চট্টগ্রাম রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৫

সিডনির সৈকতে হামলার ঘটনা ও মুসলিমবিদ্বেষের রাজনীতি
ছবিতে (উপরে) অস্ট্রেলিয়ার বন্ডাই বিচে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদন করছেন জনতা। নিচের ছবিতে (বামে) হামলার পর দিগি দিক ছুটছেন বিচে অবস্থানকারী পর্যটকগণ, (ডানে) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ফুল ব্যবসায়ী আহমেদ আল আহমেদ, যিনি নিজের জীবন বাজি রেখে অসংখ্য পর্যটকের জীবন বাঁচিয়েছেন।

সিডনির সৈকতে হামলার ঘটনা ও মুসলিমবিদ্বেষের রাজনীতি

আবসার মাহফুজ

২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ | ৪:০৮ অপরাহ্ণ

বিশ্বের কোনো প্রান্তে যখনই একটি ভয়াবহ সহিংস ঘটনা ঘটে, তখন প্রথম যে অনুভূতিটি মানবসমাজকে গ্রাস করে, তা হলো শোক। বন্ডাই বিচের সেই রক্তাক্ত সন্ধ্যাও তার ব্যতিক্রম নয়। সিডনির সমুদ্রতটে নির্বিচার গুলিবর্ষণে ১৫টি প্রাণ নিভে যাওয়া কেবল অস্ট্রেলিয়ার জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই এক গভীর মানবিক বিপর্যয়। পরিবারগুলো চিরতরে বদলে গেছে, শিশুরা হারিয়েছে নিরাপত্তার অনুভূতি, একটি শহর স্তব্ধ হয়ে গেছে আতঙ্ক ও শোকে। এই শোকের বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই, এবং এই বেদনাকে সম্মান জানানোই যেকোনো আলোচনার প্রথম শর্ত হওয়া উচিত। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে শোক খুব কমই একা থাকতে পারে। শোকের শরীর জুড়ে দ্রæতই বসানো হয় রাজনৈতিক ভাষ্য, আদর্শিক ব্যাখ্যা এবং পরিচয়ভিত্তিক দোষারোপের ছাপ।

 

বন্ডাই বিচের হামলার ক্ষেত্রেও সেটিই ঘটেছে। তদন্ত তখনো অসম্পূর্ণ, হামলাকারীদের উদ্দেশ্য তখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়, অথচ কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে এক্সের মতো প্ল্যাটফর্ম, এক ধরনের অদ্ভুত নিশ্চয়তায় ভরে উঠেছে। সেই নিশ্চয়তার ভাষা ছিল একমুখী- এই সহিংসতার সঙ্গে ইসলাম, মুসলমান ও অভিবাসীদের যোগসূত্র রয়েছে। কোনো প্রমাণ ছাড়াই, কোনো নিশ্চিত তথ্য ছাড়াই, বহু গোষ্ঠী, বহু চক্র, ধরে নিয়েছে যে অপরাধীর পরিচয় জানার আগেই অপরাধের দায় মুসলমানদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া যায়। এটি কেবল একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয়; এটি একটি বহুদিনের চর্চার প্রতিফলন, যেখানে মুসলমানদের একটি স্থায়ী সন্দেহভাজন জনগোষ্ঠী হিসেবে কল্পনা করা হয়।

 

এই প্রবণতাটি নতুন নয়। ৯/১১-এর পর থেকে পাশ্চাত্য রাজনীতি ও গণমাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট ছক তৈরি হয়েছে, যেখানে সহিংসতার ব্যাখ্যা নির্ভর করে অপরাধীর পরিচয়ের ওপর। যদি হামলাকারী মুসলমান হন বা মুসলমান বলে মনে করা হয়, তবে সেটি দ্রুতই ‘ইসলামি সন্ত্রাসবাদ’, ‘সভ্যতার ওপর আঘাত’ কিংবা ‘পশ্চিমা মূল্যবোধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। তখন ধর্মীয় বিশ্বাস, অভিবাসন ইতিহাস এবং সমগ্র মুসলিমস¤প্রদায়কে প্রশ্নের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। কিন্তু হামলাকারী যদি মুসলমান না হন, তবে ভাষা বদলে যায়। তখন সেটি হয়ে ওঠে মানসিক স্বাস্থ্যের সংকট, ব্যক্তিগত বিচ্যুতি, কিংবা একটি দুঃখজনক ব্যতিক্রম। এই দ্বিমুখী মানদÐই বিশ্বব্যাপী মুসলিমবিদ্বেষের রাজনীতির ভিত্তি।

 

বন্ডাই বিচের ঘটনায় এই দ্বিচারিতা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। হামলার পরপরই এমন অসংখ্য ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে বড়দিন বা অন্য উৎসবের আতশবাজির ভিডিওকে ‘মুসলমানদের উদ্যাপন’ বলে চালানো হয়। বলা হয়, মুসলমানরা নাকি ইহুদিদের হত্যাকাণ্ডে আনন্দ করছে। এসব দাবি ছিল ভিত্তিহীন, অনেক ক্ষেত্রে হাস্যকরও। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদম সত্যকে নয়, বরং ক্ষোভকে পুরস্কৃত করে। ফলে এই মিথ্যাগুলো দ্রæত ছড়িয়ে পড়ে, এবং বহু মানুষের মনে স্থায়ী সন্দেহের বীজ বপন করে।

 

এই একই সময়ে একটি সত্য প্রায় নীরবে পড়ে থাকে- হামলাকারীকে থামাতে যিনি নিজের জীবন বাজি রেখেছিলেন, তিনি নিজেই একজন মুসলিম। ফল ব্যবসায়ী আহমেদ আল আহমেদ খালি হাতে একজন সশস্ত্র বন্দুকধারীর মুখোমুখি হন, রাইফেল কেড়ে নিতে যান এবং গুরুতরভাবে আহত হন। তাঁর এই তাৎক্ষণিক সাহসিকতা বহু মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে। এটি কোনো প্রতীকী সংহতি ছিল না, কোনো বিবৃতিমূলক নৈতিকতা ছিল না; এটি ছিল রক্ত-মাংসের সাহস, যেখানে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে বাঁচাতে নিজের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছেন।

 

কিন্তু এই বীরত্বের গল্পটি যতটা আলোচনায় আসার কথা ছিল, ততটা আসেনি। কারণ এটি একটি প্রতিষ্ঠিত বয়ানকে ভেঙে দেয়। এটি দেখিয়ে দেয় যে মুসলমান মানেই সন্দেহভাজন নয়, বরং মুসলমানরাও একই সমাজের অংশ, যারা সহিংসতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে, দাঁড়ায়ও। এই সত্যটি মুসলিমবিদ্বেষী রাজনীতির জন্য অস্বস্তিকর। তাই আহমেদের কাজকে ব্যতিক্রম হিসেবে দেখানো হয়, নিয়ম হিসেবে নয়। মুসলমানদের মানবিকতা প্রমাণ হিসেবে নয়, বরং ‘অপ্রত্যাশিত ঘটনা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

 

বিশ্বব্যাপী মুসলিমবিদ্বেষ টিকে থাকে এই ধরনের বাছাই করা স্মৃতির ওপর। এখানে প্রমাণের চেয়ে ভয় বেশি কার্যকর, যুক্তির চেয়ে পুনরাবৃত্তি বেশি শক্তিশালী। রাজনৈতিক ভাষ্যে মুসলমানদের প্রায়শই একটি সমজাতীয় গোষ্ঠী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যেন তারা সবাই একইভাবে চিন্তা করে, একইভাবে কাজ করে। এই সরলীকরণই ঘৃণার রাজনীতির সবচেয়ে বড় অস্ত্র। এটি মানুষকে আর ব্যক্তি হিসেবে দেখে না; দেখে একটি বিমূর্ত ‘হুমকি’ হিসেবে।

 

চরম ডানপন্থী শক্তিগুলো এই বাস্তবতা খুব ভালোভাবেই বোঝে। প্রতিটি সহিংস ঘটনার পর তারা নিরাপত্তা, জাতীয় পরিচয় ও সাংস্কৃতিক বিশুদ্ধতার বুলি আওড়ে পুরোনো এজেন্ডা সামনে আনে। নজরদারি বাড়ানোর দাবি ওঠে, অভিবাসন নীতি কঠোর করার কথা বলা হয়, ধর্মীয় প্রকাশকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। এই প্রক্রিয়ায় মুসলমানরা হয়ে ওঠে ‘লক্ষবস্তু’। যে অপরাধ তারা করেনি, তার জন্যও তাদের কাছ থেকে আনুগত্যের প্রমাণ চাওয়া হয়, নিন্দার বিবৃতি প্রত্যাশা করা হয়, এবং নিজেদের নির্দোষ প্রমাণের ভার চাপিয়ে দেওয়া হয়।

 

তবে, এর ফলাফল কেবল মুসলমানদের জন্য ক্ষতিকর নয়; এটি পুরো সমাজের জন্য বিপজ্জনক। যখন সহিংসতাকে পরিচয়ের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা হয়, তখন আমরা সহিংসতার প্রকৃত কারণগুলো বুঝতে ব্যর্থ হই। বাস্তবতা হলো, পাশ্চাত্য সমাজে সংঘটিত অধিকাংশ সহিংস অপরাধ ধর্মীয় আদর্শ দ্বারা পরিচালিত নয়। বন্দুকের সহজলভ্যতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের সংকট- এসব বিষয়কে আড়াল করে দেওয়া হয়, কারণ পরিচয়ভিত্তিক দোষারোপ রাজনৈতিকভাবে বেশি সুবিধাজনক।

 

কিন্তু এই রাজনীতি সমাজে বিভাজনকে আরও গভীর করে। যখন একটি স¤প্রদায়কে স্থায়ীভাবে সন্দেহের চোখে দেখা হয়, তখন পারস্পরিক আস্থা ভেঙে পড়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা দুর্বল হয়, সামাজিক সংহতি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এর পরিণতিতে সহিংসতার ঝুঁকি কমে না; বরং বাড়ে। কারণ বিচ্ছিন্নতা ও বঞ্চনাই চরমপন্থার সবচেয়ে উর্বর জমি।

 

বন্ডাই বিচের ট্র্যাজেডি আমাদের একটি সুযোগ দিয়েছিল- দোষারোপের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে মানবিকতার ভাষায় ফিরে যাওয়ার। আহমেদ আল আহমেদের মতো মানুষের গল্প সেই সুযোগ তৈরি করেছিল। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখেছি, সেই সুযোগটি বড় অংশে হাতছাড়া হয়েছে। বরং এই ট্র্যাজেডিকে ব্যবহার করে পুরোনো ভয়গুলোকে নতুন করে জাগিয়ে তোলা হয়েছে।

 

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে একই চিত্র বারবার দেখা যায়। ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়া- যেখানেই সহিংসতা ঘটে, সেখানেই মুসলমানদের একটি পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়। তারা যথেষ্ট নিন্দা করেছে কি না, তারা যথেষ্ট দেশপ্রেম দেখিয়েছে কি না- এই প্রশ্নগুলো তাদের ঘাড়ে চেপে বসে। অথচ অন্য কোনো ধর্ম বা গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এমন সম্মিলিত দায় চাপানো হয় না।

 

এই বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একটি উদার সমাজের ভিত্তি হলো ব্যক্তিগত দায় ও ন্যায়বিচার। সেখানে কেউ তার কাজের জন্য দায়ী হবে, তার পরিচয়ের জন্য নয়। মুসলিমবিদ্বেষের রাজনীতি এই মৌলিক নীতিকে অস্বীকার করে।

 

আমরা মনে করি, বন্ডাই বিচের রক্তপাত গভীর শ্রদ্ধা ও সংবেদনশীলতার সঙ্গে স্মরণ করার বিষয়। এটি কোনো আদর্শিক যুদ্ধের হাতিয়ার হওয়া উচিত নয়। যারা নিহত হয়েছেন, তারা কোনো রাজনৈতিক তর্কের অংশ ছিলেন না; তারা ছিলেন মানুষ, পরিবার, স্বপ্ন। তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখানোর অর্থ হলো এমন একটি সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা করা, যেখানে শোককে ঘৃণায় রূপান্তরিত করা হয় না।

 

আহমেদ আল আহমেদের মতো মানুষরা এই সমাজের নীরব ভিত্তি। তারা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে মানবতা কোনো একক ধর্ম, জাতি বা পরিচয়ের সম্পত্তি নয়। কিন্তু এই স্মরণ তখনই অর্থবহ হবে, যখন আমরা মুসলিমবিদ্বেষের রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করতে সাহস করব।

 

যত দিন পর্যন্ত বিশ্ব সহিংসতার মুখোমুখি হওয়ার সময় পরিচয়ের সহজ উত্তর বেছে নেবে, তত দিন এই ট্র্যাজেডিগুলো কেবল অপরাধীদেরই নয়, বরং ঘৃণার রাজনীতির কারিগরদেরও উপকার করে যাবে। বন্ডাই বিচ আমাদের সামনে সেই কঠিন প্রশ্নটি আবারও রেখে গেছে- আমরা কি শোক থেকে শিক্ষা নেব, নাকি শোককে ব্যবহার করে ঘৃণার পুরোনো গল্পই নতুন করে বলব।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট