
আমরা কমবেশি সবাই জানি ইভটিজিং কি। ইভটিজিং বলতে সাধারণত কোনো নারী বা কিশোরীকে তার স্বাভাবিক চলাফেরা বা কাজকর্ম করা অবস্থায় অশালীন মন্তব্য করা, ভয় দেখানো, তার নাম ধরে ডাকা এবং চিৎকার করা, বিকৃত নামে ডাকা, কোনো কিছু ছুঁড়ে দেয়া, ব্যক্তিত্বে লাগে এমন মন্তব্য করা, যোগ্যতা নিয়ে টিটকারী করা, তাকে নিয়ে অহেতুক হাস্যরসের উদ্রেক করা, রাস্তায় হাঁটতে বাধা দেয়া, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা, ইঙ্গিতপূর্ণ ইশারা দেয়া, সিগারেটের ধোঁয়া গায়ে ছাড়া, উদ্দেশ্যেমূলকভাবে পিছু নেয়া, অশ্লীলভাবে প্রেম নিবেদন করা, ইত্যাদি ইভটিজিং।
“আপু, জানেন? আগে যে এলাকায় থাকতাম সেই এলাকায় ছেলেপুলেরা আমাকে টিজ করতো। ক্লাস শেষে একা একা বাসায় ফিরতে ভরসা পেতাম না। সবসময় কোনো না কোনো ছেলে বন্ধু বাসায় পৌঁছে দিতো যাতে ওই বাজে ছেলেরা বেশি কিছু করার সুযোগ না পায়। আমি ভাবতাম, আমি তো খুব কঠোরভাবে পর্দা করে চলি, তাহলে আমাকে কেন ইভ টিজিংয়ের শিকার হতে হয়? আমি আম্মুকেও কখনো বলি নি যে, ছেলেরা আমাকে বিরক্ত করে। কারণ, আমি বললেই আম্মু বলবে কোথাও না কোথাও দোষ আমার এজন্য ছেলেরা বিরক্ত করে। আমি এখনো ভয়ে আছি- যদি ছেলেগুলো আমার নতুন বাসার ঠিকানা পায় তাহলে আবার এখানে এসে বিরক্ত করবে।”- কথাগুলো বলে নবম শ্রেণি পড়ুয়া তাবাসসুম।
আমরা কমবেশি সবাই জানি ইভ টিজিং কি। ইভ টিজিং বলতে সাধারণত কোনো নারী বা কিশোরীকে তার স্বাভাবিক চলাফেরা বা কাজকর্ম করা অবস্থায় অশালীন মন্তব্য করা, ভয় দেখানো, তার নাম ধরে ডাকা এবং চিৎকার করা, বিকৃত নামে ডাকা, কোনো কিছু ছুঁড়ে দেয়া, ব্যক্তিত্বে লাগে এমন মন্তব্য করা, যোগ্যতা নিয়ে টিটকারী করা, তাকে নিয়ে অহেতুক হাস্যরসের উদ্রেক করা, রাস্তায় হাঁটতে বাধা দেয়া, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা, ইঙ্গিতপূর্ণ ইশারা দেয়া, সিগারেটের ধোঁয়া গায়ে ছাড়া, উদ্দেশ্যেমূলকভাবে পিছু নেয়া, অশ্লীলভাবে প্রেম নিবেদন করা, উদ্দেশ্যেমূলকভাবে গান, ছড়া বা কবিতা আবৃত্তি করা, চিঠি লেখা, পথ রোধ করে দাঁড়ানো, প্রেমে সাড়া না দিলে হুমকি প্রদান ইত্যাদি ইভ টিজিংয়ের মধ্যে পড়ে। ইভ টিজিং এর শিকার বেশিরভাগ নারী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের অনেকেই ইভটিজিংয়ের ভয়ে লেখাপড়া বন্ধ করে দেন, বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দেন, সবসময় আতঙ্কে থাকেন এবং চূড়ান্ত পরিণতি ঘটান আত্মহননের মাধ্যমে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, ২০১৫-২০১৭ এর মধ্যে ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে প্রায় ৪০ জন মেয়ে। এই গবেষণায় বলা হয়, উত্যক্তকারীদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার কোন উপায় না দেখেই সাধারণত ওই মেয়েরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। ইভ টিজাররা নানান সৃজনশীল কৌশলে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে থাকে। ফলে এ অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন। এমনকি অনেক নারীবাদী একে “ছোটোখাটো ধর্ষণ” বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ইভ টিজিংয়ের পেছনে কারণ খুঁজতে গিয়ে অনেকে পোশাককে দায়ী করেছেন এবং পর্দা করাকে ইভ টিজিং সমস্যার সমাধান হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু ইভ টিজিংয়ের পেছনে মূল কারণ হলো পারিবারিক এবং নৈতিক শিক্ষার অভাব। আমরা যখন মেয়েদের বলি “গায়ে ওড়না দাও, নাহলে ছেলেরা আজেবাজে কথা বলবে”, “মাথা নিচু করে হেঁটো, না হলে লোকে বেয়াদব বলবে”, “মাথায় কাপড় দাও, না হলে লোকে খারাপ বলবে”- তখন এসব কথার মাঝেই আমরা ইভ টিজিংকে এক রকম বৈধতা দিয়ে ফেলি। বিষয়টা এমন যেন উক্ত কাজগুলো না করলে ইভ টিজিং করা জায়েজ। একজন নারী কতটুকু পর্দা করবেন বা করবেন না এটা নিতান্তই তার পছন্দ। পর্দা করে কখনো যৌন নিপীড়ন বন্ধ করা যায় না। তনু ধর্ষণ হতে শুরু করে নুসরাতকে যৌন হয়রানি করা তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। সব মানুষেরই পোষাকের ব্যাপারে নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ আছে। কিন্তু কোনো ব্যক্তির পোশাক আপনার পছন্দ হয়নি বলে আপনি যদি এমন কোনো কথা বলেন যাতে ব্যক্তিটি আহত বোধ করবেন তাহলে আপনি একজন ইভ টিজার এবং মৌলবাদী। ইভ টিজিংয়ের জন্য বড় অংশে দায়ী পারিবারিক শিক্ষা। এজন্য মা, আপনার মেয়েকে “মেয়ের (মাথা নত করে, পর্দা করে) মতো চলবি” না বলে আপনার ছেলেকে বলুন” সব মেয়েদের সম্মান করবি”।
ইভ টিজিংয়ের শাস্তি সম্পর্কে বাংলাদেশের সংবিধানে দণ্ডবিধি আইন, ১৮৬০-এর ৫০৯ ধারায় বলা হয়েছে- “যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারীর শ্লীলতাহানির উদ্দেশ্যে সে নারী যাহাতে শুনিতে পায় এমনভাবে কোনো কথা বলে বা শব্দ করে কিংবা সে নারী যাহাতে দেখিতে পায় এমনভাবে কোনো অঙ্গভঙ্গি করে বা কোনো বস্তু প্রদর্শন করে, কিংবা অনুরূপ নারীর গোপনীয়তা অনধিকার লঙ্ঘন করে, তাহা হইলে সেই ব্যক্তি এক বৎসর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে কিংবা অর্থদণ্ডে কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।”
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ এর ৭৬ ধারায় ইভটিজিং বা উত্ত্যক্ততা বিষয়ে বলা হয়েছে- “যদি কেউ কোনো রাস্তায় বা সাধারণের ব্যবহার্য স্থানে বা সেখান হতে দৃষ্টিগোচরে স্বেচ্ছায় এবং অশালীনভাবে নিজ দেহ এমনভাবে প্রদর্শন করে, যা কোনো গৃহ বা দালানের ভিতরে থেকে হোক বা না হোক কোনো মহিলা দেখতে পায় বা স্বেচ্ছায় কোনো রাস্তায় বা সাধারণের ব্যবহার্য স্থানে কোনো নারীকে পীড়ন করে বা তার পথ রোধ করে বা কোনো রাস্তায় বা সাধারণের ব্যবহার্য স্থানে কোনো অশালীন ভাষা ব্যবহার করে, অশ্লীল আওয়াজ, অঙ্গভঙ্গি বা মন্তব্য করে কোনো মহিলাকে অপমান বা বিরক্ত করে, তবে সেই ব্যক্তি ১ বৎসর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদণ্ডে অথবা ২ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।”
১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি আইনের ৩৫৪ ধারায় বলা হয়েছে- “যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারীর শালীনতা নষ্ট করার অভিপ্রায় বা সে তাদ্বারা তার শালীনতা নষ্ট করতে পারে জেনেও তাকে আক্রমণ করে বা অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ করে তাহলে সে ব্যক্তি ২ বৎসর পর্যন্ত যেন কোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে বা জরিমানাদণ্ডে বা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডিত হবে।”
দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ২৯৪ ধারায় বলা হয়েছে- “যদি কোনো ব্যক্তি অন্যদের বিরক্তি সৃষ্টি করে কোনো প্রকাশ্য স্থানে কোনো অশ্লীল কার্যও করে অথবা কোনো প্রকাশ্য স্থানে বা তার সন্নিকটে কোনো অশ্লীল গান, গাঁথা, সংগীত বা পদাবলী গায়, আবৃত্তি করে বা উচ্চারণ করে তাহলে সে ব্যক্তি ৩ মাস পর্যন্ত যে কোনো ধরনের কারাদণ্ডে বা জরিমানাদণ্ডে বা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডিত হবে।”
আপনার কাছে ইভ টিজিং মানে নিছক মজা হতে পারে কিন্তু যাকে টিজ করছেন সেটি তার জন্য চরম অবমাননার হতে পারে এবং সেটি তাকে মৃত্যুর দিকেও ঠেলে দিতে পারে। সুতরাং, ইভ টিজার না হয়ে মানুষ হোন।
পুরুষের একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে তাকে জীবন কাটাতে হয়েছে অনেকটা প্রতিবাদহীন জড় বস্তুর মতো। সমাজের অধিপতি যারা তাদের নির্দেশিত আদেশ মেনে চলতে হতো। একজন নারী বিয়ের পর সমস্ত অধিকার ছেড়ে স্বীয় বাড়িতে নিজের বাবা মায়ের কাছে আসতো অতিথির মতো।