
রমজানের আগমনী বার্তা দিয়ে শুরু হলো মহান রব্বুল আলামিন ঘোষিত চারটি সম্মানিত মাসের অন্যতম রজব। হিজরি মাসগুলোর মধ্যে একটি বিশেষ ও মহিমান্বিত সপ্তম মাসের নাম রজব। ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অলৌকিক ঘটনা ইসরা ও মিরাজ সংঘটিত হয় এ মাসে। মর্যাদার এ মাসটি মুমিন মুসলমানের ইবাদতের মাস। বরকত লাভের মাস। আল্লাহর রসুল সা. রজব থেকেই শুরু করতেন রমজানের প্রস্তুতি। এ মাস শুরু হলে তিনি এই দোয়া পড়তেন, ‘আল্লাহুম্মা বারিকলানা ফি রাজাবা ও ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগনা রমাদান।’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আমাদের জন্য রজব ও শাবান মাসকে বরকতময় করে দিন। আর আমাদের রমজান মাস পর্যন্ত পৌঁছে দিন।’ (নাসায়ি: ৬৫৯; মুসনাদে আহমাদ: ২৩৪৬)।
ইসলাম আগমনের পর বছরের ১২ মাসের মধ্য থেকে রজবসহ ৪ মাসকে ‘আশহুরে হুরুম’ সম্মানিত মাস ঘোষণা করা হয়। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন হতেই আল্লাহ্ র বিধানে আল্লাহ্ র নিকট মাস গণনায় মাস বারটি; তন্মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস, এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম কর না।’ ( সুরা তাওবা, আয়াত-৩৬)। মর্যাদার এ মাসটিকে মহান আল্লাহ তাআলা যাবতীয় যুদ্ধবিগ্রহ, হানাহানি ও রক্তপাত নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। জাহেলিয়ার যুগে আরবরা এ মাসকে অন্য মাসের তুলনায় অধিক সম্মান করতেন। এ মাসের মর্যাদা ও পবিত্রতা রক্ষায় তারা নিত্য চলমান হানাহানি, মারামারি ও যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ করে দিত। এজন্য তারা এ মাসের নাম রেখেছিল ‘রজব’। রসুল সা. ,বলেছেন, ‘রজব হলো আল্লাহর মাস, শাবান হলো আমার মাস; রমজান হলো আমার উম্মতের মাস।’ (তিরমিজি)।
রজব মাসের পুরো নাম ‘রজবুল মুরাজ্জাব’ বা ‘আর-রজব আল-মুরাজ্জাব’ হলেও এটি রজব মাস নামেই বেশি পরিচিত। মাসটির অর্থগত তাৎপর্যও রয়েছে। ‘রজব’ শব্দের অর্থ হলো সম্ভ্রান্ত, মহান, সুবিশাল বা প্রাচুর্যময়। আর ‘মুরাজ্জাব’ অর্থ ‘সম্মানিত’। সুতরাং এর অর্থ দাঁড়ায় ‘প্রাচুর্যময় সম্মানিত মাস’।
রসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘১২ মাসে এক বছর। তার মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি ধারাবাহিক জিলকদ, জিলহজ, মহররম এবং চতুর্থটি হলো রজব, যা জমাদিউস সানি ও শাবান মাসের মধ্যবর্তী মাস।’ (বুখারি: ২/৬৭২)।
হজরত উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাস ছাড়া সবচেয়ে বেশি রোজা পালন করতেন শাবান মাসে, অতঃপর রজব মাসে।’ হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘যখন রজব মাস আসত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলের আধিক্যতা দেখেই আমরা তা বুঝতে পারতাম।’কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, রসুলুল্লাহ সা. রজব মাসে ১০টি রোজা রাখতেন, শাবান মাসে ২০টি রোজা রাখতেন, রমজান মাসে ৩০টি রোজা রাখতেন। (দারিমি)।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) ও হজরত কাতাদা (রহ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে— ‘এ মাসগুলোতে আমল করলে অন্যান্য মাসের তুলনায় অধিক সওয়াব লাভ হয় এবং এ মাসগুলোতে কোনো গুনাহের কাজ করলে অন্য মাসের তুলনায় অধিক গুনাহ হয়।’ (তাফসিরে তাবারি : ৬/১৪৯-১৫০)।
সম্মানিত চারটি মাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে হজরত আবু বকর জাসসাস (রহ.) বলেন, ‘এসব মাসে ইবাদতের প্রতি যত্নবান হলে বাকি মাসগুলোতে ইবাদত করা সহজ হয় এবং এ মাসগুলোতে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকলে অন্য মাসেও গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা সহজ হয়।’ (আহকামুল কোরআন: ৩/১৬৩)। হাদিসে রজবের আরো একটি আমলের কথা বর্ণিত হয়েছে। এ সময় অধিক পরিমাণে দোয়া করা। নিজের জন্য, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা। রজবের প্রথম রাতে মহান আল্লাহ বান্দার দোয়া কবুল করেন। হাদিসে রজবের প্রথম রাতে দোয়া কবুলের সুসংবাদ এসেছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত—তিনি বলেন, ‘পাঁচটি রাত এমন রয়েছে, যে রাতে বান্দার দোয়া আল্লাহ ফিরিয়ে দেন না। রাতগুলো হলো—জুমার রাত, রজব মাসের প্রথম রাত, শাবানের ১৫ তারিখের রাত, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার রাত।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৭৯২৭)
ঐতিহাসিক পটভূমি : ইসলামের কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে রজব মাসের যোগসূত্র ও সম্পৃক্ততা রয়েছে।
ইসরা ও মিরাজ : নবুয়তের ১১তম বছরে রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়— ইসরা ও মিরাজ। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর নির্দেশে রাত্রিকালে মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস এবং সেখান থেকে সপ্ত আসমান পাড়ি দিয়ে সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছান। এই সফরে তিনি জান্নাত ও জাহান্নামের দৃশ্য দেখেন এবং আল্লাহর দিদার লাভ করেন। এই সফরের মাধ্যমেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মুসলমানদের ওপর ফরজ করা হয়। এছাড়া রসুল (স.)-এর কাছে সর্বপ্রথম ওহি নাজিল হয় এমাসে।
নুহ আ.-এর জাতিকে ধ্বংস : এ মাসে হযরত নুহ (আ.)-এর জাতিকে আল্লাহ মহাপ্লাবনের মাধ্যমে ধ্বংস করেছেন। আর নুহ (আ.)-কে তার নির্মিত বিশাল জাহাজের মাধ্যমে রক্ষা করেছেন। তাফসিরে তাবারি ও বগভিতে আছে, নুহ (আ.) রজবের ১০ তারিখে কিস্তিতে আরোহণ করেছিলেন। দীর্ঘ ছয় মাস পর্যন্ত ওই কিস্তি তুফানের মধ্যেই চলছিল। পরিশেষে ১০ মুহররম আশুরার দিন ইরাকের জুদি পর্বতে জাহাজটি অবতরণ করে। (মাআরেফুল কোরআন, পৃষ্ঠা: ৬৩২)
মসজিদুল আকসা পুনরুদ্ধার : হিজরি ৫৮৩ সনের রজব মাস মোতাবেক খ্রিস্টীয় ১১৮৭ সনের অক্টোবরে সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের হাত থেকে জেরুজালেম ও মুসলমানদের প্রথম কেবলা মাসজিদুল আকসা পুনরুদ্ধার করেন। ১০৯৯ সনে ক্রুসেডারদের হাতে জেরুজালেম পতনের দীর্ঘ ৮৮ বছর পর মাসজিদুল আকসা পুনরায় মুসলমানদের হাতে আসে।
তাবুক যুদ্ধ : সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রকে ধ্বংসের জন্য বাইজান্তাইন (রোমান) সেনাবাহিনীর মদীনা আক্রমণের সংবাদ পেয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) রজব মাসেই রোমান বাহিনীকে প্রতিরোধের জন্য তাবুকে গিয়ে যুদ্ধ করার আহবান জানান। খ্রিস্টীয় ৬৩০ সনের অক্টোবরে এবং হিজরি ৯ সনে রাসূলুল্লাহ (সা.) রোমান বাহিনীকে মোকাবেলার জন্য তাবুক অভিযানে বের হন।
প্রথম হিজরত : হিজরি পঞ্চম বর্ষের রজব মাসেই মুসলমানরা ‘হাবশা’র (বর্তমান ইরিত্রিয়া) উদ্দেশ্যে প্রথম হিজরত করেন। (উয়ুনুল আছর: ১/১৫২)।
এছাড়া রাসুল (সা.) হাবশার নীতিবান বাদশাহ ও মুসলমানদের সহযোগী নাজ্জাসির মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করেছিলেন। সেদিন তিনি ইসলামের ইতিহাসে একমাত্র গায়েবি জানাজা পড়েছিলেন।’ (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৫/৩৯)। ১৪ হিজরিতে রজব মাসে মুসলমানরা সিরিয়ার রাজধানী বিজয় করে। ১৫ হিজরির রজব মাসে ইয়ারমুকের মর্মান্তিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৪)
আমল : রাসুলুল্লাহ সা. রজব মাস জুড়ে অত্যাধিক আমল-ইবাদত করতেন, রোজা রাখতেন। দোয়া পড়তেন। রমজানের জন্য নিজেকে তৈরি করতে, নিজের মন-মানসিকতাকে পরিচ্ছন্ন করতে এ মাসে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগি করতেন। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় তা ওঠে এসেছে– প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি রজব মাসে (ইবাদত দ্বারা) জমি চাষাবাদ করল না আর শাবান মাসে (ইবাদতের মাধ্যমে) জমি আগাছামুক্ত করল না; সে রমজান মাসে (ইবাদতের) ফসল তুলতে পারবে না।’ (বায়হাকি)
রজব মাসের বিশেষ আমলসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো ফরজ ইবাদতের পাশাপাশি বেশি বেশি নফল রোজা পালন ও নফল নামাজ আদায় করা। তসবিহ-তাহলিল, ইস্তেগফার, দরুদসহ মুনাজাত করা । এছাড়া দান-সাদাকা করা।
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, রজব মাসের মর্যাদা, ফজিলত ও আমলের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখা। হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করা। রমজানের পরিপূর্ণ ইবাদতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাংবাদিক
পূর্বকোণ/ইবনুর