
পাকিস্তান কোন পথে হাঁটছে?- এই প্রশ্নটি আজ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বহুল আলোচিত। এ প্রশ্নের উত্তর আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, পাকিস্তানের ভেতরকার মানুষের কাছে তার চেয়েও বেশি জরুরি। কারণ দেশটি যে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছে, যে সাংবিধানিক পরিবর্তনের ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হয়েছে, যে সামরিক-বেসামরিক ভারসাম্য ভেঙে পড়েছে এবং যে ধরনের ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটছে, তা পাকিস্তানকে গণতন্ত্রের পথ থেকে ক্রমশ দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দেশটির অতীত ইতিহাসে সামরিক প্রতিষ্ঠানের শক্তি নতুন কোনো বাস্তবতা নয়; কিন্তু যে মাত্রায় এই শক্তি এখন সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক পরিকাঠামোর কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে, তা পাকিস্তানকে এক নতুন বাস্তবতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে- যেখানে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা থাকবে, রাজনৈতিক দল থাকবে, সংসদ নামের একটি প্রতিষ্ঠান থাকবে, কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ ও সিদ্ধান্ত নির্ধারণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে সেনাবাহিনী এবং তার প্রধান।
গত দুই বছরের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে যে চিত্রটি স্পষ্ট হয়, তা হলো পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিটি হাতলে আগের চেয়ে আরও দৃঢ়ভাবে দখল প্রতিষ্ঠা করেছে সামরিক বাহিনী। ইমরান খানের পতন, তাঁকে কারারুদ্ধ করে রাখা, আদালত থেকে শুরু করে গণমাধ্যম পর্যন্ত কঠোর নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক দলগুলোর বিভাজন, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা- এসবই ছিল বড় একটি প্রস্তুতি। কিন্তু ২০২৫ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগে এসে পাকিস্তানের ২৭তম সাংবিধানিক সংশোধনী ও সামরিক নেতৃত্বের চমকপ্রদ উত্থান দেখিয়ে দিয়েছে, পাকিস্তান এখন এমন একটি কাঠামো গড়ে তুলছে, যেখানে সেনাবাহিনী শুধু প্রভাবশালী নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সর্বোচ্চ ক্ষমতার কেন্দ্র।
পাকিস্তানের ২৭তম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগকে কার্যত নির্বাহী বিভাগের অধীনস্থ করে ফেলা হয়েছে। বিচারব্যবস্থ- যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ন্যূনতম নিরাপত্তাকবচ, এখন সরকারের দ্বারা নিযুক্ত বিচারকদের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত নামে একটি নতুন কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক এখতিয়ার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিচারকদের ইচ্ছাবিরোধী স্থানান্তর এবং সাংবিধানিক মামলায় সরকারের পছন্দসই বেঞ্চ গঠন কার্যত একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থার মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। এই পরিবর্তনগুলোর মধ্যদিয়ে পাকিস্তানে সরকার-নির্বাহী বিভাগকে শক্তিশালী করা হয়নি; বরং ক্ষমতা আরও বেশি করে কেন্দ্রীভূত হয়েছে সামরিক প্রতিষ্ঠানের হাতে।
কারণ পাকিস্তানে সংসদকে আগেই বলা হতো ‘রাবার স্ট্যাম্প’। আইন পাসের ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকার আড়ালে আসলে ছিল সামরিক বাহিনীর ইচ্ছা। এবার সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে সামরিক শক্তিকে শুধু পর্দার আড়ালের খেলোয়াড় নয়, বরং আনুষ্ঠানিক কাঠামোর অংশীদার করে দেওয়া হয়েছে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস’ নামে নতুন একটি পদের সৃষ্টি, যা কার্যত সমগ্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে। আগে যে পদটি পর্যায়ক্রমে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী ভাগাভাগি করে নিত, এখন সেটি শুধুই সেনাবাহিনীর অধিকারভুক্ত হলো। এর পাশাপাশি ফিল্ড মার্শালসহ তিনবাহিনীর সর্বোচ্চ পদে থাকা কর্মকর্তাদের আজীবন দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে- যা তাঁদের ওপর কোনো ধরনের বিচার বা জবাবদিহিকে কার্যত অসার করে দেয়।
এই পরিবর্তনগুলোর সবকিছুর কেন্দ্রে আছেন ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। তাঁর ক্ষমতার বিস্তার এমন এক গতিতে ঘটছে, যা পাকিস্তানের ইতিহাসে নজিরবিহীন। কয়েক বছরের মধ্যে জেনারেল থেকে ফিল্ড মার্শাল, সেখান থেকে চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস- এমন দ্রæত উত্থান সাধারণ কোনো সামরিক উন্নয়ন নয়। এটি রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার এক সুপরিকল্পিত কৌশল। এ জন্য প্রয়োজন ছিল সাংবিধানিক পরিবর্তন, বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দুর্বল রাখা এবং নির্বাচনী কাঠামোকে এমনভাবে সাজানো, যাতে সামরিক পছন্দের দলই ক্ষমতায় থাকে। শাহবাজ শরিফ ও বিলাওয়াল ভুট্টো-নেতৃত্বাধীন জোট সরকার সেই বাস্তবতাকে অনুমোদন দিয়েছে এবং একইসঙ্গে নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার বিনিময়ে সামরিক প্রতিষ্ঠানের অধীনস্থ হয়ে থাকতে রাজি হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তানের এই কাঠামো এখন শুধু ‘মিলিটারি ডমিনেশন’ নয়, বরং ‘মিলিটারি-সেন্টার্ড স্টেট’। অর্থাৎ পাকিস্তানের বেসামরিক নেতৃত্বের রাষ্ট্র চালানোর ক্ষমতা আছে মাত্র সেই জায়গাগুলোতে, যেগুলো সামরিক প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, এমনকি নির্বাচনী প্রক্রিয়াও সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন। পাকিস্তানের নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর যে দমন-পীড়ন চলছে, তা কেবল রাজনৈতিক প্রশ্ন নয়; বরং বৃহত্তর নিরাপত্তা, রাষ্ট্রের এক ক্ষতিকর রূপ।
ইমরান খানের কারাবাস, তাঁর দলকে ভেঙে নতুন পো-এস্ট্যাব্লিশমেন্ট দল তৈরির প্রক্রিয়া, ইলেক্টোরাল রিফর্ম কমিশনের মাধ্যমে নির্বাচনকে সামরিক অভিপ্রায়ের দিকে নিয়ে যাওয়া, এসবই আসিম মুনিরকে শক্তির চূড়ান্ত কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত করার অংশ। পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোকে এমনভাবে বিভক্ত করে দেওয়া হয়েছে, যাতে কোনো দলই সামরিক বাহিনীর মোকাবিলা করতে না পারে। ফলে সাংবিধানিকভাবে যে ক্ষমতার পৃথকীকরণ থাকার কথা ছিল, তা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে একটি কেন্দ্র-নির্ভর ক্ষমতা কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
একইসঙ্গে এই ক্ষমতাকেন্দ্রীকরণের আরেক বৈশিষ্ট্য হলো আন্তর্জাতিক শক্তির সমর্থন। যুক্তরাষ্ট্র, উপসাগরীয় দেশগুলো এবং চীন- পাকিস্তানের তিনটি প্রধান বাহ্যিক শক্তি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ভাঙতে আগ্রহী নয়। পাকিস্তানের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অর্থনীতি সংকটগ্রস্ত হওয়া, সন্ত্রাসবাদ নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা- এসব কারণে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো একটি ‘নিয়ন্ত্রিত স্থিতিশীলতা’ পছন্দ করছে। সেই নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রে আছেন আসিম মুনির। ফলে তাঁর ক্ষমতা ঘিরে অভ্যন্তরীণ সমর্থনের পাশাপাশি একটি বহিঃসমর্থনও তৈরি হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, পাকিস্তান কি এই পথেই অনির্দিষ্টকালের জন্য চলবে? ইতিহাস বলে পাকিস্তানে সামরিক শাসন কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, কিন্তু এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হয়েছে। সামরিক কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করা রাজনৈতিক শক্তি বারবার উঠে এসেছে, গণতন্ত্রের পথে ফিরে যাওয়ার আন্দোলনও হয়েছে। কিন্তু এবার যে কাঠামো তৈরি হয়েছে, তা অতীতের সামরিক শাসনের চেয়ে আরও গভীর ও প্রাতিষ্ঠানিক। কারণ এবার শুধু সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা বাড়ানো হয়নি, বরং সংবিধানকে সেই ক্ষমতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে পরিবর্তন করা হয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি স্তরে সামরিক প্রভাব সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
পাকিস্তানের জনগণের বিরোধিতা কি একসময় এই কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে? রাজনৈতিক দলগুলো কি আবার সংগঠিত হয়ে সামরিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে? এসব প্রশ্নের উত্তর এখনই স্পষ্ট নয়। তবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকট, মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, জ্বালানি-সংকট এবং বৈদেশিক ঋণের চাপ এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে, যেখানে সামরিক শাসনের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ক্রমেই কমছে। জনগণ হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে সংগঠিত হতে পারছে না, কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সংকটের যুগল আগুন পাকিস্তানকে একসময় নতুন উত্তাল পরিস্থিতিতে ঠেলে দেবে- এটা অনুমান করা কঠিন নয়।
সবশেষে বলা যায়, পাকিস্তান আজ যে পথে হাঁটছে, তা গণতন্ত্রের নয়, আইনের শাসনের নয়, জনগণের ইচ্ছার নয়। এটি একটি সামরিকীকৃত রাষ্ট্রব্যবস্থার পথ, যেখানে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকবে সেনাবাহিনী, প্রতীকি নেতৃত্বে থাকবে বেসামরিক রাজনীতিবিদরা এবং জনগণ থাকবে নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে। পাকিস্তান কোন দিকে যাচ্ছে, তার উত্তর তাই একটাই– রাষ্ট্রটি দ্রুত এমন এক কাঠামোর দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যেখানে গণতন্ত্র কেবল একটি আনুষ্ঠানিক শব্দ, কিন্তু বাস্তব ক্ষমতার মালিক ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন সামরিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আলোর পথ থেকে অন্ধকার পথে যাত্রার এমন প্রক্রিয়া আখেরে দেশটির জন্য মঙ্গলকর হবে না।
পূর্বকোণ/ইবনুর