চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

‘ঋণের দায়ে ও খাদ্যাভাবে’ চার জীবনের সমাপ্তি এবং চার কোটি মানুষের নীরব ক্রন্দন

‘ঋণের দায়ে ও খাদ্যাভাবে’ চার জীবনের সমাপ্তি এবং চার কোটি মানুষের নীরব ক্রন্দন

আবসার মাহফুজ

১৯ আগস্ট, ২০২৫ | ১১:৪২ পূর্বাহ্ণ

রাজশাহীর পবা উপজেলার একটি ছোট্ট গ্রামের একটি সেমিপাকা ঘরে যে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে গেল, তা কোনো বিচ্ছিন্ন খবর নয়, এটি বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতার নির্মম বহিঃপ্রকাশ। মিনারুল নামের এক পিতার নিজ হাতে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যা করে আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে যে ভয়ংকর বিয়োগান্ত দৃশ্যের অবসান হলো, সেটি কেবল একজন কৃষকের দুঃখের সমাপ্তি নয়, এটি বাংলাদেশের গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের জর্জরিত জীবনযুদ্ধের কালো এক প্রতিচ্ছবি।

 

দুই পাতার ওই চিরকুটের এক পাতায় লেখা, ‘আমি মিনারুল নিচের যেসব লেখা লেখব, সব আমার নিজের কথা লিখে যাচ্ছি। কারণ আমরা চারজন আজ রাতে মারা যাব। এই মৃত্যুর জন্য কারো কোনো দোষ নেই। আমি মিনারুল প্রথমে আমার স্ত্রীকে মেরেছি। তারপর আমার মাহিমকে (ছেলে) মেরেছি। তারপর আমার মিথিলাকে (মেয়ে) মেরেছি। তারপর আমি নিজে ফাঁস দিয়ে মরেছি।’ চিরকুটে আরো লেখা আছে, ‘আমাদের চারজনের মরা মুখ যেন বাপের বড় ছেলে ও তার স্ত্রী-সন্তান না দেখে এবং বাপের বড় ছেলে যেন জানাজায় না আসে। আমাদের চারজনকে কাফন দিয়ে ঢাকতে আমার বাবা যেন টাকা না দেয়। এটা আমার কসম।’

 

চিরকুটের অন্য পাতায় লেখা, ‘আমি নিজ হাতে সবাইকে মারলাম, কারণ আমি একা যদি মরে যাই তাহলে, আমার স্ত্রী-সন্তানরা কার আশায় বেঁচে থাকবে? কষ্ট আর দুঃখ ছাড়া কিছুই পাবে না। আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে। এত কষ্ট আর মেনে নিতে পারছি না। তাই আমরা বেঁচে থাকার চেয়ে মরে গেলাম, সেই ভালো হলো। কারো কাছে কিছু চাইতে হবে না। আমার জন্য কাউকে মানুষের কাছে ছোট হতে হবে না। আমার বাবা আমার জন্য অনেক মানুষের কাছে ছোট হয়েছে, আর হতে হবে না। চিরদিনের জন্য চলে গেলাম। আমি চাই, সবাই ভালো থাকবেন। ধন্যবাদ।’

 

এখানে ফুটে উঠেছে মিনারুলের হৃদয়ের সবচেয়ে গভীর ক্ষত চিহ্নটি। বারবার অপমানিত হওয়া, মানুষের কাছে সাহায্য চাইতে গিয়ে নিজের কিংবা পরিবারের সম্মান হারানো, সব তাকে ভেতর থেকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। হয়তো তিনি চাননি সন্তানরা এই পথ দিয়ে হাঁটুক, চাননি পরিবারকে আর কারো সামনে ছোট হতে হোক। হয়তো তাই তিনি সপরিবারে আত্মহননের মতো নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মৃত্যুর আগের মুহূর্তে হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, এই পথেই মুক্তি, এই পথেই শেষ হবে অপমান আর ক্ষুধার লড়াই। কিন্তু সেই মুক্তির জন্য তিনি নিজের প্রিয় সন্তানদের জন্যও বেছে নিলেন নির্মম পথ। এটি শুধু এক পিতার নয়, এক স্বামীর নয়, এটি আমাদের পুরো সমাজেরও ব্যর্থতা। কারণ আমরা কেউ তাঁর কান্না শুনতে পাইনি, কেউ তাঁর দিকে সাহায্যের হাত বাড়াইনি।

 

চিরকুটে লেখা মিনারুলের শেষ একটি লাইন- ‘আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে কারো কাছে কিছু চাইতে হবে না’ শুধু একটি হতাশ ব্যক্তির চিৎকার নয়, এটি আমাদের সমাজব্যবস্থার এক নির্মম ব্যর্থতার দলিল। এই পরিবার যখন নীরবে ধুঁকছিল, তখন রাষ্ট্র কিংবা সমাজ কেউই তাদের কান্না শুনতে পায়নি। আর ঠিক এই ঘটনার সংবাদ ছাপা হবার দিনই আরেক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হলো বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ: দেশের ৪ কোটি মানুষ খাদ্যের অভাবে ঋণ করতে বাধ্য হচ্ছে। মর্মান্তিক মিলটি নিছক কাকতালীয় নয়, বরং একটি গভীর সত্যের ইঙ্গিত। ক্ষুধা ও ঋণ আমাদের সমাজে এখন নৈতিকতাকেও গ্রাস করে নিচ্ছে। এ ঘটনা শুধু একটি গ্রামের নয়, এটি গোটা সমাজের জন্য এক সতর্কবার্তা। আমাদের চারপাশে হয়তো আরো অনেক মিনারুল আছেন, যাঁরা নীরবে লড়ছেন ক্ষুধা, ঋণ আর অপমানের সঙ্গে। কিন্তু তাঁরা কথা বলছেন না। কারণ বললেও হয়তো শোনা হবে না অথবা শোনা হলেও বোঝা হবে না।

 

বিবিএসের খানা আয় ও ব্যয় জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৪ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ ঋণ করে খাদ্যঘাটতি মেটাতে বাধ্য হচ্ছেন। খাদ্যনিরাপত্তা পরিসংখ্যান-২০২৩ নামে প্রতিবেদনটি গত শুক্রবার বিবিএসের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। দেশে খাদ্য নিরাপত্তা-সংক্রান্ত এ ধরনের জরিপ এটিই প্রথম। প্রতিবেদনে দেখা যায়, সারাদেশে গড়ে ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার খাদ্যঘাটতি পূরণে ঋণ করে থাকে। গ্রামে এ হার আরও বেশি; ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ। শহরাঞ্চলে ২৩ দশমিক ৬ এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ পরিবার খাদ্য ঘাটতি পূরণে ঋণ করে থাকে। ঋণের উৎস বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৬৮ দশমিক ২ শতাংশ পরিবার অলাভজনক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। আত্মীয়দের কাছ থেকে ঋণ নেয় ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার। ব্যাংক থেকে ১০ দশমিক ৯ ও মহাজনদের কাছ থেকে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার ঋণ নেয়। বিবিএসের হিসাবমতে, ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছেন। আর চরম নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছেন ১৭ লাখ মানুষ।

 

বিবিএস-এর জরিপ অনুযায়ী দেশের ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার বছরে গড়ে প্রায় ৪৯ হাজার টাকা কেবল খাদ্য জোগাড়ের জন্য ঋণ নেয়। শহরের মধ্যবিত্ত পরিবার পর্যন্ত আজ চাল, ডাল, মাছ কিনতে গিয়ে বাধ্য হচ্ছে ধার করতে। গ্রামাঞ্চলে এই অনুপাত আরো বেশি, ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবার খাবারের জন্য ধার করে। অথচ এই পরিবারগুলোর অনেকেই অবচেতনভাবে বিশ্বাস করে, ‘ঋণ আর অপমানের চেয়ে মৃত্যুই সহজ।’ এই মানসিক অবক্ষয়ের পেছনে কেবল ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, একটি রাষ্ট্রীয়, কাঠামোগত ব্যর্থতাই দায়ী।

 

মিনারুল ছিলেন একজন কৃষক, কখনো বা ট্রাকের হেলপার, আবার কখনো শ্রমিক। এদেশের লাখো পরিবারের মতোই তিনি প্রতিদিন নুন আনতে পান্তা ফুরোতে দেখেছেন। এনজিওর কিস্তি, স্থানীয় মহাজনের সুদ, গ্রামের দোকানের বাকির চাপ আর সামাজিক লজ্জার ভেতর দিয়ে জীবন কাটানো মানুষগুলো আমাদের চারপাশে অসংখ্য। ফড়িয়া, দালাল আর প্রান্তিক কৃষকের মধ্যে যে অন্যায্য ব্যবধান, সেটিও এমন মৃত্যুর দায় এড়াতে পারে না। প্রশ্ন জাগে, কেন একজন বাবা মনে করল, তার সন্তানরা জীবিত থাকলে শুধু অপমান আর কষ্ট পাবে? কারণ তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, দরিদ্র বাবা হিসেবে সমাজে স্থায়ীভাবে ছোট হয়ে থাকার যন্ত্রণা কাকে বলে। বাবা রুস্তম আলী কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘আমি জমি বেচে আবার কিস্তি শোধ করতাম।’ কিন্তু হয়তো মিনারুল বুঝেছিলেন, এই ঋণের ফাঁদ থেকে আর মুক্তি নেই। পরিবারসহ মৃত্যুই যেন তার কাছে মুক্তির সমার্থক হয়ে উঠেছিল।

 

বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে এনজিও কিস্তির চাপে আত্মহত্যার ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। কুমিল্লা, নাটোর, কক্সবাজার থেকে মুন্সীগঞ্জ পর্যন্ত একই ধরনের পারিবারিক আত্মহত্যার খবর পাওয়া যাচ্ছিল। এর মধ্যে অল্প কিছু সংবাদ গণমাধ্যমে আসে, আর বাকি খবর লোকমুখে হারিয়ে যায়। প্রত্যেকটি ঘটনা যেন সমাজ ও রাষ্ট্রকে সতর্কবার্তা দিচ্ছে। কিন্তু আমরা কেবল শোক প্রকাশ করি, নীতি পরিবর্তন করি না। মিনারুলের পরিবার যেন সেই শোকগাঁথার সবচেয়ে নির্মম সংস্করণ।

 

বিবিএস-এর জরিপের তথ্যে আরো জানা যায়, দেশের কৃষিজীবী পরিবারের মধ্যে ২৬ দশমিক ১৩ শতাংশ মাঝারি বা তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছে। আর প্রায় ১ শতাংশ কৃষক পরিবার চরম খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মধ্যে। তা হলে প্রশ্ন ওঠে, যারা খাদ্য উৎপাদন করে তারাই যদি সবচেয়ে বেশি না খেয়ে থাকে, তাহলে এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উদ্দেশ্য কী? রাষ্ট্রের সংবিধান বলে, নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা- এই পাঁচটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে খাদ্য সবচেয়ে মৌলিক, কেননা বেঁচে থাকার প্রশ্ন। কিন্তু বাস্তবে মানুষ যখন খাদ্যের জন্য ঋণ নেয়, এবং অপমান সইতে না পেরে জীবন বিসর্জন দেয়, তখন বোঝা যায়, মৌলিক অধিকারের প্রতিশ্রsতি কতটা ফাঁপা হয়ে গিয়েছে।

 

মজুরি না বাড়ার বিপরীতে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার বিস্ফোরক চিত্রটি এখন সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেছিলেন, ‘এটি প্রমাণ করে দারিদ্র্যসীমার ওপরে থাকা মানুষও খাদ্যের কষ্টে আছে’। তার এ বক্তব্য আরও একবার দেখিয়ে দেয় যে, আমরা এক ‘ডুবন্ত মধ্যবিত্ত’ শ্রেণির দিকে এগোচ্ছি, যারা কাজ করছে, আয় করছে, কিন্তু খাবার আর ঋণের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে পারছে না। ফলে দারিদ্র্য শুধু নিম্নবিত্তের সমস্যা নয়, এটি এখন মধ্যবিত্তেরও নীরব বাস্তবতা।

 

ঋণগ্রস্ততা কোনো ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, এটি একটি কাঠামোগত ফাঁদ যেখানে সহজ শর্তে ঋণের প্রতিশ্রæতি দিয়ে মানুষকে বেশি কিস্তির বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়। এনজিওগুলো কখনো কখনো মুনাফা ও সুদের এমন দৌঁড় তৈরি করছে যে, মানুষ নিজেদের ঘর বিক্রি করেও ঋণ শোধ করতে পারছে না। ফলে সমাজে যে ‘microfinance’ এক সময় গরিবের বন্ধু বলে বিবেচিত হত, আজ তা অনেকে দেখছে ‘micro-debt trap’ হিসেবে। তবে কেবল এনজিওকে দায় দিলেই হবে না। রাষ্ট্র যখন খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তখন এনজিও বা মহাজনই হয় শেষ আশ্রয়। সংকটের গভীরে রাষ্ট্রীয় নীতি, bugetary allocation ও সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের দুর্বলতাই দায়ী। দেশে দুর্ভিক্ষ না থাকলেও ‘ক্ষুধা’ আছে, ‘food insecurity’ আছে এবং আছে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকা লক্ষাধিক পরিবার। মিনারুলের চিঠি এই নীরব কান্নার ভাষান্তর।

 

এখন আমাদের প্রয়োজন সমবেদনা নয়; কার্যকর নীতি। সর্বজনীন খাদ্যসহায়তা কর্মসূচি, সামাজিক নিরাপত্তাবলয়, বেকারভাতা, গ্রামীণ রেশনিং, কৃষিঋণ মওকুব এবং নগদ সহায়তার মতো বাস্তব পদক্ষেপ। একই সঙ্গে দরিদ্রপরিবারগুলোর সন্তানদের জন্য বিদ্যালয়ে দুপুরের খাবার নিশ্চিত করা, কর্মহীন কৃষিশ্রমিকদের কাজের নিশ্চয়তা (যেমন ‘৫০ দিনের কর্মসূচি’ বা ‘গ্রাম রিনিউয়াল প্রকল্প’) চালু করা জরুরি। আর শুধু অর্থ বিতরণ নয়; মনস্তাত্তি¡ক কাউন্সেলিং, হতাশাগ্রস্ত মানুষের জন্য হেল্পলাইন ও স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক সহমর্মিতার প্ল্যাটফর্ম তৈরিও জরুরি।

 

অনেকেই বলবেন, ব্যক্তি যদি জুয়া খেলেন, ঋণ নেন, দায় রাষ্ট্রের কী? কিন্তু প্রশ্ন হলো- কেন মানুষ এমন ঝুঁকিতে যায়? অনাহার, অনিশ্চয়তা ও সামাজিক অবহেলা মানুষের আচরণকে বিকৃত করে। মাদক, জুয়া এগুলো সবই দরিদ্রজীবনের মানসিকভাবে পালানোর পথ। কাজেই এর জন্যও সামাজিক কাঠামো দায়ী। শুধু নীতি প্রণয়ন নয়, নীতির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন, ইউনিয়ন পরিষদ এবং কমিউনিটি লিডারদেরও দায়িত্ব নিতে হবে, যাতে কেউ না খেয়ে মারা যাওয়ার আগে তাকে শনাক্ত করে সহায়তা দেওয়া যায়।

 

মিনারুলের এই মৃত্যু যদি আরেকটি পরিসংখ্যান হয়ে যায়, তা হলে আমরা কেবল ভবিষ্যতের আরেকটি মর্মান্তিক মৃত্যুর অপেক্ষা করব। স্মরণ রাখা উচিত, একটি সমষ্টিগত ব্যর্থতা কখনো ব্যক্তিগত ও পরিবারগত আত্মহত্যায় শেষ হয় না; এটি সমাজকে ভেতর থেকে ক্রমশ অবশ করে দেয়। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তিনি লিখেছিলেন: ‘আমি চাই সবাই ভালো থাকবেন।’ এটি আসলে আমাদের প্রতি এক নিষ্ঠুর প্রশ্নও: আমরা কি সত্যিই ভালো আছি, যদি চারপাশে অনাহারে মানুষ মরছে?

 

মিনারুলের এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, অর্থনৈতিক সংকট এবং দারিদ্র্য কতটা ভয়ংকর হতে পারে। এটি শুধু একটি পরিবারের সমাপ্তি নয়, এটি আমাদের সমাজের সেই অন্ধকার দিক, যা আমরা প্রায়ই এড়িয়ে চলি। এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সমাজে এমন আরো অনেক মিনারুল আছেন, যাঁরা নীরবে কষ্ট করছেন। মিনারুলের এই শেষ চিঠি ও আত্মহনন যেন আমাদের চোখ খুলে দেয়। যাতে আমরা বুঝতে পারি, ক্ষুধা শুধু পেটে লাগে না, লাগে মনেও। আর অপমান শুধু মুহূর্তের জন্য কষ্ট দেয় না, ধীরে ধীরে মানুষকে ভেতর থেকে শেষ করে দেয়।

 

মিনারুলের আত্মহনন ও শেষ চিঠি প্রশ্ন ছুঁেড় দিয়েছে- রাষ্ট্র কি কেবল ফাঁপা উন্নয়নের পরিসংখ্যান দেখাবে, নাকি মানুষের ক্ষুধার হিসাবটাকেও রাষ্ট্রীয় নীতির কেন্দ্রভাগে আনবে? যদি আজও খাদ্য ও ঋণের যাতনা মানুষকে পরিবারসহ মৃত্যুর পথে ঠেলে দেয়, তা হলে উন্নয়নের সব আলোচিত অর্জনই সংকুচিত হয়ে পড়ে। আমাদের উন্নয়নের সাফল্য তখনই অর্থবহ হবে, যদি আমরা নিশ্চিত করতে পারি কেউ ঋণ ও ক্ষুধার কাছে মাথা নত করে, সন্তানকে বুকে চেপে মৃত্যু বেছে না নেয়।

 

এখনও সময় আছে। আমাদের সমাজ যদি মিনারুল ও তার পরিবারের মৃত্যুকে প্রতিবাদ হিসেবে গ্রহণ করে, তবে এই মৃত্যু হয়তো সমাজের চোখ খুলে দিতে পারে। আমরা চাই মিনারুলের মৃত্যু যেন আরেকটি পরিসংখ্যান হয়ে না থাকে। যেন আমরা মানুষ হয়ে মানুষের কষ্ট বুঝতে শিখি, সময় থাকতে তাদের দিকে হাত বাড়াই। চাই একটি সত্যিকারের বৈষম্যহীন মানবিক রাষ্ট্র, যেখানে আর কোনো শিশুর মৃত্যু মঞ্চস্থ না হয় বাবা-মায়ের ঋণ ও ক্ষুধার যন্ত্রণার কারণে। এমন বাংলাদেশ গড়াই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট