চট্টগ্রাম বুধবার, ২৬ মার্চ, ২০২৫

চট্টগ্রামের ভাষা ও ড. ইউনূস

ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন

২৩ মার্চ, ২০২৫ | ১২:৫৮ অপরাহ্ণ

ঘটনা-১

নেলসন ম্যান্ডেলার মায়ের ভাষা হল ‘খোছা’ (ঢড়যংধ)। কিন্তু বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান ইংরেজিতে। ১৯৯৩ সালের ২২ এপ্রিল ম্যান্ডেলা আসলেন জোহানেস-বার্গ থেকে ৬২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কালোদের জন্য নির্ধারিত সেবোকেঙ হাসপাতাল পরিদর্শনে। আমি তখন সেই হাসপাতালে কর্মরত এবং ঐদিন আমার সৌভাগ্য হয়েছিল নেলসন ম্যান্ডেলার সাথে করমর্দন করার। হাসপাতালের ৯০ ভাগ কর্মী কালো এবং প্রায় সবাই ইংরেজি ও খোছা ভাষায় পারদর্শী।

ম্যান্ডেলা আসলেন তার চিরাচরিত স্মার্ট ড্রেস স্যুটেড বুটেড অবস্থায়, সবার সাথে ইংরেজিতে হাই হ্যালো করলেন। ম্যান্ডেলার সাথে ছিলেন এএনসির নেতা টোকিও স্যাকওয়ালে, রবার্ট ম্যাকব্রাইড (মাগুস বার বোম্বিং এ জড়িত) ও আরো অনেকে। হাসপাতালের সবাই জড়িত হলো ম্যান্ডেলার ভাষণ শোনার জন্য। ম্যান্ডেলা তার পুরো বক্তৃতা দিলেন খোছা ভাষায়। দর্শক সারি থেকে মুহুর্মুহূ করতালি ও উলুধ্বনিতে নেলসন ম্যান্ডেলা তার ভাষণ শেষ করলেন নিজের ভাষায়। ফুটানি দেখানোর জন্য ইংরেজি ভাষার ব্যবহার করেন নাই। এটা হল নিজের মায়ের ভাষার প্রতি সম্মান এবং গণমানুষের সাথে কানেক্টেড হওয়ার হাতিয়ার।

 

ঘটনা-২

কিছুদিন আগে কানাডায় আমার হাসপাতালে টিউমার বোর্ডে মিটিংয়ে ‘বারুয়া’ নামে একটি রোগীর কেইস ডিসকাশন হলো। মিটিং শেষে আমি ফাইল নিয়ে নাম দেখলাম এম বড়ুয়া (ছদ্মনাম)। তখন আমার মনে হলো এই লোক চট্টগ্রামের হবে। কারণ বেশির ভাগ বড়ুয়া চট্টগ্রামের অধিবাসী। কিন্তু পেশেন্ট প্রাইভেসি ‘ল’ এর কারণে আমি এই রোগী সম্পর্কে বেশি আগ্রহ দেখাতে পারছিলাম না। যাই হোক একদিন ওয়েটিং রুমে একজন লোকের গেটআপ দেখে মনে হল তিনি বাংলাদেশি। আমি উনার পাশে গিয়ে না তাকিয়ে শুধু বল্লাম ‘বদ্দা অনর বাড়ি কডে?’ ব্যাস, তারপর তো ইতিহাস। উনি যেন মুহূর্তের মধ্যে ভুলে গেলেন যে উনি ক্যানসারে আক্রান্ত।

 

একজন চাটগাঁইয়া ক্যানসারের ডাক্তারকে পেয়ে এত খুশি হয়েছিলেন বলার মত না। বিশেষ করে আমার সাথে ওয়েটিং রুমে শতভাগ সাদা রোগীর মাঝে চাটগাঁইয়াতে কথা বলছেন অনর্গল, উনার চোখে মুখে আমি যে আনন্দ দেখেছি মনে হচ্ছিল কিছুক্ষণের জন্য উনি উনার মরণব্যাধির কথা ভুলে গেছেন। এটাই হচ্ছে মায়ের ভাষার পাওয়ার।

 

ঘটনা-৩

১৯২২ সালের এক দুপুরে একজন রোগী হুইল চেয়ারে করে রুমে ঢুকলেন। বয়স ৮৩ বৎসর। সাথে উনার স্ত্রী ও কন্যা। ভদ্রলোক এডভান্সড স্টেজ ফুসফুস ক্যানসারে ভুগছিলেন। ইতিমধ্যে থোরাসিক সার্জন ও মেডিকেল অনকোলজিস্টের চিকিৎসাধীন ছিলেন। সবাই সাদা চামড়ার ডাক্তার। এখন রেফার হয়ে এসেছেন আমার কাছে। নাম এস মেহতা (ছদ্মনাম) এবং ভারতীয়। উনি হইল চেয়ারে মলিন চেহারায় বসে আছেন। আমি উনার কাছে গিয়ে বল্লাম ‘চাচাজি আপ ক্যায়সা হ্যায়? আমার মুখে হিন্দী বুলি শুনে উনার মলিন চেহারায় ফুটে উঠলো পূর্ণিমার চাঁদের আলো। মনে হলো উনি যেন কিছুটা ফুয়েল পেলেন এবং সাথে সাথে বলে উঠলেন ‘ব্যাটা, আপ হিন্দি জানতা! আমি বল্লাম থোড়া, থোড়া। হিন্দি মুভি দেখার কারণেই টুকটাক হিন্দি আমি বলতে পারি।

 

তারপর খুশিতে উনার ক্যানসারের কথা বাদ দিয়ে শুরু করলেন কিভাবে উনি ১৯৭০ সালে পাঞ্জাবের একটি গ্রাম থেকে কানাডা আসলেন এবং কমিউনিটি কলেজের শিক্ষক হিসাবে অবসরে গেলেন। উনার সারি সারি হিন্দি মুভির ভিডিও ক্যাসেটের কালেকশনের গল্প এবং আরো কত কি। যাওয়ার আগে আমাকে বল্লেন যে, এতদিন অনেক বড় বড় ডাক্তার দেখিয়েছেন ঠিকই কিন্তু মন খুলে অনেক কিছুই বলতে পারেন নাই। আজ উনি অনেক খুশি যে কিছুটা হলেও মায়ের ভাষায় ডাক্তারের সাথে কথা বলতে পেরেছেন। কিছুদিন পরই মেহতা সাহেব পরলোক গমন করেন এবং উনার মেয়ে আমাকে চিঠিতে বলেছেন যে, তাদের বাবা অনেক শান্তি নিয়ে এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে গেছেন। কারণ যাওয়ার আগে কিছুটা হলেও মায়ের ভাষায় ডাক্তারের সাথে কথা বলতে পেরেছেন। এটা হলো মায়ের ভাষায় কথা বলার শান্তি।

 

ঘটনা-৪, ড. ইউনূস, ২০২৫

প্রফেসর ইউনূস এই রোজায় রোহিঙ্গাদের সমাবেশে চট্টগ্রামের ভাষায় বক্তৃতা দিয়েছেন এবং তাদের প্রতিনিধিদের সাথে চাটগাঁর ভাষায় অনর্গল কথা বলেছেন তাদের প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে। আমি নিশ্চিত এই বক্তৃতা ও কথোপকথন রোহিঙ্গাদের মাথায় ও অন্তরে প্রোথিত হয়ে গেছে। আমার ধারণা অচিরেই তারা ফিরে যাবে তাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে। এটাই হচ্ছে মাতৃভাষার রাজনীতি অথবা কূটনীতি। আমি নিশ্চিত চাটগাঁর ভাষায় কথা বলে ড. ইউনুস রোহিঙ্গাদের মাথায় দেশে ফিরে যাওয়ার চেতনাকে দ্বিগুণ করে দিয়েছেন। মাতৃভাষার রাজনীতি যে কতটা শক্তিশালী তা বাঙালিরা ইতিহাসে প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ পৃথিবীতে একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে।

 

ঘটনা ০৫, ল্যাংগুয়েজ অ্যাপ

আমার এখন ভিন্ন ভাষী রোগী দেখার সময় ব্যবহার করি ল্যাংগুয়েজ অ্যাপ। এই অ্যাপের মাধ্যমে মুহূর্তের ভেতর যে কোন ভাষার ট্রান্সেলেটরের মুখ কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে উঠে এবং রোগী ও ডাক্তারের মাঝের কথোপকথনকে সহজ করে দেয়। এটাই হচ্ছে টেকনোলজির মাধ্যমে ভাষার বিজয়। আট বিলিয়ন মানুষের পৃথিবীতে সাত হাজারের বেশি ভাষায় মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করে থাকে।

 

চট্টগ্রামের ভাষায় ১৬ মিলিয়ন মানুষ কথা বলেন বলে জানা যায়। তবে আজকাল শহরে বসবাসরত চট্টগ্রামের অনেক তরুণ-তরুণী চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলতে পারেন না, অথবা চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলতে লজ্জাবোধ করেন। আমার মনে হয় তরুণ প্রজন্ম একটি ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে নিজের মায়ের মুখের ভাষায় কথা বলার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলছে। প্রমিত বাংলার পাশাপাশি নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা দোষের কিংবা লজ্জার বিষয় না, বরং গর্ভের বিষয়।

 

চট্টগ্রামের তরুণ প্রজন্মের প্রতি আমার আহ্বান থাকবে বেশি বেশি করে চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলুন। সবার কাছে সব চেয়ে মধুর হচ্ছে তার মায়ের মুখের ভাষা।

 

লেখক: রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, সেইন্ট জন রিজিওনাল হসপিটাল, নিউ ব্রুান্সউইক ; এসিস্টেন্ট প্রফেসর, ডালহাউসি ইউনিভার্সিটি, কানাডা।

 

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট