চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

সর্বশেষ:

শবে বরাত নিয়ে তিনমত, মধ্যপন্থা অবলম্বনই ইসলামের পথ

নাসির উদ্দিন

২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ | ৬:১১ অপরাহ্ণ

রবিবার দিবাগত রাত শবে বরাত। আল কোরআনে শবে বরাতের বর্ণনা নেই। হাদীসে বর্ণনা আছে। শবে কদরের বর্ণনা কোরআন ও হাদীস দুটোতেই আছে। কিন্তু হাদীসে বরাত নামে কোন শব্দ নেই। আছে, ‘লাইলাতান নিসফে মিন শাবান’ অর্থাৎ শাবান মাসের মাঝখানের রাত।
বাংলা, উর্দু, ফার্সিতে শবে বরাত বলা হলেও আরবীতে লাইলাতুল বরাত। মুসলিমদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই মুক্তির রাত। এই রাতে আল্লাহ তার বান্দাদেরকে বিশেষভাবে ক্ষমা করেন।বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের মুসলমানরা নফল ইবাদাতের মাধ্যমে শবে বরাত পালন করেন।
শবে বরাত সম্পর্কে আমাদের সমাজে ৩ ধরনের মত পাওয়া যায়। একটি দল শবে বরাতকে অস্বীকার করে। তাদের মন্তব্য শবে বরাত বলতে এই রকম মর্যাদাপূর্ণ কোন রাত ইসলামে নেই। তবে শবে কদর আছে তা স্বীকার করেন। আহলে হাদিসরা এই রাতের মর্যাদা স্বীকার করতে রাজী নয়। আবার আর একটি দল আছে যারা সীমালঙ্ঘন করে। তারা মনে করে শবে বরাতটাই আসল। এই রাত পেলে আর তেমন ইবাদত করার দরকার নেই। তারা মনে করে হালুয়া-রুটি, গোস্ত খেয়ে সারারাত ইবাদত করলে পুরো বছরের গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। সারা বছর গায়ে হাওয়া লাগিয়ে চলা যাবে। সারা বছর অপরাধে জড়িত হলেও সমস্যা নেই ! এটাকে অত্যন্ত বেশি গুরুত্ব দেয়। অথচ এই শবে বরাতের চেয়ে কোটি গুণ দামি শবে কদর। সেই কারণে আমরা হলাম মধ্যমপন্থি। শবেবরাত একবারে গুরুত্বহীন তা নয়। আবার ফরজ ও ওয়াজিবও নয়। শবে বরাত পালন মোস্তাহাব। আমল করলে সওয়াব পাবেন, না করলে গুনাহ নেই। শবে বরাতে নির্দিষ্ট কোন রাকায়াত নামাজ নেই। চাইলে শত রাকায়াত নফল নামাজ পড়তে পারেন।
হযরত আয়েশা (রা:) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা) নামাজে দঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সিজদা করলেন যে, আমার ধারণা হলো তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে জোরে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল; তিনি সিজদা থেকে উঠলেন, এবং নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, “ হে আয়েশা ! তোমার কি এ আশন্কা হয়েছে? আমি উত্তরে বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা) আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার আশন্কা হয়েছিল আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা? নবীজি (সা) বললেন তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুলই ভালো জানেন। তখন নবীজি (সা) বললেন, এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত । এ রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন, ক্ষমাপ্রার্থীদের ক্ষমা করে দেন, অন্রগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন । আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন।
এই রাতে গুরুত্বপূর্ণ আমল আল্লাহর দরবারে গুণাহর ক্ষমা চাওয়া। হালুয়া, রুটি, গোস্ত খেলে কোন সওয়াব নেই্। অন্যাদিন খেলে যে অবস্থা এইদিনও একই অবস্থা। আতশবাজি, ফটকাবাজি, লাইটিং এসব অপব্যয় ও অপচয়। কোরআন-হাদীসে এসবের ভিত্তি নেই। এসব কুসংস্কার হিসেবে প্রচলিত। গুণাহ হওয়ার আশংকা আছে। নবীর রিসালতের বিরোধী। নতুন আবিস্কারে দুনিয়ার ক্ষেত্রে গুণাহ নেই। কিন্তু ইবাদতের ক্ষেত্রে নতুন কিছু সংযোজনের সুযোগ নেই। নবী বলেছেন, “দিনে রোজা রাখ, রাতে ইবাদত কর” তাই করা উচিত সবার।
১৫ই শাবান আল্লাহ পাক মুসলিম উম্মাহর কেবলা পরিবর্তন করেন।মানুষের গুনাহ মাফ করেন।এই রাত থেকে সবার বার্ষিক বাজেট লিখা শুরু হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন শবে কদর রাতে তা ফেরেশেতাদের হাতে তুলে দেন। এরপর দায়িত্বপ্রাপ্ত ফেরেশতাগণ তা বন্টন করেন। আল্লাহ এক রাতের মধ্যে সারা বছরের ফয়সালা করেন। কে কি খাবে, কি আয় করবে, খরচ করবে, কে জন্ম নেবে, কার মৃত্যু হবে, ভাল আমল, মন্দ আমল, এবং রিজিক বন্টন সবই।
হযরত আয়েশা (রা:) ফরমান: নবীজি আমার ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন। ঘুম ভাঙ্গলে দেখি তিনি নেই। তখন নবীজিকে তালাশ কারার জন্য বের হই। অন্য বিবির ঘর, মসজিদে নববী কোথাও পেলাম না। যখন পেলাম তখন তিনি মদীনা শরীফের বিখ্যাত কবরস্থান জান্নাতুল বাকীতে মোনাজাতে ব্যস্ত। নবীজি জীবিত-মৃত সকল উম্মতের জন্য আল্লাহ পাকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। আয়েশা (রা:) আবার দ্রুত ঘরে ফিরলেন। নবীজি ঘরে ফিরে আয়েশা (রা:)-কে বললেন, তুমি কি আমার ব্যাপারে অন্য ধারণা করছ। আজ তোমার ঘরে থাকার পালা অন্য বিবির ঘরে যাবো? তখন আয়েশা (রা:)-বলেন, ইয়া রাসুল্লাহ আপানাকে না দেখে ঘর থেকে বের হয়েছিলাম। তখন নবী বলেন, আল্লার রাসুল কারো সাথে খেয়ানত করবে এটা হতে পারে না।
হযরত জিবরাঈল (আ:) আমাকে (নবীজি) বললেন, আজকের রাত হলো শাবানের মাঝের রাত। এই রাতে আল্লাহ বান্দা-বান্দিদের গড়ে ক্ষমা করবেন। এই কথা শোনার পর আমি ঘুম থেকে উঠে জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে মোনাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আরবের ‘বনিকান’ গোত্রের লোকেরা বেশি ছাগল পালত। এসব ছাগলের পশমের চাইতে বেশি সংখ্যক লোককে আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন। নবীজি বলেন, একথা শোনার পর আমি ক্ষমা চাইতে চলে যাই জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে। উম্মতের গুনাহর মাফ চাই।
ওইরাতে নবীজি কবরস্থানে গেছেন। কিন্তু সারাজীবনে মাত্র একবারই গেছেন। কাউকে বিষয়টি বলেননি। কাউকে সাথে নেননিও। কিন্তু প্রতিবছর কবরস্থানে যাওয়া, দলবলে যাওয়া, যত কবরস্থান আছে সবগুলোতে যাওয়া, এটা আনুষ্ঠানিকতা হয়ে গেছে। আনুষ্ঠানিকতা করেননি নবীজি। কোন সহীহ হাদিসের মধ্যে নেই সবাই একসাথে একত্রিত হয়ে কবরস্থানে গেছেন। সবাই মিলে একসাথে এবাদত করেছেন। অবশ্যই এই রাতের ফজিলত আছে, যে মাফ চাইবে তাকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন। যিনি চাইবেন না তাকেও ক্ষমা করবেন। শর্ত হলো: শিরিকমুক্ত ঈমান এবং হিংসামুক্ত অন্তর থাকতে হবে।
হজরত আলী (রা:) ফরমান: শাবানের মধ্যরাত্রিতে আল্লাহপাক রহমতের ভান্ডার নিয়ে নীচের আসমানে আসেন। আল্লার পক্ষ থেকে এ কথা ঘোষণা করা হয়: কেউ গুণাহ মাফ চাইলে বলো, আমি গুনাহ মাফ করে দেব। ভোর পর্যন্ত আল্লার এ ঘোষণা আসতে থাকে। রাতে এবাদত এবং পরদিন নফল রোজা রাখার কথা বলেছেন নবীজি।
আল্লাহপাক শবেবরাতের আমলগুলো করার সকলকে তৌফিক দান করুন। আমিন

লেখক: ব্যুরোচিফ, বাংলাভিশন, চট্টগ্রাম

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট