চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

সর্বশেষ:

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে তাপ প্রবাহ বৃদ্ধি, এর প্রভাব ও প্রতিকার

ড. মো. আলী হায়দার

১০ জুন, ২০২৪ | ৯:৪৭ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশ পৃথিবীতে দুর্যোগ প্রবণ দেশসমূহের মধ্যে অন্যতম। এদেশে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগের ফলে প্রতি বছর বহু মানুষের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হয়। পৃথিবীর অন্যতম একটি দরিদ্র দেশ হওয়ায় এসব দুর্যোগের ফলে মানুষের জীবন ও জীবনমানের প্রতি নিয়ত বাধা প্রাপ্ত হয়। এমনকি অনেকে নিঃস্ব হয়ে অসহায় জীবন-যাপন করতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশে বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বৃদ্ধির হার ক্রমাগতভাবে দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। যার ফলে দেশের সামগ্রিক পরিবেশ, উৎপাদন ব্যবস্থা এবং মানুষ ও অন্যান্য জীবকূলের উপর তীব্রতর প্রভাব পড়ছে।

 

বাংলাদেশে বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রা বৃদ্ধির এ প্রবণতার উল্লেখযোগ্য কারণসমূহ হচ্ছে সবুজ আচ্ছাদন ও জলাভূমির পরিমাণ দ্রুতলয়ে হ্রাস, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং কৃষিকাজের ধরন বিশেষত ধান চাষ ও গবাদি পশুপালন অন্যতম যা বায়ুমণ্ডলীয় উষ্ণতা/তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে।

 

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাবও বাংলাদেশে বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। আমরা জানি অতিউষ্ণ বায়ু যে অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয় সেখানকার ভৌত ও সামাজিক পরিবেশের উপর তার বিরূপ প্রভাব পড়ে। যে কারণে স্থানীয় পরিবেশ ও বৈশ্বিক পরিবেশ পারস্পরিকভাবে বায়ুমণ্ডলীয় তাপীয় অবস্থার সম্মিলিত রূপকে আমাদের মোকাবেলা করতে হয়।

 

বাংলাদেশে আবহাওয়ার তথ্য-উপাত্ত আমরা যদি গত ১০০-১২০ বছরের পর্যালোচনা করি, তা হলে দেখা যাবে গড় তাপমাত্রা ২৪.৩০ সে. থেকে ২৫.৬১০ সে. এ উন্নীত হয়েছে যা প্রায় ১.০৪০ সে. বৃদ্ধির সমান। আমাদের বার্ষিক সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা ১৯০০ সালে ছিল ১৫.৭৮০ সে. এবং ২০২০ তা এসে দাড়ায় ১৭.২৮০ সে. এবং সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ১৯০০ সালে ছিল ২৮.৫৭০ সে. এবং ২০২০ এসে তা ২৯.৮৭০ সে. এ উন্নীত হয় (স্নেহা পাল ও সুবেন্দু রায়, ২০২০)। উপরোক্ত তথ্য হতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বৈশ্বিক উষ্ণয়নের সাথে আমাদের দেশের বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এ বৃদ্ধির হার সাম্প্রতিক সময়ে দ্রুততর হচ্ছে। আর এর পেছনে প্রধানত মানুষেন দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডই মূলতঃ দায়ী।

 

বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রা/উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে পরিবেশের জৈব ও অজৈব উভয় উপাদানই বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। বিশেষতঃ মানুষই এর সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার। উচ্চতাপের ফলে মানুষের শরীর বৃত্তীয় নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয়। এমনকি মৃত্যুর মুখেও পতিত হন। তার কর্মক্ষমতা হ্রাস পায় এবং উৎপাদন ব্যবস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উচ্চতাপ ক্ষতিকর পোকামাকড়ের বংশবৃদ্ধিতেও সহায়ক, বিশেষতঃ মশা-মাছি, ব্যাকটেরিয়া এমনকি ফসলের বিনাশকারী অনেক কীটপতঙ্গও উচ্চতাপে বংশবিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে যা নিয়ন্ত্রণে আমাদেরকে পরিবেশ বিনাশী কীটনাশক ব্যবহার করে দমন করতে হয়। এছাড়াও অতিরিক্ত উষ্ণতা ফসলের উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে। ভূ-উপরিস্থ পানি শুকিয়ে ফেলে যার প্রভাবে মৎস সম্পদ হ্রাস পায় এবং কোন কোন এলাকা রুক্ষ ও মরু প্রবণ হয়ে উঠে।

 

বাংলাদেশ একটি উপকূলীয় নদী বিধৌত প্লাবন সমভূমির দেশ যার মূল ভূমির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে মাত্র ০-৫ মিটার উঁচু। যদিও জোয়ারের পানি প্রতিদিন দু’বেলা প্রায় গড়ে ৫ মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। আমরা জানি বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্র পৃষ্ঠের পানির উচ্চতাও বৃদ্ধি পায়। ফলশ্রুতিতে জোয়ারের পানির উচ্চতা বৃদ্ধিতেও বায়ুমণ্ডলীয় তাপ বৃদ্ধি সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এ প্রেক্ষিতে উপকূলীয় এলাকা এবং চরাঞ্চলে জোয়ারের পানি ভূ-ভাগের অনেক ভিতরের এলাকাকে প্লাবিত করে এবং ফসল ও সম্পদের ক্ষতি সাধন করে। বিশেষতঃ কৃষি জমি অনুর্বর এবং পানি ও মাটির লবণাক্ততা বহুলাংশে বৃদ্ধি করে।

 

বাংলাদেশে বায়ুমণ্ডলীয় তাপপ্রবাহ বৃদ্ধি মোকাবেলা করা খুব একটা সহজ কাজ নয় এবং বাংলাদেশ এককভাবে তা মোকাবেলা করতে পারবেও না। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও বৈশ্বয়িক সহযোগিতা আবশ্যক। বায়ুমণ্ডলীয় তাপ প্রবাহ মোকাবেলায় আমাদের প্রত্যেককে সচেতন হতে হবে এবং রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি পর্যায়ে উদ্যোগ নিয়ে শূন্য কার্বন নিঃসরণ নীতি অনুযায়ী আমাদের উন্নয়ন কর্ম পরিকল্পনা সাজাতে হবে। এটা আমাদের নগর-গ্রাম উন্নয়ন পরিকল্পনা থেকে সর্বত্র প্রয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সম্মুখে থেকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষকদের ভূমিকা হবে জাতির আগামীর নেতৃত্বকে পরিবেশ সচেতন করে গড়ে তোলা আর রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সরকারি নীতি ও পরিকল্পনা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তদারকি করা। অন্যান্য যারা স্টেইকহোল্ডার আছেন তাদেরকে স্ব স্ব সংগঠনের মাধ্যমে শূন্য কার্বন নিঃসরণ নীতির আওতায় কিভাবে আমাদের উন্নয়ন কর্ম পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন করা যায় তা প্রশিক্ষণ ও প্রেষণার মাধ্যমে পরিবেশ সংবেদনশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা।

 

পৃথিবীর অনেক দেশেই বায়ুমণ্ডলীয় তাপ প্রবাহ বৃদ্ধির ফলে তাদের ভূ-খণ্ডের অনেক এলাকা মরুকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছিল। বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, চীন এবং মধ্য আফ্রিকার অনেক দেশ। আমাদের দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল বিশেষতঃ বরেন্দ্র এলাকাও মরুকরণের শিকার হচ্ছিল। উপরোক্ত দেশসমূহ তাদের দেশে বিভিন্ন গবেষণালদ্ধ ফলাফলের ভিত্তি বনায়ন করে অনেক মরু প্রায় এলাকাকে সবুজ বনানীতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে। সামাজিক বনায়নে আমরা যতটা সফল হয়েছি, প্রাকৃতিক বনায়নে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ। এর জন্য মূলতঃ মনে করা হয় বনজ সম্পদ রক্ষাকারীদের। বায়ুমণ্ডলীয় উচ্চতাপ হ্রাসকরণে ভূমি খেকোদের বিশেষত: জলাভূমি ভরাট, পাহাড়কাটা ও উন্মুক্ত প্রাকৃতিক ভূমি দখলকারীদের ব্যাপারে স্থানীয় সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে এগিয়ে এসে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করতে হবে।

 

লেখক: অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

 

পূর্বকোণ/জেইউ/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট