চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলন কপ-৩০ : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলন কপ-৩০ : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

আবসার মাহফুজ

৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ | ২:১৪ অপরাহ্ণ

বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলন কপ-৩০ নিয়ে বিশ্ববাসীর পর্বতসম প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে অনেক ফারাক রেখেই গত ২২ নভেম্বর ব্রাজিলে বিশ্ব জলবায়ু আলোচনার আসর শেষ হলো একটি অত্যন্ত দুর্বল চুক্তির মাধ্যমে। যেখানে পৃথিবীকে ভয়ঙ্করভাবে উত্তপ্ত করে তুলছে এমন জীবাশ্ম জ্বালানির কোনো সরাসরি উল্লেখই নেই। ব্রাজিলের বেলেম শহরে গত ১০ নভেম্বর শুরু হওয়া সম্মেলনে বাধ্যতামূলক কোন সিদ্ধান্তে যায়নি উন্নত বা জীবাশ্ম জ্বালানি সরবরাহ করা দেশগুলো।

 

উল্লেখ্য, বিশ্ব এমন একসময়ে কপ-৩০ সম্মেলন করলো, যখন রাজনৈতিক মানচিত্র প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে, জলবায়ু বিপর্যয় অভূতপূর্ব মাত্রা ছুঁয়ে যাচ্ছে, এবং পৃথিবীর প্রতিটি কোণে উদ্বেগ, ক্ষুধা ও বাস্তুচ্যুত জীবনের আর্তনাদ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দীর্ঘ ত্রিশবছরের জলবায়ু আলোচনা যেন আজও এক প্রশ্নের সামনে এসে থেমে আছে- মানবসভ্যতা কি সত্যিই পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত, নাকি আমরা এখনো অপেক্ষায় আছি আরো বড় বিপর্যয়ের প্রমাণের? কপ-৩০ তার উত্তর দিতে পারেনি, কিন্তু প্রশ্নগুলো আরও তীক্ষ্ন করে তুলেছে। সম্মেলনের শুরুতে যখন ব্রাজিলের বেলেম নগরীর বাতাসে একধরনের আশাবাদ ভাসছিল, মনে হয়েছিল এবার হয়তো পৃথিবী নতুন পথরেখা আঁকবে। আমাজনকে পেছনে রেখে লুলা সরকারের নেতৃত্ব যেন প্রতীকীভাবেই পৃথিবীর শ্বাসনালী রক্ষার অঙ্গীকার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু সম্মেলনের শেষপ্রান্তে এসে যে ফলাফলের দিকে দুনিয়া তাকাল, তা ছিল প্রতিশ্রুতির চেয়ে বেশি অসমাপ্তির, উচ্চারণের চেয়ে বেশি দ্বিধা ও অনিশ্চয়তার।

 

কপ-৩০ মূলত গোটাবিশ্বের জলবায়ুনীতি ভবিষ্যতের পাঁচবছর বা দশবছরের পথরেখা নির্ধারণের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছিল। বিশেষত জিসিএসটি- গ্লোবাল স্টকটেক পর্বে বিশ্বের দেশগুলো তাদের অগ্রগতি তুলে ধরে এবং বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দেখায় যে বর্তমান প্রতিশ্রুতির পথে পৃথিবী এগোলে গড় উষ্ণতা ৩ক্ক সেলসিয়াসের কাছাকাছি গিয়ে ঠেকতে পারে। অথচ প্যারিস চুক্তি বলছে ১.৫ক্কএর ওপরে তাপমাত্রা উঠলে পৃথিবীর প্রতিবেশব্যবস্থা অপরিবর্তনীয় ক্ষতির মুখে পড়বে। এই বৈপরীত্যই কপ-৩০ এর আলোচনার ফোকাস ছিল, এবং এখানেই সবচেয়ে বড় হতাশাটিও নিহিত। তবে, এখনো সময় আছে; কিন্তু এই সময় অনন্ত নয়। সম্মেলনে নবায়নযোগ্য শক্তির সক্ষমতা তিনগুণ বৃদ্ধির প্রতিশ্রæতি যে শুধুই প্রতীকী নয়, তা অনেক বিশেষজ্ঞের মতে বাস্তবসম্মতও, যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা কাজ করে। সৌর ও বায়ুশক্তির ব্যয় গত দশকে ৮০ শতাংশেরও বেশি কমেছে, ব্যাটারি প্রযুক্তি দ্রæত দক্ষ হচ্ছে। কিন্তু বড় প্রশ্ন হলে, কার স্বার্থ এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত? জীবাশ্ম জ্বালানি-নির্ভর অর্থনীতি কি এত সহজে পথ ছেড়ে দেবে? সৌদি আরব, কাতার, রাশিয়া, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও এখনো জ্বালানি রপ্তানির ওপর অর্থনীতি দাঁড় করিয়ে রেখেছে। তাই সম্মেলনের আলোচনায় পরিষ্কারভাবে বোঝা গেল- জ্বালানি ট্রানজিশন একটি বৈজ্ঞানিক প্রয়োজন হলেও, বাস্তবে এটি রাজনৈতিক লড়াই, বাজারের নিয়ন্ত্রণ ও শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর ভূ-আকাক্সক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে।

 

কপ-৩০ এ লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড নিয়ে যে আলোচনা হয়েছিল, তা উন্নয়নশীল দেশগুলোর দীর্ঘদিনের দাবি। বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, টুভালু, পাপুয়া নিউগিনি, সিয়েরা লিওন কিংবা মোজাম্বিক- যেসব দেশ জলবায়ুবিপর্যয়ের সরাসরি শিকার, তারা চায় ক্ষতির দায় যাদের বেশি, তারা অর্থ দেবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো- ফান্ডের কাঠামো তৈরি হলেও অর্থবণ্টনের নীতি, অগ্রাধিকারের ব্যাখ্যা, স্বচ্ছতা, আর্থিক উৎস কোন পর্যায়ে কতটা বাধ্যতামূলক হবে- এসব বিষয়ে স্পষ্টতার ঘাটতি রয়ে গেছে। ধনীদেশগুলো এখনো সাহায্য নয়, বরং বিনিয়োগভিত্তিক ফ্রেমওয়ার্ক পছন্দ করে, যাতে টাকার সঙ্গে লাভের হিসাবও থাকে। উন্নয়নশীল দেশগুলো বলছে- ঝড়, বন্যা, লবণাক্ততা, ফসলহানি, অভিবাসন, এসবের ক্ষতি কখনোই বিনিয়োগ দিয়ে পূরণ করা যাবে না। ক্ষতিপূরণ হতে হবে ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে, ব্যবসার লেন্সে নয়।

 

বেলেম সম্মেলনের প্রধান বৈপরীত্য হলো- রাজনৈতিক ভাষণ ছিল উজ্জ্বল, বৈজ্ঞানিক সতর্কবাণী ছিল স্পষ্ট, কিন্তু সিদ্ধান্তের শক্তি ছিল দুর্বল। জাতিসংঘের সাধারণ সম্পাদক অ্যান্টোনিও গুতেরেস বলেছেন, এখন আর ধীরগতিতে এগোনোর সময় নেই, পৃথিবী জ্বলছে। কিন্তু পৃথিবী কি সত্যিই তা শুনল? নাকি প্রচলিত স্বার্থের নৌকা ডুবিয়ে না দিয়ে কেবল রং করে নতুন নামে চালিয়ে দিল? সিদ্ধান্তের ভাষা ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ, কিন্তু প্রস্তাবনার ভাষায় ছিল আপসের ছাপ। কয়লা, গ্যাস, তেল- এসব থেকে বের হয়ে আসার যে প্রস্তাব উঠেছিল, তা চূড়ান্ত খসড়ায় নরম হয়ে গিয়ে দাঁড়ায় ‘গ্র্যাজুয়াল রিডাকশন’ বা ধীরে ধীরে হ্রাস। কেউ বলেনি কবে, কেউ বলেনি কতটা, কেউ বলেনি আইনগত বাধ্যবাধকতা কতটুকু।

 

এখানেই প্রশ্ন উঠে, কপ-৩০ কি একটি নৈতিক আহ্বানে শেষ হলো, কিন্তু বাস্তব রোডম্যাপ ছাড়া? উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশেষত বাংলাদেশ আরও স্পষ্ট সিদ্ধান্ত চেয়েছিল। কারণ, বাংলাদেশের জন্য জলবায়ু শুধু পরিবেশগত সংকট নয়, এটি অর্থনীতি, কৃষি, স্বাস্থ্য, নগরায়ণ, এমনকি জনসংখ্যা গণতান্ত্রিক কাঠামোর ওপরও সরাসরি আঘাত। উপক‚লের লবণাক্ততা ইতিমধ্যে ২.৫ মিলিয়নের বেশি মানুষকে চাষাবাদের বাইরে ঠেলে দিয়েছে। প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার মানুষ জমি হারিয়ে শহরে চলে আসে- এমন প্রবাহ চলতে থাকলে অভ্যন্তরীণ জলবায়ুঅভিবাসন নতুন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট ডেকে আনবে। বাংলাদেশ চেয়েছিল জলবায়ু তহবিলের সুষম বন্টন, প্রযুক্তির সহজলভ্যতা, কার্বনন-বাজারে সুবিধাজনক শর্ত এবং ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনে বাস্তবভিত্তিক সহায়তা। কিন্তু বৈশ্বিক কাঠামোয় সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী রাষ্ট্রগুলোই সবচেয়ে কম ক্ষমতায় থাকে। কপ-৩০ সেই অন্যায়কে, সেই বৈষম্যকে দূর করেনি; বরং আরো উস্কে দিয়েছে, বলা যায়।

 

জলবায়ু ন্যায়বিচারের ধারণা তাই এখন আর শুধু উন্নয়নশীল দেশের দাবি নয়, এটি নৈতিকতার ভিত্তি হয়ে উঠেছে। পৃথিবী যদি চায় ১.৫ক্ক তাপমাত্রা সীমায় থামাতে, তাহলে ধনীরাষ্ট্রকে শুধু প্রযুক্তি নয়, রাজনৈতিক ক্ষমতাও ভাগ করতে হবে। উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রশ্ন সহজ, যারা পৃথিবীর ২০০ বছরের শিল্পায়নের লাভ নিয়েছে, তারাই কি এখন দায় এড়িয়ে যেতে পারে? যদি জলবায়ু বিপর্যয় বৈশ্বিক বাস্তবতা হয়, তবে দায়ও বৈশ্বিক হতে হবে। কিন্তু কপ-৩০ দেখালো, বিশ্ব এখনো তা স্বীকার করছে অর্ধেক মন নিয়ে- এক হাত বাড়িয়ে দেয়, অন্য হাত পেছনে গুটিয়ে রাখে।

 

তবু সবটুকু হতাশা নয়। ব্রাজিলে কপ-৩০ মানবসভ্যতাকে অন্তত স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, সময় দ্রæত ফুরিয়ে যাচ্ছে। আমাজন সংরক্ষণে ব্রাজিল বিদেশি লগিং বন্ধে আরও কঠোর নীতি নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আদিবাসীদের সিদ্ধান্ত, অধিকার শক্তিশালী করা হয়েছে, যা প্রকৃতিবান্ধব নীতি নির্মাণে বড় মাইলফলক। ইউরোপ নবায়নযোগ্য শক্তি বিনিয়োগে রেকর্ড ঘোষণা করেছে। ভারত আবারো বলেছে, তারা ২০৭০-এর মধ্যে নেট-জিরোতে পৌঁছাবে, তবে শর্ত- প্রযুক্তি ও তহবিলপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। চীন সৌরশক্তিতে নেতৃত্ব অব্যাহত রাখবে বলে জানিয়েছে। এসব অর্জন হয়তো যথেষ্ট নয়, কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে অত্যাবশ্যক।

 

প্রশ্ন হলো, এখন কোথায় যাবে পৃথিবী? কপ-৩১ কি আরও কঠোর হবে, নাকি আবারও আপসের ভাষায় আবদ্ধ থাকবে? জলবায়ুবিদরা বলছেন, পরবর্তী দুইবছর বিশ্ব নির্ধারণ করবে ২১ শতকের শেষনাগাদ পৃথিবীর রূপ কেমন হবে। আমরা কি বন্যা-ঝড়-দুর্ভিক্ষ-স্থানচ্যুতি-রাজনৈতিক অস্থিরতার এক গ্রহ দেখতে যাচ্ছি, নাকি খাদ্য-অর্থনীতি-প্রযুক্তিতে ন্যায়সমতার নতুন দিগন্ত? এর উত্তর নির্ভর করছে রাষ্ট্রগুলোর সৎ প্রতিশ্রæতির ওপর।

 

আমাদের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো- জলবায়ু আলোচনায় বাংলাদেশের কণ্ঠ আরও প্রাসঙ্গিক, আরও বৈজ্ঞানিক, আরও দৃঢ় হতে হবে। কপ-৩০ দেখিয়েছে, আর্তির ভাষা যথেষ্ট নয়- প্রমাণ, তথ্য, অর্থনৈতিক যুক্তি এবং রাজনীতির শক্তি চাই। উপক‚ল, কৃষি, পানি-নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যঝুঁকি, নারী-শিশুর ক্ষতি, নগর-অভিবাসন- এসবকে আন্তর্জাতিক আলোচনায় কঠোর তথ্যভিত্তিক যুক্তির সঙ্গে তুলে ধরতেই হবে। কারণ, পৃথিবী এখনো শোনে না হৃদয়ের ডাক, শোনে ক্ষমতার ভাষা।

 

কপ-৩০ তাই উত্তর নয়, সতর্কবার্তা। আমরা হয় পথ বদলাবো, নয়তো পথ আমাদের বদলে দেবে। আমাজনের বন শুধু ব্রাজিলের সম্পদ নয়, পৃথিবীর শ্বাস। বরফ শুধু উত্তর-দক্ষিণ মেরুর নয়, মানবভবিষ্যতের ঘড়িঘণ্টা। সাগরের লবণাক্ততা শুধু বাংলাদেশের কাঁটা নয়, সভ্যতার অবশিষ্টতাও। সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই। কারণ, পরিবর্তনের শেষসমুদ্র হয়তো সামনে, কিন্তু সময়ের জোয়ার পিছিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।

 

এখন দুনিয়ার হাতে দুই ভবিষ্যৎ- একটি সবুজ, ন্যায়ভিত্তিক, প্রযুক্তিনির্ভর পৃথিবী, যেখানে মানুষ বাঁচে সহাবস্থানে। অন্যটি অগ্নিদগ্ধ, ক্ষুধা-অভিবাসনে বিধ্বস্ত, সমুদ্র-বিলুপ্ত দ্বীপের পৃথিবী, যেখানে সভ্যতা দাঁড়িয়ে থাকে ইতিহাসের ভুলের স্মারক হয়ে। কপ-৩০ আমাদের শুধু স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, শেষ ভবিষ্যৎটা আমরা চাই না, কিন্তু প্রথমটিকে পেতে হলে এখনই ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট