কবি বলেছেন, তাঁর কাব্য ভাষায়- ‘এমন জীবন তুমি করিবে গঠন,/ মরিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন।’ জীবন একটাই। পৃথিবীতে দ্বিতীয়বার আসার কোন সুযোগ নেই। তাই এই একটা জীবনকেই অর্থবহ করে তোলা মানুষের কাজ। আর অর্থবহ করতে গিয়ে নৈতিক-অনৈতিক, ন্যায়-অন্যায় বিচার-বিবেচনা করে চলা বুদ্ধিমানের কাজ। কেননা ভুলে যাওয়া চলবেনা যে, আমাদেরকে পুনরায় ফিরে যেতে হবে স্রষ্টার দিকে। হিসেব দিতে হবে জীবনের প্রতিটি কৃতকর্মের। অতএব আমরা পৃথিবীতে যাচ্ছেতাই করতে পারিনা; যেনতেনভাবে জীবন পরিচালনা করতে পারিনা। আমাদের জীবন এমনভাবে পরিচালিত হওয়া চাই, যেভাবে পরিচালিত হলে দুনিয়ার জীবন গোছালো ও সৌন্দর্যমণ্ডিত হয় এবং পরকালেও উত্তম প্রতিদানের প্রাপ্তির আশা করা যায়। বস্তুত স্বয়ং আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনই আমাদেরকে তাঁর নিকট এইরুপ দুনিয়াবি এবং পরকালীন জীবন প্রার্থনা করার জন্য পবিত্র কোরআনে শিখিয়ে দিয়েছেন এভাবে- ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়ায় কল্যাণ দান করুন এবং আখিরাতেও কল্যাণের অংশীদার করুন।
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতের জীবন কেমন কাম্য হওয়া উচিত শুধু তা শিখিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত হননি বরং আমাদের দুনিয়াবি জীবন ‘কোন দর্শনের আলোকে পরিচালিত হলে তা কল্যাণকর হবে’- সেই পথরেখাও বাতলে দিয়েছেন পবিত্র কোরআনের সূরা ফাতিহাসহ আরও অসংখ্য সূরা-আয়াতে পাকে। সূরা ফাতিহার কথাই বলি- আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন বলেন, ইহদিনাস সীরাত্বাল মুস্তাকিম। সীরাত্বাল্ লাযিনা আন ‘আমতা ‘আলাইহিম- আমাদেরকে সরল সঠিক পথে অটল রাখুন, তাঁদের পথে, যাঁদের আপনি অনুগ্রহ করেছেন। আল্লাহ্র নেয়ামতপ্রাপ্ত বান্দারা হলেন নবী, রাসূল, সিদ্দিকীন, শুহাদা, মুমিন, মুত্তাকী এবং আউলিয়া কেরাম, তাঁদের মত-পথে চললে মুক্তির সম্ভাবনা অবারিত থাকে। তাঁদের জীবন দর্শনের আলোকে জীবন পরিচালিত করলেই দুনিয়াবি কল্যাণ এবং পরকালীন কল্যাণ অর্জিত হয়। মূলত তাঁরাই হলেন পথপ্রদর্শক।
আজকে আমরা তেমনই একটি জীবন ‘দর্শন’ বিবেচনায় আনতে চাই, যে দর্শন কারো ব্যক্তিজীবনে যদি প্রতিফলিত হয় তবে ব্যক্তিজীবন হয়ে উঠবে কল্যাণময়; পারিবারিক জীবনে যদি প্রতিফলিত হয় তবে পারিবারিক জীবন হয়ে উঠবে সুখময়; যদি ধর্মীয়জীবনে প্রতিফলিত হয় তবে ধর্মীয় জীবন হয়ে উঠবে পুণ্যময়; যদি সামাজিক জীবনে প্রতিফলিত হয় তবে সমাজে পুনরায় ফিরে আসবে শান্তির আবহ; যদি রাজনৈতিক জীবনে প্রতিফলিত হয় তবে দেশ হবে শৃঙ্খলাময়। সর্বোপরি যে দর্শনের আলোকে জীবন গঠিত হলে দুনিয়াবি ও পরকালীন জীবন হবে কল্যাণময়। ঠিক তেমনই একটি দর্শন হচ্ছে, মাইজভাণ্ডারী দর্শন তথা ‘মাইজভাণ্ডারীয়া ত্বরিকা’র দর্শন। এই ত্বরিকার প্রবর্তক আউলাদে রাসূল সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়ালিহি ওয়াসাল্লাম, খাতেমুল আউলিয়া হুজুর গাউসুল আযম হযরত মাওলানা শাহসুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (ক.)। আলোচ্য প্রবন্ধে মাইজভাণ্ডারী দর্শনে যে সকল বিষয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত সে সকল বিষয় নিয়ে যৎসামান্য আলোকপাত করা হলো।
নৈতিকতা: নৈতিকতা বলতে আমরা বুঝি নীতির অনুশীলন, ন্যায়ের চর্চা। সততা, সদাচার, সৌজন্যমূলক আচরণ, সুন্দর স্বভাব, সুকথা ও উন্নত চরিত্র- এ সবকিছুর সমন্বয়ই হল নৈতিকতা। নীতিহীন মানুষ চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও নিকৃষ্ট। মহান আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, যাদের হৃদয় আছে কিন্তু তা দিয়ে উপলব্ধি করে না, চোখ আছে কিন্তু তা দিয়ে দেখে না, কান আছে কিন্তু তা দিয়ে শোনে না- এরা হল চতুষ্পদ জন্তুর মতো। বরং তার চেয়েও পথভ্রষ্ট [সূরা আরাফ:৭: আয়াতাংশ ১৭৯]। সমাজে যত প্রকার অন্যায়, অবিচার, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা সংঘটিত হয় সেসব অপকর্ম শুধুমাত্র নীতিহারা মানুষের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। নৈতিক গুণাবলি সম্পন্ন ব্যক্তি কখনো কোন অন্যায় কাজ করেনা, নৈতিক শক্তির কারণে জাগ্রত বিবেকের তাড়নায় তা করা সম্ভবও নয়। তাই মাইজভাণ্ডারী দর্শন নৈতিক চরিত্রের উৎকর্ষতার প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করে। গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী (ক.) মানুষকে সব সময় নৈতিকতার দীক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে বলতেন, কবুতরের মত বাছিয়া খাও, হারাম খাইওনা। নিজ সন্তান সন্ততি নিয়া খোদার প্রশংসা কর।
বিচারসাম্য: বিচার ব্যবস্থার অসমতার কারণেই সমাজে যাবতীয় বিশৃঙ্খলা-অনিয়ম দেখা দেয়। সুসম বণ্টনের অভাবে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ ব্যবধান বৃদ্ধির সাথে সাথে দরিদ্রগোষ্ঠীর প্রতি অন্যায়, অবিচার-জুলুমের মাত্রাও দিন দিন বেড়ে চলেছে। তাই সমাজ থেকে ধনী-দরিদ্রের ভারসাম্যহীন এই অবস্থা দূরীভূত করার লক্ষ্যে মাইজভাণ্ডারী দর্শন ‘আদলে মোতলক তথা বিচারসাম্য’র প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করে। এটিকে শুধুমাত্র লেখা ও কথাবার্তায় সীমিত না রেখে, বরং আক্ষরিক অর্থে সমাজের দুস্থ-দরিদ্র মানুষগুলোকে স্বাবলম্বী করে বৈষম্যমূলক সমাজে পুনরায় ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে “শাহানশাহ্ সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.) ট্রাস্ট”। এছাড়া দেশের প্রতিটি অঞ্চলে সংগঠিত ‘মাইজভাণ্ডারী গাউসিয়া হক কমিটি’র শাখাসমূহ বৈষম্য দূরীকরণ ও দারিদ্র বিমোচনে স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকা নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
মানবিকতা: নজরুলের ভাষায়- আরতির থালা, “তসবির মালা আসিবেনা কোন কাজে,/ মানুষ করিবে মানুষের সেবা, আর বাকি সব বাজে।” মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করা মহাপুণ্যের কাজ। রাহমাতুল্লিল আলামিন রাসূল (দ.) জীবনের প্রতিটি ক্ষণেই মানুষের সেবা করেছেন, অলি আল্লাহ্গণ করেছেন। পরম্পরায় মাইজভাণ্ডারী দর্শনও মানবিকতার এই দীক্ষা দেয়। আউলাদে রাসূল (দ.) হুজুর গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী অভাবী প্রতিবেশিদেরকে অকাতরে দান করতেন, রাতে ঘুমিয়ে থাকা খাদেম-কর্মচারীদের অবস্থা দেখতেন। এমনকি অনেক সময় তাদের মাথায় বালিশ না থাকলে নিজের গায়ের চাদর ঘুমন্ত খাদেমের মাথার নিচে দিয়ে দিতেন। মানবিকতার এর চেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আর কীই বা হতে পারে! একবিংশ শতাব্দির এই যুগে এসে যেখানে সমাজের প্রতিটা পদে পদে মানবতা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে সেখানে মাইজভাণ্ডারী দর্শনের প্রকৃত অনুসারীরা দিন দিন মানবতার খেদমতের আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন বৃহৎ থেকে বৃহত্তর পর্যায়ে। শাহানশাহ্ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.) ট্রাস্ট এবং সারাদেশ জুড়ে মাইজভাণ্ডারী গাউসিয়া হক কমিটি বাংলাদেশের শাখা কমিটিসমূহের সার্বিক কর্মকাণ্ডের দিকে তাকালেই এর বাস্তবতা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠে।
আত্মনির্ভরশীলতা: পরমুখাপেক্ষীতার কারণে মানুষের ব্যক্তিত্ব বিনষ্ট হয়। সমাজে অপমানজনক জীবনযাপন করতে হয়। ফলে অধিকাংশ সময় মানুষ অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে আত্মনির্ভরশীল মানুষ সমাজে ব্যক্তিত্ব নিয়ে সম্মানজনকভাবে মাথা উঁচু করে বসবাস করে। আত্মনির্ভরশীল হয়ে জীবন যাপন করার মহৎ শিক্ষা দিয়েছেন স্বয়ং নবিবর হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (দ.)। যা কবির ভাষায় ফুটে উঠেছে এভাবে- “নবীর শিক্ষা করনা ভিক্ষা, মেহনত কর সবে।” হুজুর গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী (ক.)ও মানুষকে একই শিক্ষা প্রদান করেছেন। তাঁর এমনই একটি অমিয় বাণী হল- “নিজের হাতে পাকাইয়া খাও, পরের হাতে খাইও না।” বিশ্বঅলি শাহানশাহ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.) মানুষকে কাজের প্রতি উৎসাহিত করে বলেন- “কাজের জন্য জগৎ জীবন ও আল্লাহ্ রাসূল (দ.)’র বিধান। ভাল কাজও ইবাদত। অলস হয়ে বেকার বসে থেক না।” এভাবে মাইজভাণ্ডারী মনীষীগণ মানুষকে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন সময়ে। মহাগ্রন্থ আল্ কোরআনেও আত্মনির্ভরশীল হওয়ার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। উল্লেখ্য, মাইজভাণ্ডারী দর্শন ‘সপ্ত পদ্ধতি বা উসুলে সাবআ’র প্রথম ধাপই হল ‘আত্মনির্ভরশীল হওয়া’।
পরদোষ পরিহার: অন্যের দোষ তালাশ করা আমাদের সহজাত অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অপরের ছিদ্রান্বেষণে মত্ত লোকদের কারণেই ব্যক্তি-ব্যক্তিতে, পরিবার-পরিবারে কলহ বিবাদের দানা বাঁধে। তাই মাইজভাণ্ডারী দর্শন ‘ন্যায়-নীতি বিরোধী যাবতীয় অপকর্মের প্রতিবাদ ছাড়া’ অপরের দোষ ত্রুটি তালাশ করতে নিষেধ করে এবং নিজের দোষ অনুসন্ধান করার প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়। এ প্রসঙ্গে হুজুর গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী বলেন- “তোমরা বাহাস করিও না”; “কবুতরের মত বাছিয়া খাও।” হুজুর গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর শিখিয়ে যাওয়া নীতি-দর্শনকে তাঁর একমাত্র মনোনীত সাজ্জাদানশীন অছিয়ে গাউসুল আযম হযরত শাহসুফি সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (ক.) কবিতায় রূপদান করে বলেন- “পরদোষ পরিহারে নিজ দোষ ধ্যানে।”
অনর্থ পরিহার: মাইজভাণ্ডারী দর্শনের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হল ফলাফলশুন্য কাজ পরিহার করা। অপ্রয়োজনীয় কাজ এবং অপ্রয়োজনীয় কথার দরুণ বিভিন্ন ঝামেলার সৃষ্টি হয়। হুজুর গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী সময়ে সময়ে বলতেন- “এখানে হাওয়া (অনর্থ) দাফন করা হইয়াছে।” অছিয়ে গাউসুল আযম হযরত শাহসুফি সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (ক.) কাব্যিকরূপে বলেন- “অনর্থেরী পরিহারে তাকওয়ার ঝলক দেখেছি,/পরণেতে অলির পরণ পন্থা নির্দেশ দিতেছি।” উল্লেখ্য; পরদোষ এবং অনর্থ পরিহার করা মাইজভাণ্ডারী দর্শন সপ্তকর্ম পদ্ধতির দ্বিতীয় ধাপ তথা ফানা আনিল হাওয়া।
কু-প্রবৃত্তির বিনাশ: মানুষের প্রবৃত্তি তথা ইচ্ছাশক্তি দুরকম হয়ে থাকে। সু-প্রবৃত্তি এবং কু-প্রবৃত্তি। এই দুই ইচ্ছাশক্তির মধ্যে যদি কু-প্রবৃত্তি কোন ব্যক্তির মাঝে অধিক প্রভাব বিস্তার করে তখন ঐ ব্যক্তি পাপ কাজে জড়িয়ে পড়ে। আর এর বিপরীত হলে ব্যক্তি পুণ্য কাজে ধাবিত হয়। মাইজভাণ্ডারী দর্শন মানব অন্তরে বিরাজিত কু-প্রবৃত্তির বিনাশ সাধন করে সু-প্রবৃত্তি তথা খোদার ইচ্ছা শক্তিকে প্রাধান্য দেওয়ার অনুশীলনের শিক্ষা দেয়। হুজুর গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী মানুষকে বলতেন- “ফেরেশতা কালেব বনিয়া যাও।” অর্থাৎ ফেরেশতার ন্যায় খোদার হুকুম মত কাজ কর। উল্লেখ্য, কু-প্রবৃত্তির বিনাশ মাইজভাণ্ডারী দর্শন সপ্তকর্ম পদ্ধতির তৃতীয় ধাপ তথা ‘ফানা আনিল এরাদা’। ধৈর্য ও সহনশীলতা: ধৈর্য ও সহনশীলতা মহত্তে¡র প্রতীক। ধৈর্যের মাধ্যমেই সফলতা এবং কাঙ্খিত ফলাফল সুনিশ্চিত হয়। এজন্যই ধৈর্যের শিক্ষা দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ্ পাক রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে। তিনি বলেন- “ওয়াসতা ইনু বিস সবরি ওয়াস সালাহ্”, “ইন্নাল্লাহা মা‘আস সবিরিন।” অর্থাৎ “তোমরা ধৈর্য এবং নামাযের মাধ্যমে আল্লাহ্র নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর”, “নিশ্চয় আল্লাহ্ ধৈর্যশীলদের সঙ্গেই রয়েছেন।” হুজুর গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীও কঠিন বিপদে ভক্তদেরকে ধৈর্যধারণ করার নির্দেশ প্রদান করতেন। এমনকি ঘরে একমুঠো খাবার না থাকার সময়ও ধৈর্যধারণ করেছেন, পরম করুণাময়ের উপর ভরসা করেছেন তিনি। এটি তাওয়াক্কুলের পর্যায়ভুক্ত। উল্লেখ্য ; ধৈর্য ও সহনশীলতা মাইজভাণ্ডারী সপ্তকর্ম পদ্ধতির চতুর্থ ধাপ তথা ‘মউতে আবইয়াজ’।
সমালোচনাকারীকে বন্ধু মনে করা: আমরা অন্যের সমালোচনা করতে যতটা পছন্দ করি ঠিক ততটাই নিজের সমালোচনাকারীকে ঘৃণা করি। ফলে সমালোচনাকারীর সাথে শত্রুতার সম্পর্ক গড়ে উঠে। হয় কথা কাটাকাটি। আর এ কথা কাটাকাটি অনেক সময় রুপ নেয় হাতাহাতিতে। আবার কখনো এর চেয়েও জঘন্য কিছু ঘটে যায়। কিন্তু মাইজভাণ্ডারী দর্শন সমালোচককে বন্ধুর চোখে দেখার নির্দেশ দেয়। কেননা সমালোচকের সমালোচনার কারণে নিজের দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া যায়। ফলে নিজের মাঝে বিদ্যমান দোষ-ত্রুটিগুলো সংশোধন করে নেওয়া যায়। আর যদি দোষ-ত্রুটি না থাকে তবে আল্লাহ্র দরবারে এর জন্য শুকরিয়া আদায় করা যায়। উল্লেখ্য, সমালোচনাকারীকে বন্ধু মনে করা মাইজভাণ্ডারী দর্শন সপ্তকর্ম পদ্ধতির পঞ্চম ধাপ তথা ‘মউতে আসওয়াদ’।
কামনা-লালসা হতে বিরত থাকা: লোভ-লালসা এবং অনিয়ন্ত্রিত কামভাব যত পাপের মূল। এসবের ফাঁদে পড়ে মানুষ যাবতীয় অপকর্মে জড়িয়ে যায়। ফলে পরিবারে, সমাজে, দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। মাইজভাণ্ডারী দর্শন অতি লোভ এবং কামভাব মুক্ত জীবন পরিচালনার নির্দেশ দেয়। হুজুর গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী ভক্তদেরকে কাম-লালসাহীন একটি স্বচ্ছ পরিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে তাঁর নিকট আসার নির্দেশ দিতেন।
নির্বিলাস জীবন-যাপন: পবিত্র কোরআনের বাণী- “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।” অর্থাৎ “নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে এসেছি আবার তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তন করব।” কী উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়েছে তাও পবিত্র কোরআনে বিঘোষিত হয়েছে- “ওয়ামা খালাকতুল জিন্না ওয়াল ইনসা ইল্লা লিয়া‘বুদুন।” অর্থাৎ আমি জ্বিন এবং মানুষকে সৃষ্টি করেছি শুধুই আমার ইবাদত তথা পরিচয় অন্বেষু করার জন্য। অথচ আমরা তা ভুলে গিয়ে জীবনকে কীভাবে আরাম, আয়েস ও বিলাসিতায় পরিপূর্ণ করা যায়- সেই খেয়ালে মত্ত। এজন্যই মাইজভাণ্ডারী দর্শন নির্বিলাস জীবন যাপনের শিক্ষা দেয়। উল্লেখ্য, নির্বিলাস জীবন যাপন করা মাইজভাণ্ডারী দর্শনের সপ্তকর্ম পদ্ধতির সপ্তম ধাপ তথা ‘মউতে আখজার’। মাইজভাণ্ডারী দর্শন ঐশী প্রেমের শিক্ষা দেয়। ঐশী প্রেমের সহজ অর্থ হল খোদা প্রেম। স্রষ্টা এবং সৃষ্টির সাথে যে সম্পর্ক তা হল প্রেমের সম্পর্ক; ভালবাসার সম্পর্ক। যে পথ অনুসরণে ইহকালে ও পরকালে সর্বোত্তম কল্যাণ লাভ হয়- মানুষকে সে পথ অনুসরণ করানোই মাইজভাণ্ডারী দর্শন। সুতরাং সংকল্প করা প্রয়োজন, আমরা প্রথমে মাইজভাণ্ডারী দর্শনের আলোকে নিজেদের জীবন গঠন করে নিজেরা নৈতিক গুণাবলি সম্পন্ন আলোকিত মানুষরুপে গড়ে উঠতে সচেষ্ট হব তৎপর নিজেদের ভেতর ধারণ করা মাইজভাণ্ডারী দর্শনের আলো দিয়ে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রকে আলোকিত করব। ইনশাআল্লাহ্। আমাদের জীবন হোক কল্যাণময়, পরিবার হোক সুখময়, সমাজ হোক শান্তিময়, রাষ্ট্র হোক শৃঙ্খলাময়। পরন্তু পরকালও হোক শান্তিময়, মঙ্গলময়। আমিন। বেহুরমাতে জাদ্দিল হাসানি ওয়াল হোসাইন।
পূর্বকোণ/ইব