চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৫

বাংলাদেশে জাদুঘর চর্চা ও রাউজানে আবদুল হক চৌধুরী স্মৃতিকেন্দ্র: সম্ভাবনা ও করণীয়

বাংলাদেশে জাদুঘর চর্চা ও রাউজানে আবদুল হক চৌধুরী স্মৃতিকেন্দ্র: সম্ভাবনা ও করণীয়

ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন

২৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ | ১১:০৬ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ইতিহাস শুরু হয় ১৯১০ সালে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে বরেন্দ্র জাদুঘর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, যা ছিল তৎকালীন পূর্ব বাংলার প্রথম জাদুঘর। এরপর ১৯১৩ সালে ঢাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ১৯২৩ সালে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে এটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পরিচালিত অসংখ্য জাদুঘর রয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, আহসান মঞ্জিল জাদুঘর ও বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

 

এই ধারাবাহিকতায় সরকার দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা গুণী ব্যক্তিদের স্মরণে স্মৃতিকেন্দ্র ও সংগ্রহশালা নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ লক্ষ্যে চট্টগ্রামসহ তিনটি জেলায় তিনজন বরেণ্য ব্যক্তির স্মৃতিকেন্দ্র ও সংগ্রহশালা স্থাপনের জন্য প্রায় ৭ কোটি ৯৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এই প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াজিশপুর গ্রামে গবেষক ও ইতিহাসবিদ আবদুল হক চৌধুরী স্মৃতিকেন্দ্র ও সংগ্রহশালা নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

 

গবেষক আবদুল হক চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর পুত্র ড. মনজুর-উল-আমিন চৌধুরী ‘আবদুল হক স্মৃতিকেন্দ্র’ নির্মাণের জন্য ২৬ শতক জমি দান করেন। প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জুলাই মাসে শুরু হয়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হয়নি।

 

বর্তমানে কোটি টাকার ব্যয়ে নির্মিতব্য দুইতলা ভবনটি অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে আছে। ভবনের চারপাশের সীমানা প্রাচীর লতাপাতা ও আগাছায় ঢেকে গেছে, গেটে ঝুলছে মরিচা ধরা তালা, ভেতরের অংশও পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। অথচ ভবন নির্মাণ শেষ হলে দ্বিতীয় ধাপে এখানে একটি পূর্ণাঙ্গ জাদুঘর স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল।

 

সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এই স্মৃতিকেন্দ্রটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের শাখা জাদুঘর হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। গবেষণায় অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১১ সালে মরণোত্তর একুশে পদকপ্রাপ্ত চট্টলতত্ত¡বিদ, গবেষক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হক চৌধুরীর স্মরণে গঠিত এই স্মৃতিকেন্দ্রটি বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের অষ্টম শাখা জাদুঘর হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সচিব ও বাংলাদেশ সরকারের যুগ্মসচিব গাজী মো. ওয়ালি-উল-হক স্বাক্ষরিত পত্রের মাধ্যমে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে।

 

চট্টগ্রামে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জাদুঘর রয়েছে। এর মধ্যে জিয়া স্মৃতি জাদুঘর চট্টগ্রাম নগরীর পুরনো সার্কিট হাউস ভবনে অবস্থিত, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় স্থাপত্যরীতির একটি অনন্য নিদর্শন। ১৯১৩ সালে নির্মিত এই ভবনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্মৃতি, ব্যক্তিগত ব্যবহার্য সামগ্রী এবং মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে অবস্থিত জাতি-তাত্তি¡ক জাদুঘর দেশের একমাত্র নৃতাত্তি¡ক জাদুঘর, যেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জীবনধারা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস উপস্থাপিত হয়। এছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর বাংলাদেশের একমাত্র শিক্ষায়াতনিক জাদুঘর, যা মানব ইতিহাস, শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আবদুল হক চৌধুরী স্মৃতিকেন্দ্র ভবন নির্মিত হলেও সেখানে এখনো জাদুঘরভিত্তিক কোনো দৃশ্যমান কার্যক্রম শুরু হয়নি। এই গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানটিকে কার্যকর ও প্রাণবন্ত করে তুলতে হলে স্থানীয় পর্যায়ে একটি শক্তিশালী সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

 

আমার প্রস্তাব হলো- স্থানীয় শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, সমাজসেবক ও অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি পরিচালনা ও পরামর্শক কমিটি গঠন করা। এই কমিটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে স্মৃতিকেন্দ্রটিকে একটি আধুনিক ও কার্যকর জাদুঘর হিসেবে পরিচালনা করতে পারবে। এখানে শুধু আবদুল হক চৌধুরীর ব্যক্তিগত ব্যবহার্য সামগ্রী, প্রকাশিত গ্রন্থ ও গবেষণা প্রদর্শনের মধ্যেই জাদুঘরের পরিসর সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। বরং রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী ও ফটিকছড়িসহ সমগ্র চট্টগ্রাম অঞ্চল এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন, দলিল ও উপকরণ সংগ্রহ ও প্রদর্শনের মাধ্যমে এটিকে একটি আঞ্চলিক ইতিহাসভিত্তিক জাদুঘরে রূপ দেওয়া যেতে পারে।

 

জাদুঘরটিকে প্রাণবন্ত ও সচল রাখার জন্য একটি বাস্তবসম্মত উদ্যোগ হতে পারে রাউজান উপজেলার সকল স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়মিত ‘জাদুঘর পরিদর্শন কর্মসূচি’ চালু করা। রাউজান উপজেলায় তিনটি স্নাতক কলেজ, তিনটি উচ্চমাধ্যমিক কলেজ, চারটি স্কুল ও কলেজ, দুটি কামিল মাদ্রাসা, চারটি ফাজিল মাদ্রাসা, চারটি আলিম মাদ্রাসা, ১২টি দাখিল মাদ্রাসা, পাঁচটি এমপিওভুক্ত দাখিল মাদ্রাসা, ৪৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, তিনটি বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, নয়টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ১৭৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কমিউনিটি স্কুল ও কিন্ডারগার্টেন রয়েছে। উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে সমন্বয়ক করে এসব স্কুলের শিক্ষার্থীদের পর্যায়ক্রমে জাদুঘর পরিদর্শনের একটি বার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে।

 

এ ধরনের কর্মসূচি সারাবছর চলমান থাকলে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ের বাইরের জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পাবে, তাদের চিন্তাশক্তি ও সৃজনশীলতা বিকশিত হবে। পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের জন্যও অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি হবেÍযেমন ক্যান্টিন পরিচালনা, পরিবহন ব্যবস্থা, স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসা ইত্যাদি। এই কর্মসূচির অর্থায়ন যৌথভাবে করা যেতে পারে, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নামমাত্র অংশগ্রহণ ফি, সরকারি অনুদান এবং স্থানীয় ব্যবসায়ী ও দানশীল ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে। নিয়মিত দর্শনার্থী এলে জাদুঘরের কর্মীরাও উৎসাহিত ও দক্ষ হয়ে উঠবেন। শিক্ষার্থীরা জাদুঘর ও আশপাশের এলাকা নিয়ে প্রতিবেদন, ডায়েরি বা জার্নাল লেখার সুযোগ পাবে, যা তাদের জন্য একটি ‘আউট অব দ্য বক্স’ শিক্ষানুভূতি তৈরি করবে। তবে এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের আগে অবশ্যই একজন যোগ্য কিউরেটর এবং একজন শিক্ষা কার্যক্রম কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া জরুরি। রাউজান উপজেলা শিক্ষা অফিস, স্কুলের প্রধান শিক্ষকবৃন্দ ও জাদুঘর কর্তৃপক্ষের মধ্যে একটি যৌথ সভার মাধ্যমে এই পরিকল্পনার রূপরেখা নির্ধারণ করা যেতে পারে।

 

সবশেষে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, একটি সরকারি পরিচালনা কাঠামোর অধীনে, যেখানে স্থানীয় শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী ও জাদুঘর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অন্তর্ভুক্ত থাকবেন, সেই ব্যবস্থাপনাই এই স্মৃতিকেন্দ্রকে টেকসই ও কার্যকর করতে পারে। অন্যথায় এই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাটি কেবল একটি পরিত্যক্ত ভবন বা ‘হোয়াইট এলিফ্যান্ট’-এ পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে।

 

লেখক: রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, সেইন্ট জন রিজিওনাল হসপিটাল, নিউ ব্রুান্সউইক। এসিস্টেন্ট প্রফেসর, ডালহাউসী ইউনিভার্সিটি, কানাডা।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন