
বন্দরনগরী চট্টগ্রাম এবং রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বেশির ভাগ নগর-মহানগর, শহর-মহাশহর এখন রাজনৈতিক প্রচারণার পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুনে প্রায় আচ্ছন্ন। সড়কের আইল্যান্ড থেকে ফুটপাতের দেয়াল, স্কুল-কলেজের প্রবেশদ্বার থেকে শুরু করে বাসস্টপ, ওভারব্রিজ, এমনকি মেট্রোরেলের পিলার এবং এক্সপ্রেসওয়েও বাদ নেই। নির্বাচনী আচরণবিধি ও সিইসির সাম্প্রতিক অনুরোধ সত্ত্বেও দৃষ্টিকটু ওই দৃশ্য অব্যাহত। সিইসির অনুরোধের প্রায় অর্ধমাস পেরিয়ে গেলেও রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্যোগে পোস্টার সরানোর কার্যক্রম চোখে পড়ছে না। শহরের বাতাসে উড়তে থাকা কাগজের টুকরো, বৃষ্টিতে ভিজে ছেঁড়া পোস্টারের অবশিষ্টাংশ, বিদ্যুৎ ও টেলিফোন লাইনে ঝুলতে থাকা রঙিন ব্যানার- সব মিলে নগরের মুখ দেখতে যেন ক্লান্ত লাগে। জার্মান দার্শনিক আর্থার শোপনহাউয়ার (Arthur Schopenhauer) বলেছিলেন, ‘A man is civilized to the degree that he can obey his own conscience’. কিন্তু আমরা কি সেই বোধে পৌঁছেছি? আইন আছে, দণ্ড আছে, নির্দেশ আছে, কিন্তু নাগরিক বিবেবোধ ও দলীয় শৃঙ্খলা কি ততটাই জীবন্ত?
দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২ স্পষ্ট করে বলেছে, নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া কোথাও পোস্টার লাগানো যাবে না। লঙ্ঘন করলে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা, অনাদায়ে ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ডের বিধান বিদ্যমান। পাশাপাশি অপরাধীকে নিজ খরচে পোস্টার অপসারণের নির্দেশ দেওয়া সম্ভব। নির্বাচন কমিশন সংশোধিত আরপিও অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচনে পোস্টার নিষিদ্ধ করেছে; বিলবোর্ডের সংখ্যা সীমিত- প্রতিজনের জন্য সর্বোচ্চ ২০টি। অর্থাৎ আইন কাঠামো আছে, প্রয়োগের বিধানও যথেষ্ট কঠোর। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো কি এসব মানছে? বাস্তবতা বলছে, না। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে, জনরায়ে জনপ্রতিনিধি হয়ে পোস্টার দূষণের সাথে যুক্তদের অনেকেই শিগগিরই জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়নের দায়িত্ব নিতে চলেছেন; অথচ নিজেরাই খোলামেলাভাবে আইন অমান্য করছেন। ডান চোখ দিয়ে যা দেখা যায়, বাম চোখে তারা যেন তা দেখতেও চান না। মহামতি গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, ‘The greatest victory is to conquer oneself.’ অথচ ক্ষমতার এই প্রতিযোগিতায় যেন আত্মসংযমের সেই বিজয় অনুপস্থিত।
পত্রপত্রিকায়, টেলিভিশন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন মাঝে মাঝে ব্যানার-পোস্টার অপসারণে অভিযান চালানোর খবর আসে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক সাংবাদিকদের বলেছেন, এক মাসে ১ লক্ষ ২৫ হাজার ব্যানার-ফেস্টুন সরানো হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশ ও দেশের অন্য শহর-মহাশহরের মেয়র মহোদয়গণ পোস্টার অপসারণের খরচ নিয়ে কিছুই বলেন নি। তবে এটা ঠিক, এতে ব্যয় হচ্ছে বিপুল অর্থ; অথচ এই ব্যয়ের দায় বহন করছে জনগণের করের টাকা। যাঁরা আইন ভঙ্গ করেছেন এবকং করছেন, তাঁদের কাছ থেকে এসব অপসারণ খরচ আদায় করা গেলে হয়তো শাস্তি একটি উদাহরণ হয়ে দাঁড়াত। কিন্তু বাস্তবে দায়হীনতার চক্র এমনভাবে স্থায়ী হয়েছে যে কোনো পক্ষই যেন দায় নিতেই চায় না। রাজনৈতিক দলগুলো ভাবে, প্রচার না করলে জনপ্রিয়তা পাওয়া যাবে না। প্রশাসন ভাবে, আদেশ দিলেই কাজ শেষ। আর শ্রমিকেরা ছোট্ট অর্থের বিনিময়ে রাতারাতি শহরকে ঢেকে ফেলে পোস্টারের রঙিন কোলাজে। আবার বিভিন্ন বেসরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয় ব্যানার-পোস্টার এবং ফেস্টুন দূষণে বড় ভূমিকা রাখছে। আইনের কঠোর প্রয়োগহীনতার সুযোগে তারা নিজেদের শিক্ষা-ব্যবসার প্রচার-প্রসার করে যাচ্ছে পরিবেশ দূষণের মাধ্যমে। অথচ তাদেরকে আইনের আওতায় আনা গেলে এমন দূষণ থেকে নগরবাসী রক্ষা পেতেন। একইসঙ্গে এসব পোস্টার-ব্যানারের অপসারণ ও পরিস্কার বাবদ যে বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয় তা অন্য জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় করার সুযোগ তৈরি হতো।
প্রসঙ্গত, সমস্যা শুধু নির্বাচন বা রাজনীতি নয়- শহুরে আয়োজন, ব্যবসায়িক প্রচারণা, ব্যক্তিগত শুভেচ্ছা ব্যানার, সবাই যেন দেয়ালকে নিজের সম্পত্তি ভাবে। ছাত্র-সংগঠন থেকে শুরু করে স্থানীয় পাড়ার ক্লাব পর্যন্ত পোস্টার লাগানোর সৌখিনতা! অথচ কেউ ভাবে না, যে দৃষ্টিনন্দন রঙিন দেয়ালটি আসলে শহরের আত্মা। সেটি যদি এলোমেলো পোস্টারে ভরে যায়, তবে নগর তার নিজস্বতা হারায়। একজন ভদ্রলোক যেমন নিজের পোষাক পরিচ্ছন্ন রাখেন, তেমনই নগরও পরিচ্ছন্নতা দাবি করে। প্লেটো বলেছিলেন, ‘The city is what it is because its citizens are what they are.’ শহর-নগর শুধু স্থাপনা দিয়ে নয়, নাগরিক আচরণ দিয়ে গঠিত হয়।
প্রশ্ন হলো- এভাবে আর কতদিন? আমরা কি শহরকে কাগজের আর প্লাস্টিকের কবরস্থানে ডুবিয়ে রেখে আধুনিকতার দাবি করতে পারি? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দৃষ্টিদূষণ শুধু নন্দনতাত্ত্বিক সমস্যা নয়; এর আছে পরিবেশগত, অর্থনৈতিক এবং নাগরিক মানসিকতার উপর প্রভাব। বৃষ্টির জলে পোস্টারের কালি নর্দমায় গিয়ে মিশে দূষণ বাড়ায়। ছেঁড়া ব্যানার উড়তে উড়তে সড়কে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটায়। রঙিন ল্যামিনেটেড পোস্টার পলিথিনের মতো দীর্ঘদিন মাটিতে না পচে পরিবেশে বিষাক্ত প্রভাব ফেলে। আর সৌন্দর্য বিনষ্ট শুধু চোখের নয়, এটি আমাদের স্বভাবকেও বিকৃত করে। যখন প্রতিনিয়ত বিশৃঙ্খল দৃশ্যের মুখোমুখি হই, তখন মনও বিশৃঙ্খলা গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে যায়। বিশ^খ্যাত ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিক ডুর্কহেইম (Émile Durkheim) লিখেছিলেন, ‘Disorder is the enemy of progress. এক শহর যেখানে দেয়ালকেও সম্মান করা হয় না, সেখানে কি শৃঙ্খলা, পরিচ্ছন্নতা, সৌন্দর্য বা নাগরিক মূল্যবোধ স্থায়ীভাবে টিকে থাকে?
এসব বিবেচনায় বলতে হয়- বন্দরনগরী চট্টগ্রাম এবং রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর-মহাশহরে একটি সুপরিকল্পিত প্রচারণা ব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন জরুরি। উন্নত দেশগুলোতে পোস্টার লাগানোর স্থান নির্দিষ্ট থাকে- বাসস্টপ, কমিউনিটি বোর্ড, সিটি ঘোষিত নির্দিষ্ট গ্যালারি; আর সেখানে পোস্টার লাগানোর সময়সীমাও নির্ধারিত। আমরা চাইলে পারি, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে মহানগর পর্যন্ত পোস্টার বোর্ড স্থাপন করতে। নির্বাচনের সময় চাইলে প্রতিটি ওয়ার্ডে ১০দ্ধ২০ ফুটের একটি নির্দিষ্ট বোর্ড ঘোষণা করা যেতে পারে; যেখানে প্রত্যেক প্রার্থী সমান জায়গা পাবেন। এতে যেমন খরচ কমবে, তেমনি দৃষ্টিদূষণও নেমে আসবে ন্যূনতম পর্যায়ে। একইসঙ্গে ডিজিটাল প্রচারণাকে উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে একটি ‘ই-ইলেকশন ক্যাম্পেইন পোর্টাল’ চালু হলে পোস্টার নির্ভরতা অনেকাংশে কমবে। কারণ কাগজের পোস্টার প্রাচীন রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা মাত্র, প্রভাব ও জনপ্রিয়তার পরিমাপে এটি আর কার্যকর নয়। পোস্টার ও ব্যানার দূষণ বন্ধে পরিবেশবিদদের মতে, আইন প্রয়োগ, শাস্তি নিশ্চিতকরণ, এবং নৈতিক আচরণের বিকাশ- এই তিনটি বিষয় প্রাধান্য দিলে এমন দূষণ বন্ধ করা সম্ভব। আইন প্রয়োগ ছাড়া প্রচারণা অপসারণ শুধু কাগজ সরানো নয়, এ হলো ভবিষ্যৎ বিশৃঙ্খলার বীজতলা রোপণ, কারণ অপসারণের পরও পোস্টার আবার ফিরে আসবে। জরিমানার পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে; পুনরাবৃত্তির ক্ষেত্রে কারাদণ্ড নিশ্চিত করা উচিত; দলীয়পর্যায়ে প্রার্থীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার বিধান কঠোর করা প্রয়োজন। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- নাগরিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের মননে পরিবেশ-নৈতিকতা গড়ে তোলা। প্রতিটি দলের ইশতেহারে ‘দৃষ্টিদূষণ নিয়ন্ত্রণ’ একটি বাধ্যতামূলক প্রতিশ্রুতি হওয়া উচিত।
আমরা ভুলে যাই- এ শহর আমাদের নিজস্ব, আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস, আমাদের স্মৃতি, আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ। যেদিন আমরা পোস্টার ও ব্যানার-ফেস্টুন লাগানোর আগে ভাবব, ‘এই দেয়ালটি যদি আমার নিজের ঘরের হয়?’, ‘ব্যানার-ফেস্টুনে ভরে দেওয়া পিলার বা রাস্তাটি যদি আমার বাড়ি অংশ হয়?’ তাহলে কেমন লাগবে? এমন চিন্তা-ভাবনা ধারণ করলে এবং সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারলেই কেবল পরিবর্তন শুরু হবে। আমাদের টেকসই উন্নয়ন মানসিকতার ভিত্তি স্থাপন করতে হবে সামান্য কাজ থেকে- দেয়াল রক্ষা, শহর রক্ষা, চোখের সৌন্দর্য রক্ষা। নগরের প্রতিটি ইট আমাদের সভ্যতার ভাষা। তাকে সম্মান দিতে না পারলে, উন্নয়ন মসৃণভাবে টিকে থাকে না।
সবশেষে যে কথাটি বলা দরকার, তা হলো- আইনগত বিধান প্রয়োগ ও জরিমানা বাস্তবায়ন অপরিহার্য। তবে আরও অপরিহার্য হলো নাগরিক চরিত্রের পরিবর্তন। শাস্তি ভয় নয়, বিবেকই যদি আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে, তবে দৃষ্টিদূষণের এই বিপর্যয় সহজেই কমে যাবে। সক্রেটিস যেমন শিখিয়েছিলেন, ‘The secret of change is to focus all your energy not on fighting the old but on building the new’. তাই লড়াই শুধু ব্যানার-ফেস্টুন-পোস্টারের বিরুদ্ধে নয়, অসচেতনতা ও দায়িত্বহীনতার বিরুদ্ধেও। পরিবর্তন শুধু দেয়াল পরিষ্কারে নয়, চিন্তায়, সংস্কৃতিতে, অভ্যাসে। সবাই যদি সচেতন ও দায়িত্ববান হন, তাহলে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র। তখন আমরা একটি পরিবেশসম্মত সুন্দর দৃষ্টিনন্দন শহর পাবো, সুন্দর মনজুড়ানো বাংলাদেশ পাবে।