এই প্রথমবার ক্যারিয়ারে আন্তর্জাতিক শিরোপা, তাও আবার নারী ফুটবলের মাধ্যমে। কোচ সাইফুল বারী টিটুর প্রশংসাও কম পাচ্ছেন না সাগরিকা, ‘ও তো মেধাবী ফুটবলার। ওর যেমন রানিং রয়েছে, তেমনি আবার নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা কম নয়। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ঠান্ডা মাথায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ওর গোলগুলো দেখবেন, সবগুলোতেই দারুণ ফিনিশিং। যদিও ওর শারীরিক গঠন কিংবা পায়ের পেশী সেভাবে গড়ে ওঠেনি। তারপরও যা গুণ আছে তা কম নয়। আমার মনে হয় ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ তারকা হবে।’
সাগরিকার গোলে বাংলাদেশ জিতবে, নিজের মেয়ে এভাবে মাঠ মাতাবে, দর্শকরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবে—তা শুরুতে ভাবেননি বাবা-মা। ফাইনালের দিন তো সকালে ঢাকায় এসে বিকালে কমলাপুর স্টেডিয়ামে বসে খেলাও দেখেছেন। মেয়ের পারফরম্যান্স দেখে তো মাঠেই খেলা শেষে এক আনন্দমুখর পরিবেশের অবতারণা হয়। বাবা-মা দুজনকে জড়িয়ে ধরে মেয়ের আনন্দ অশ্রু ঝরে!
সাগরিকা বলেন, ‘ফুটবল খেলি বলে বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। অনেক দিন কথা বলতেন না। আমি কতবার বাবাকে ফোন করেছি, ধরতেন না। গ্রামের লোকও অনেক বাজে কথা বলেছে। এখন সবাই খুশি। এই আনন্দ বলে বোঝানো যাবে না।’
এর আগে দুপুরে প্রেসবক্সে বাবা লিটন আলী বলে গেছেন সুখকর কথা, ‘শুরুতে আমরাও চাইনি ও ফুটবল খেলুক। অনেকে কটু কথা বলতো। তবে ওর চেষ্টায় সফল হয়েছে। এখন আমরা ওকে নিয়ে গর্বিত। আমাদের মেয়ে দেশের হয়ে খেলছে। সবাই ওর খেলা দেখছে। ও গোল পাচ্ছে। সবাই ওকে চিনছে জানছে। এমন আনন্দ আসলে অন্যরকম।’ মা আনজু বেগমও খুশিতে মাতোয়ারা।
ম্যাচ কমিশনারের লঙ্কাকাণ্ডের পর রাতে শিরোপা ভাগাভাগি করে নেওয়ার আনন্দের রেশ এখনও আছে সাগরিকার মাঝে। আজই মা-বাবার সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেছেন। নিশ্চয়ই সেখানে গিয়ে নিজের মেয়েকে নিয়ে সুখকর অভিজ্ঞতা সবাইকে জানাবেন। গর্বে বুক ফুলিয়ে চলবেন। এমন দিনটির জন্য হয়তো অপেক্ষায় ছিল সাগরিকার! সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
পূর্বকোণ/পারভেজ