
ওয়াশিংটন ডিসি বর্তমানে পরিণত হয়েছে বৈশ্বিক ট্যারিফ আলোচনার কেন্দ্রস্থলে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা সেখানে উপস্থিত হয়ে চেষ্টা করছেন ১ আগস্টের নির্ধারিত সময়সীমার আগে একটি চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছাতে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশসহ মোট ১৪টি দেশকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ৭ জুলাই এক চিঠির মাধ্যমে অবহিত করেছেন, তাদের ওপর নতুন আমদানি শুল্ক কার্যকর হবে ১ আগস্ট ২০২৫ থেকে। উল্লেখ্য, ২ এপ্রিল ঘোষিত প্রথম দফার ঘোষণায় বলা হয়েছিল এই নতুন শুল্ক প্রায় ৮০টিরও বেশি দেশের ওপর আরোপ করা হবে।
গত ৯০ দিনে অধিকাংশ দেশ ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ন্যায্য ও ভারসাম্যপূর্ণ শুল্কহার নিয়ে আলোচনায় বসলেও সময় ও জটিলতার কারণে একটি বিস্তৃত চুক্তি অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। এখন পর্যন্ত কেবল যুক্তরাজ্যই একমাত্র দেশ যারা ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে একটি ১০% শুল্কে চুক্তি সম্পাদন করতে পেরেছে- এটি সম্ভব হয়েছে মূলত যুক্তরাজ্যের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত থাকার কারণে।
আগের মার্কিন প্রেসিডেন্টদের চেয়ে ভিন্নভাবে ট্রাম্প প্রশাসন শুল্কনীতিতে এক ধরনের আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছে, বিশেষ করে যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। এর মূল লক্ষ্য হলো মার্কিন অভ্যন্তরীণ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও ট্যারিফের মাধ্যমে বার্ষিক বাজেটের জন্য অতিরিক্ত রাজস্ব আহরণ। মার্কিন কাস্টমস ও বর্ডার প্রোটেকশন (সিবিপি) এবং বাজেট ল্যাবের হিসাব অনুযায়ী আগামী এক দশকে ট্যারিফ থেকে প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলার রাজস্ব আসবে বলে অনুমান করা হয়েছে, যা ইতিমধ্যে ৪ জুলাই প্রেসিডেন্ট স্বাক্ষরিত কংগ্রেশনাল বাজেট বিলেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বার্ষিক ভিত্তিতে ট্যারিফ থেকে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্রের কোষাগারে যাবে।
তবে ১৪টি দেশ যারা এই শুল্ক সংক্রান্ত চিঠি পেয়েছে তারা সবাই নতুন হারকে অত্যধিক মনে করছে। বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত শুল্কহার নির্ধারিত হয়েছে ৩৫%, যা এপ্রিল মাসের ৩৭% থেকে সামান্য মাত্র ২% কম। বর্তমান আলোচনার ভিত্তিতে ধারণা করা হচ্ছে যে, ভবিষ্যতে যদি কোনো দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে পারে- এমন ধারণা ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়- তাহলে তারা শুল্কহার কিছুটা কমাতে রাজি হতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি আরও জটিল। একটি অনুন্নত অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশের বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের চাহিদা এমনিতেই সীমিত। ফলে “পারস্পরিক বাণিজ্য ভারসাম্য” বজায় রাখা বা আমদানি বাড়ানো আমাদের পক্ষে সহজ হবে না। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল এখন একটি গ্রহণযোগ্য সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। যদি ১ আগস্টের মধ্যে কোনো চুক্তি না হয়, তবে বাংলাদেশের সকল পণ্য আমদানির ওপর ৩৫% হারে শুল্ক কার্যকর হবে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (জগএ) খাত এমন শুল্কের চাপ সহ্য করতে পারবে না- এটি স্পষ্ট। ফলে আমাদের পক্ষে এই আলোচনায় সফল হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যর্থতার কোনো জায়গা নেই।
বিভিন্ন দেশ নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন কৌশল নিচ্ছে-কখনো জটিল, আবার কখনো সরল ও স্বচ্ছ। আমার ব্যক্তিগত মত, একটি স্বচ্ছ এবং সহজবোধ্য কৌশলই সবচেয়ে কার্যকর এবং দ্রুত ফলদায়ী হতে পারে।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বার্ষিক বাণিজ্য উদ্বৃত্ত প্রায় ৫ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলার। আমাদের মত একটি ছোট অর্থনীতি এই উদ্বৃত্ত একরাতে কমিয়ে আনতে পারবে না। তবে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে, ধরা যাক ১০ বছরের জন্য, আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে একটি যৌক্তিক রোডম্যাপ দেখাতে পারি যে কীভাবে এই উদ্বৃত্ত ধীরে ধীরে কমানো সম্ভব। এটি ২ থেকে ৩টি সম্ভাব্য চিত্রায়নের (scenario) মাধ্যমে উপস্থাপন করা যেতে পারে- যার ভিত্তি হবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির উপর। বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে, বাংলাদেশকে দেখাতে হবে কোন কোন মার্কিন পণ্য- যেমন জ্বালানি, তুলা, শস্য, বিমান ইত্যাদি- ভবিষ্যতে আমদানি করা হবে এবং প্রতি বছর কত পরিমাণ। ভবিষ্যৎ জিডিপি প্রবৃদ্ধির উপর ভিত্তি করে এটি প্রমাণ করা সম্ভব যে, বাংলাদেশ ধাপে ধাপে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়াতে পারবে এবং এর মাধ্যমে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত হ্রাস সম্ভব হবে।
এছাড়া আলোচনার একটি কৌশল হতে পারে বাংলাদেশের রিজার্ভ ব্যবহার করা। বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ডে নিয়মিতভাবে স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ করতে পারে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সদিচ্ছা এবং আর্থিক সংহতি প্রকাশ করবে, যার ইতিবাচক প্রভাব আলোচনায় পড়তে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই আলোচনায় সুফল পাওয়া এখন অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা মাত্র নয়, বরং অস্তিত্বের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
খালিদ আবেদিন, প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও, রিজেন ক্যাপিটাল এন্ড কনসাল্টিং, মেরিল্যান্ড, ইউএসএ