
প্রতিদিন সকালবেলা স্কুলে প্রবেশের মুহূর্তে ছাত্রছাত্রীদের প্রাণোচ্ছল মুখ হৃদয়কে উজ্জীবিত করে। তাদের হাসি, খুনসুটি আর ছুটাছুটিতে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রাণের সঞ্চার হয়। সকালবেলার ক্লাসগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের উচ্ছ্বাস, জানার আগ্রহে ভরা চোখগুলো এবং নানারকম প্রশ্ন পাঠদানে অনুপ্রাণিত করে। তবে দিন যত গড়াতে থাকে সেই উচ্ছ্বাস ধীরে ধীরে ম্লান হতে শুরু করে। টিফিনের পরের ক্লাসগুলোতে মনে হয় এ যেন এক ভিন্ন জগৎ। একই ক্লাসরুম, একই শিক্ষক সাথে সেই সকালের শিক্ষার্থীরা সবকিছু ঠিক থাকলেও ঠিক থাকে না সেই জানার আগ্রহ, নানারকম প্রশ্ন এবং স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ। তাদের ক্লান্ত শ্রান্ত মুখগুলোর দিকে তাকালেই বুঝতে কষ্ট হয় না যে তাদের চোখ বলছে “ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি”। টিফিনের পর দুপুরের ক্লান্ত রোদ, ঘন্টার পর ঘন্টা ক্লাস এবং দীর্ঘ সময় ধরে একটানা বসে থাকার ভার যেন তাদের কোমল মন ও শরীরকে অবসন্ন করে দেয়। বিকেলের পড়ন্ত আলোতে যখন তাদের মুখের দিকে তাকাই তখন উচ্ছ্বাসের সেই জ্যোতি যেন কোথায় হারিয়ে যায়। চোখে ক্লান্তি, মনোযোগে শূন্যতা আর তাদের মলিন হাসিতে শিক্ষকদের পাঠদানের অভিপ্রায় রীতিমতো বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে।
বর্তমানে বাংলাদেশের সরকারি এবং বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে স্কুলের সময়সূচি সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত নির্ধারিত (অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া)। এই সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের সাত থেকে আটটি আলাদা আলাদা বিষয়ে পাঠদান করা হয়। মাঝখানে মাত্র ৪০-৪৫ মিনিটের একটি টিফিন বিরতি থাকে। একজন শিক্ষার্থীকে যথাসময়ে স্কুলে উপস্থিত হতে সকাল ৮:৩০ থেকে প্রস্তুতি শুরু করতে হয় এবং সকাল ৯টার আগে-পরে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হয়। বিকাল ৫টায় ছুটি হলেও বাসায় পৌঁছাতে সন্ধ্যা ৬টা গড়িয়ে যায়। অর্থাৎ, শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন ৯-১০ ঘণ্টা স্কুলে অবস্থান এবং আসা-যাওয়ার কাজে ব্যয় করতে হয়। এখানেই শেষ নয়, বাসায় ফিরে তাদের স্কুলের বাড়ির কাজ, পরীক্ষার প্রস্তুতি, এবং অতিরিক্ত পড়াশোনার জন্যেও সময় দিতে হয়। এর ফলে পুরো সপ্তাহজুড়ে তাদের দিনগুলো কেটে যায় একঘেয়েমি এবং চাপের মধ্যে। এই সময়সূচির কারণে শিক্ষার্থীদের জন্য খেলাধুলা, শরীরচর্চা বা সৃজনশীল কাজের কোনো সুযোগই থাকে না। অথচ বিকেলবেলা খেলাধুলা এবং শারীরিক চর্চা একটি শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য। শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সুযোগ না পেয়ে অনেক শিক্ষার্থী মোবাইল ফোন এবং অন্যান্য অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। তাদের সৃজনশীলতা এবং জীবনযাত্রার ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
অন্যদিকে, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সময়সূচি অনেক বেশি শিক্ষার্থীবান্ধব। যেমন, ফিনল্যান্ড, জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলের সময়সীমা সাধারণত সকাল ৮:০০ থেকে দুপুর ২:০০ বা সর্বোচ্চ ৩:০০ পর্যন্ত নির্ধারিত। তাদের সময়সূচি শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ কমায় এবং খেলাধুলা ও সৃজনশীল কাজের জন্য পর্যাপ্ত সময় রেখে দেয়।
বাংলাদেশের এই দীর্ঘ সময়ের স্কুল সময়সূচির সুনির্দিষ্ট ইতিহাস এবং কারণ খুব বেশি স্পষ্ট না হলেও অনেকেই এই পদ্ধতি সংশোধনের বিপক্ষে মতামত দেন। তারা মনে করেন, এটি কোচিং বাণিজ্য বন্ধের একটি পদক্ষেপ হিসেবে কার্যকর হবে। দীর্ঘ সময় ধরে স্কুল কার্যক্রম চালিয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলেই অধিকাংশ সময় ব্যস্ত রাখার মাধ্যমে কোচিংয়ের প্রতি নির্ভরশীলতা কমানো যাবে বলে তারা মনে করেন।
কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এই ব্যবস্থার মাধ্যমে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব। কোচিং সেন্টারগুলো এই সময়সূচির সঙ্গে মানিয়ে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। এখন তারা সকাল ৭:০০টা থেকে ৯:০০টা এবং বিকাল ৫:০০টা থেকে সন্ধ্যা ৭:০০টা পর্যন্ত সময়সূচি নির্ধারণ করে তাদের রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে।
এছাড়াও, আধুনিক প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে কোচিং বাণিজ্য এখন অনলাইনেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অনলাইনে কোচিং ক্লাস পরিচালনা আরও সহজ হওয়ায় শিক্ষার্থীদের কোচিং নির্ভরতা কোনোভাবেই কমছে না। বরং এই নতুন মাধ্যম শিক্ষার্থীদের জন্য আরও এক ধরনের চাপ, অনলাইন জগতে পদচারণা এবং আর্থিক ব্যয় বৃদ্ধি করছে।
দিনব্যাপী এই দীর্ঘ সময়সূচি শিক্ষার্থীদের জন্য এক ধরনের বিরক্তির কারণ হয়ে একঘেয়েমি এবং চাপের মধ্যে। এই সময়সূচির কারণে শিক্ষার্থীদের জন্য খেলাধুলা, শরীরচর্চা বা সৃজনশীল কাজের কোনো সুযোগই থাকে না। অথচ বিকেলবেলা খেলাধুলা এবং শারীরিক চর্চা একটি শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য।
শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সুযোগ না পেয়ে অনেক শিক্ষার্থী মোবাইল ফোন এবং অন্যান্য অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। তাদের সৃজনশীলতা এবং জীবনযাত্রার ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
অন্যদিকে, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সময়সূচি অনেক বেশি শিক্ষার্থীবান্ধব। যেমন, ফিনল্যান্ড, জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলের সময়সীমা সাধারণত সকাল ৮:০০ থেকে দুপুর ২:০০ বা সর্বোচ্চ ৩:০০ পর্যন্ত নির্ধারিত। তাদের সময়সূচি শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ কমায় এবং খেলাধুলা ও সৃজনশীল কাজের জন্য পর্যাপ্ত সময় রেখে দেয়।
বাংলাদেশের এই দীর্ঘ সময়ের স্কুল সময়সূচির সুনির্দিষ্ট ইতিহাস এবং কারণ খুব বেশি স্পষ্ট না হলেও অনেকেই এই পদ্ধতি সংশোধনের বিপক্ষে মতামত দেন। তারা মনে করেন, এটি কোচিং বাণিজ্য বন্ধের একটি পদক্ষেপ হিসেবে কার্যকর হবে। দীর্ঘ সময় ধরে স্কুল কার্যক্রম চালিয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলেই অধিকাংশ সময় ব্যস্ত রাখার মাধ্যমে কোচিংয়ের প্রতি নির্ভরশীলতা কমানো যাবে বলে তারা মনে করেন।
কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এই ব্যবস্থার মাধ্যমে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব। কোচিং সেন্টারগুলো এই সময়সূচির সঙ্গে মানিয়ে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। এখন তারা সকাল ৭:০০টা থেকে ৯:০০টা এবং বিকাল ৫:০০টা থেকে সন্ধ্যা ৭:০০টা পর্যন্ত সময়সূচি নির্ধারণ করে তাদের রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে।
এছাড়াও, আধুনিক প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে কোচিং বাণিজ্য এখন অনলাইনেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অনলাইনে কোচিং ক্লাস পরিচালনা আরও সহজ হওয়ায় শিক্ষার্থীদের কোচিং নির্ভরতা কোনোভাবেই কমছে না। বরং এই নতুন মাধ্যম শিক্ষার্থীদের জন্য আরও এক ধরনের চাপ, অনলাইন জগতে পদচারণা এবং আর্থিক ব্যয় বৃদ্ধি করছে।
দিনব্যাপী এই দীর্ঘ সময়সূচি শিক্ষার্থীদের জন্য এক ধরনের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুদিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, পড়ন্ত বিকেলের ক্লাসগুলো তাদের কাছে অনেকটাই চাপের এবং বিরক্তির। ফলশ্রুতিতে মনোযোগের অভাব দেখা দেয়। পড়ন্ত বিকেলে তারা যখন ক্লাসে বসে থাকে, তখন মনে হয় যেন তাদের শরীর ও মন দুই-ই ক্লান্ত এবং অবসন্ন।
এটি স্বাভাবিকও বটে। মফস্বল স্কুলগুলোর অধিকাংশ শিক্ষার্থী স্কুলে আসতে কয়েক কিলোমিটার দূরত্বের কঠিন, দুর্গম রাস্তা পাড়ি দেয়। তাদের মধ্যে অনেকের পরিবারের নিয়মিত টিফিন সরবরাহের সুযোগ থাকে না। যার ফলে অনেক শিক্ষার্থী ঠিকমতো টিফিন গ্রহণ করতে পারে না। দীর্ঘ সময় ধরে ক্লাসে বসে থাকার পর, উপযুক্ত টিফিন বা বিশ্রামের সুযোগ না পেয়ে তাদের অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে কোনো ভালো জোকসও তাদের হাসাতে পারে না, পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ অনেক দূরের কথা। সেই সাথে যুক্ত হয় স্কুল গুলোর অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা (পর্যাপ্ত পাখা, আলো বাতাসের ব্যবস্থা না থাকা)।
শিশুদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা প্রচলিত সময়সূচির কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। American Academy of Pediatrics (AAP) তাদের গবেষণায় এই বিষয়টি তুলে ধরেছেন। যেখানে বলা হয়েছে একটি সুষম সময়সূচি শিশুদের শারীরিক ও মানসিক উন্নতির জন্য উপকারী।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত স্কুলে দীর্ঘ সময় ক্লাসের ফলে শিক্ষার্থীদের ক্লান্তি বাড়ে। বিশেষ করে বিকেলে। Journal of Educational Psychology (2018) এর গবেষণায় দেখা গেছে বিকালে শিশুরা মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের শেখার ক্ষমতা কমে যায়।
বর্তমান সমাজে শিশু কিশোরদের সাথে পারিবারিক এবং সামাজিক সম্পর্ক খুব একটা ভালো দেখা যায় না। একটি সুষম সময়সূচি শিক্ষার্থীদের বিকেল বেলা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ দেয় যা তাদের পারিবারিক এবং সামাজিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে এবং মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে সহায়ক হবে। Journal of Family Psychology (2017) এর মতে বিকেলের সময় শিশুদের খেলাধুলা, সৃজনশীল কর্মকাণ্ড বা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর মাধ্যমে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিকশিত হয়।
বিশেষ করে, শিশুদের বিকেল বেলা খেলাধুলা বা সৃজনশীল কাজে অংশগ্রহণ তাদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দীর্ঘ সময় স্কুলে থাকার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাপ বাড়ে, যা তাদের আচরণগত সমস্যা এবং স্ট্রেস তৈরি করতে পারে। National Institute of Mental Health (NIMH) বলছে একটি সুষম এবং মাঝারি সময়সূচি শিক্ষার্থীদের চাপ কমাতে সহায়ক। দীর্ঘ সময় ধরে ক্লাসে বসে থাকার ফলে শিশুরা মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। যার ফলস্বরূপ তারা মনোযোগী হতে পারে না। সঠিক সময়সূচি তাদের মধ্যে চাপ কমানোর পাশাপাশি তাদের শেখার প্রতি আগ্রহ বাড়াতে সাহায্য করবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতেও শিশুদের সার্বিক বিকাশের জন্য বিকালবেলা খেলাধুলার বিকল্প নেই। সকাল ৮টা থেকে ২টা পর্যন্ত স্কুলের সময়সূচি শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশে অনেক বেশি সহায়ক হতে পারে। এটি তাদের ক্লান্তি কমানোর পাশাপাশি পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ এবং খেলাধুলা ও সৃজনশীল কাজের সময় বৃদ্ধি করে। এই সময়সূচি শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাপ কমিয়ে তাদের শেখার মান বাড়াতে সাহায্য করবে, এবং এভাবে একটি সুষম বিকাশ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
এই সরকারের উদ্যোগে হয়তো অল্পকিছুদিনের মধ্যেই শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন হতে পারে। উক্ত কমিশন অন্যান্য সব সমস্যার সাথে এই বিষয়টিও ভালোভাবে খতিয়ে দেখা উচিত।
লেখক : সহকারী শিক্ষক, হাইদগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়, পটিয়া, চট্টগ্রাম।
পূর্বকোণ/ইবনুর