
বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে যখন আলোচনা হয়, তখন বারবার উচ্চারণ করা হয় প্রবৃদ্ধির সাফল্যের গল্প। তবে এই প্রবৃদ্ধির ভেতরে যে এক গভীর ফাঁপা বাস্তবতা লুকিয়ে আছে, সেটিকে সামনে আনলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, দেশে ছদ্ম-বেকারত্ব এখন মহামারী পর্যায়ে পৌঁছেছে। ছদ্ম-বেকারত্ব বলতে বোঝানো হয় এমন একটি পরিস্থিতি, যেখানে মানুষ কর্মে নিয়োজিত থাকলেও তাদের শ্রম উৎপাদনশীল নয়, কিংবা তারা তাদের প্রকৃত সক্ষমতা অনুযায়ী কাজে অংশ নিতে পারছে না। ফলে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মরত হলেও কার্যত বেকার। এ চিত্র কেবল অর্থনীতির দুর্বলতাই নয়, বরং রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণ ও সামাজিক কাঠামোর অদক্ষতার প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক শ্রমশক্তি জরিপে দেখা যায়, দেশে প্রায় ৭ কোটি ৪০ লাখ শ্রমশক্তি থাকলেও এর মধ্যে প্রকৃত আনুষ্ঠানিক চাকরিতে নিয়োজিত মাত্র ১ কোটি ২০ লাখ। বাকিরা হয় অনানুষ্ঠানিক খাতে, নয়তো এমন কাজে যুক্ত, যেখানে তাদের উৎপাদনশীলতা প্রায় শূন্য। এ বাস্তবতা বোঝা যায় যখন দেখি দেশে কৃষিখাতে এখনও প্রায় ৩৭ শতাংশ মানুষ নিয়োজিত থাকলেও কৃষিজ উৎপাদন জিডিপির মাত্র ১২-১৩ শতাংশ। অর্থাৎ, এক খাতে অপ্রয়োজনীয়ভাবে বিপুল শ্রমিকের উপস্থিতি অন্য খাতগুলোকে সংকুচিত করছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের শেষপ্রান্তিকে আনুষ্ঠানিক বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে ৪.৬৩ শতাংশ, যা এর আগের বছরের ৩.৯৫ শতাংশের তুলনায় বেশি। আনুষ্ঠানিকভাবে বেকার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬ লাখ ৬০ হাজারের বেশি। কিন্তু এই হিসাব বাস্তবতার কেবল একটি অংশকেই তুলে ধরে। কারণ এখানে অন্তর্ভুক্ত হয়নি সেই বিপুল মানুষ, যাদের অস্থায়ী কাজ আছে, যাদের আয় নগণ্য, অথবা যাদের সপ্তাহে মাত্র কয়েক ঘণ্টার কাজ আছে। উল্লেখ্য, যারা চাকরিতে যুক্ত হলেও প্রকৃত অর্থে কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত, তাদেরকেই বলা হয় ছদ্ম-বেকার। ছদ্মবেশী বেকারত্বকে লুকানো বেকারত্বও বলা হয়। এটি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ঘটে, যেখানে বিশাল জনসংখ্যা শ্রমশক্তিতে উদ্বৃত্ত তৈরি করে। এটি বেশিরভাগই অনানুষ্ঠানিক শ্রমবাজারে ঘটে, যা প্রচুর পরিমাণে শ্রম গ্রহণ করতে সক্ষম। ছদ্মবেশী বা গোপন বেকারত্ব সর্বাধিক সম্ভাব্য বেকার জনসংখ্যার যেকোনো অংশকে নির্দেশ করতে পারে। এটি এখনও জাতীয় অর্থনীতির সরকারী বেকারত্বের পরিসংখ্যানে গণনা করা হয়নি। ছদ্মবেশী বেকারত্বের অন্তর্ভুক্ত যারা তাদের ক্ষমতার অনেক নিচে কাজ করে, যাদের কাজের উৎপাদনশীলতা কম এবং যারা সক্রিয়ভাবে চাকরির সন্ধান করছেন না কিন্তু কাজ করতে সক্ষম।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যদি এই ছদ্ম-বেকারদের হিসাব অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাহলে প্রকৃত বেকারত্বের হার আনুষ্ঠানিক সংখ্যার দ্বিগুণের বেশি হতে পারে। অধ্যাপক রাইহান যেমন উল্লেখ করেছেন, ছদ্ম-বেকারদের বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশের প্রকৃত বেকারত্বের হার ১০ শতাংশ বা তারও বেশি হতে পারে। এর মানে হলো, আনুষ্ঠানিক সংখ্যার বাইরে অগণিত মানুষ প্রকৃতপক্ষে বেকার কিংবা অপ্রয়োজনীয়ভাবে কম কাজে নিয়োজিত। এই বাস্তবতা আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে যখন আমরা তরুণদের পরিস্থিতি দেখি। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২২ থেকে ২৫ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু শ্রমবাজার তাদের সবাইকে ধারণ করতে পারছে না। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৭-৮ লাখের জন্য আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। বাকিরা হয় অবহেলিত, নয়তো যেকোনোভাবে কাজের খোঁজে অনানুষ্ঠানিক খাতে ঢুকে পড়ে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী প্রায় ২৬.৭ মিলিয়ন যুবকের মধ্যে ১৯ লাখ ৪০ হাজার ছিল বেকার। এর বড় অংশই উচ্চশিক্ষিত, যারা চাকরির প্রত্যাশা নিয়ে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করেও হতাশ হয়ে পড়ছে। অনেকে কম বেতনে অনিরাপদ কাজে যুক্ত হচ্ছে, কেউ কেউ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে, আবার অনেকেই বেকারত্বের যন্ত্রণায় সামাজিক অস্থিরতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার গবেষণা বলছে, শিক্ষার সঙ্গে শিল্পখাতের দক্ষতার প্রয়োজনের মধ্যে এক বিশাল ফাঁক রয়েছে। তাত্ত্বিক শিক্ষা অর্জন করলেও বাস্তব খাতে প্রয়োগযোগ্য দক্ষতা না থাকায় তরুণরা চাকরির সুযোগ পাচ্ছে না। এর ফলে উচ্চশিক্ষিত বেকারত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বিআইডিএস-এর গবেষকরা সতর্ক করেছেন, যদি ছদ্ম-বেকারত্ব সঠিকভাবে হিসাব করা হয়, তাহলে দেশে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা ২ কোটির বেশি হবে। অথচ সরকারী পরিসংখ্যান কেবল দৃশ্যমান বেকারত্বকে সামনে আনে, ফলে সমস্যার প্রকৃত গভীরতা আড়ালে থেকে যায়।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান যে আত্মতুষ্টির ফাঁদের কথা বলেছেন, সেটিই আজ বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা বারবার গর্ব করি যে বাংলাদেশের অর্থনীতি এগোচ্ছে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- কোন গতিতে এগোচ্ছে? একই সময়ে ভিয়েতনাম, যেটি ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের সমান অবস্থানে ছিল, এখন বহুদূর এগিয়ে গেছে। ভিয়েতনামের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কেবল পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভর করেনি, তারা শ্রমবাজারের বহুমুখীকরণে নজর দিয়েছে, শিল্পায়ন ও প্রযুক্তি খাতে সমন্বিত নীতি গ্রহণ করেছে, এবং সর্বোপরি বেসরকারি খাতকে আস্থায় নিয়ে এগিয়েছে। অথচ বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে কর্তৃত্ববাদী শাসন, দলীয়করণ ও গোষ্ঠীতন্ত্রের কারণে বেসরকারি খাতকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। ফলে অর্থনীতির প্রধান চালকই আস্থা হারিয়েছে। এই ছদ্ম-বেকারত্ব শুধু অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতারও কারণ হয়ে উঠছে। তরুণরা যখন শিক্ষাজীবন শেষ করে একটি যথোপযুক্ত কাজের প্রত্যাশা করে, অথচ তারা সামান্য সম্মানজনক চাকরিও পায় না, তখন হতাশা ও ক্ষোভ জন্ম নেয়।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক সহিংসতার অন্যতম প্রধান কারণ হলো তরুণ-বেকারত্ব। বাংলাদেশও এই ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয়। বেকার বা ছদ্ম-বেকার তরুণরা অনিশ্চয়তায় ভুগে সহজেই অপরাধ, মাদক কিংবা উগ্র রাজনীতির দিকে ধাবিত হয়। শিক্ষার সঙ্গে শ্রমবাজারের বিচ্ছিন্নতা ছদ্ম-বেকারত্বকে আরও তীব্র করেছে। প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে লক্ষাধিক শিক্ষার্থী বের হলেও তাদের বড় অংশের ডিগ্রি শ্রমবাজারে কার্যকর নয়। তথ্যপ্রযুক্তি, আধুনিক কৃষি, ইঞ্জিনিয়ারিং বা গবেষণাভিত্তিক খাতগুলোতে দক্ষতা বাড়ানোর পরিবর্তে এখনও হাজারো শিক্ষার্থী এমন বিষয়ে পড়াশোনা করছে যেগুলো দিয়ে চাকরির বাজারে টিকে থাকা সম্ভব নয়। ফলে তারা অদক্ষ শ্রমিক হিসেবেই থেকে যাচ্ছে, যাদের বিদেশে পাঠানো হলেও তারা ভারতের বা শ্রীলঙ্কার শ্রমিকদের তুলনায় কম আয় করছে। এছাড়া দুর্নীতি ও হয়রানি যে রাষ্ট্রীয় ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটিও হোসেন জিল্লুর রহমান স্পষ্ট করেছেন। ব্যবসা শুরু করতে কিংবা দৈনন্দিন জীবনে নানাধরনের ঘুষ, অনিয়ম, হয়রানি মানুষকে নিরুৎসাহিত করে। বিশ্বব্যাংকের Ease of Doing Business সূচকে বাংলাদেশ বহুবছর ধরেই পিছিয়ে আছে। এর অন্যতম কারণ হলো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতি। ফলে তরুণ-উদ্যোক্তারা নতুন উদ্যোগ নিতে নিরুৎসাহিত হয়, এবং কর্মসংস্থানের নতুন খাত তৈরি হতে পারে না।
অর্থনীতির আরেকটি বড় দুর্বলতা হলো তৈরি পোশাক ও রেমিট্যান্সের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা। বর্তমানে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস এই দুটি খাত। কিন্তু এগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা ঝুঁকিপূর্ণ। বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতা বা অভিবাসন নীতির পরিবর্তন হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়তে পারে। এজন্য জরুরি হয়ে পড়েছে কৃষি, ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি, চামড়া, হালাল খাদ্যশিল্প ও ই-কমার্সের মতো নতুন খাত গড়ে তোলা। ভিয়েতনাম বা মালয়েশিয়ার সাফল্য দেখায়, বহুমুখীকরণ ছাড়া কোনো অর্থনীতিই টেকসই হতে পারে না। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) বারবার সতর্ক করেছে, দক্ষতা উন্নয়ন ছাড়া বাংলাদেশের শ্রমবাজার টেকসই হবে না। বর্তমানে বিদেশে কর্মরত প্রায় ১ কোটি শ্রমিকের বড় অংশই অদক্ষ। তারা কঠোর পরিশ্রম করেও তুলনামূলক কম আয় করছে। অথচ যদি দক্ষতা বাড়ানো যায়, তবে একই সংখ্যক শ্রমিক দ্বিগুণ রেমিট্যান্স আনতে সক্ষম হবে। এর জন্য দরকার পরিকল্পিত কারিগরি শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও বিদেশি শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে সমন্বিত নীতি। দেশীয় বাজারেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাতকে (এসএমই) শক্তিশালী করা প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলোতে এসএমই খাতই কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস। বাংলাদেশেও এ খাতে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব, ঋণপ্রাপ্তির জটিলতা ও দুর্নীতি এটিকে বাধাগ্রস্ত করছে। অথচ যদি এই খাতের জন্য সঠিক নীতি গ্রহণ করা যায়, তবে কয়েক কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব। সা¤প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ২৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। অর্থাৎ কর্মসংস্থান থাকলেও তা অনেক সময় মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করতে পারছে না। এটিই হলো ‘working poor’ বা কর্মরত দরিদ্রের চিত্র, যা ছদ্ম-বেকারত্বের আরেক রূপ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- এর সমাধান কী? প্রথমত, দুর্নীতি ও হয়রানিকে রাষ্ট্রীয় ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করে এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষাব্যবস্থাকে শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। তৃতীয়ত, কৃষি থেকে অপ্রয়োজনীয় শ্রমিককে শিল্প ও সেবাখাতে স্থানান্তর করার জন্য নীতিগত প্রণোদনা দিতে হবে। চতুর্থত, বেসরকারি খাতকে আস্থায় এনে উদ্যোক্তা-বান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এবং সর্বোপরি, নতুন খাত যেমন আইটি, ফার্মাসিউটিক্যালস, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও কৃষি-প্রসেসিং শিল্পকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ড. হোসেন জিল্লুর রহমান যেমন সতর্ক করেছেন, কেবল ‘বাংলাদেশ এগোচ্ছে’ বললেই হবে না, বরং দেখতে হবে কত দ্রুত এবং কতটা টেকসইভাবে এগোচ্ছে। যদি আমরা সময়মতো ব্যবস্থা না নেই, তবে ছদ্ম-বেকারত্ব শুধু অর্থনীতির জন্য নয়, বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্যও ভয়াবহ হুমকি হয়ে উঠবে। উন্নয়নের যে স্বপ্ন আমরা দেখি, তা তখন কেবল সংখ্যার খেলায় সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হলে এই সংকটই হতে পারে বাংলাদেশের নতুন সম্ভাবনার সূচনা। দক্ষ জনশক্তি, সৎ প্রশাসন, এবং বহুমুখী অর্থনৈতিক খাতের বিকাশ- এসব একসাথে মিলেই একটি টেকসই ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের পথ তৈরি করতে পারে।
পূর্বকোণ/ইবনুর