চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০২৫

ট্রাম্পের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিলের আদেশ চ্যালেঞ্জ: ২২ অঙ্গরাজ্য ও ২ শহরের মামলা

২২ জানুয়ারি, ২০২৫ | ৫:০৬ অপরাহ্ণ

আমেরিকায় জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিলের নির্বাহী আদেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রিত ২২টি অঙ্গরাজ্য ও নাগরিক অধিকার সংগঠন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে আইনি উপায়ে মোকাবিলা করতে মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) আদালতে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়া তার এই আদেশকে মার্কিন সংবিধানের লঙ্ঘন বলে বোস্টন ও সিয়াটলের ফেডারেল আদালতে দুটি মামলা দায়ের করেছে ওয়াশিংটন ডিসি ও সিটি অব স্যান ফ্র্যানসিসকো। অঙ্গরাজ্য ও শহরগুলোর কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি এ আইনি লড়াইয়ে শরিক হয়েছে বিভিন্ন নাগরিক অধিকার সংগঠনও।

 

ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেল আন্দ্রেয়া জয় ক্যাম্পবেল তার কার্যালয় থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলেছেন, অভিবাসনের ওপর ট্রাম্পের কঠোরতা হ্রাস করতে এসব মামলা করা হয়েছে। তার আদেশ বাস্তবায়িত হলে আধুনিক মার্কিন ইতিহাসে প্রথমবার বছরে দেড় লাখ শিশু নাগরিকত্ব বঞ্চিত হবে। এছাড়া, আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন , অভিবাসী সংগঠন এবং একজন প্রসূতি মায়ের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

 

অঙ্গরাজ্যগুলোর দাবি, নাগরিকত্ব হারালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা স্বাস্থ্য বিমার মতো ফেডারেল সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। পরবর্তীতে দেশটিতে বৈধভাবে কাজ করা বা ভোটাধিকার প্রয়োগ করাও সম্ভব হবে না। নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেল ম্যাথিউ প্ল্যাটকিন এক বিবৃতিতে বলেছেন, আমাদের দেশের বসবাসকারীদের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় তাদের পাশে আমরা সবসময় আছি। এই মামলাগুলোর মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে আমরা সুস্পষ্টভাবে তা জানিয়ে দিতে চাই। মামলায় আরও বলা হয়েছে, ‘বৃহত্তর পটভূমিতে প্রেসিডেন্টের অভিবাসন আইন প্রণয়নের ক্ষমতা আছে। তা সত্ত্বেও নাগরিকত্বের অধিকার কেড়ে নেওয়ার নির্দেশ প্রেসিডেন্টের আইনি এখতিয়ারবহির্ভূত।’

 

ম্যাসাচুসেটস ও নিউ হ্যাম্পশায়ারে দায়ের হওয়া মামলাগুলোতে আদালতের বিচারকেরা আদেশ দিলে তা বোস্টনভিত্তিক ফার্স্ট ইউএস সার্কিট কোট অব আপিল পর্যালোচনা করে দেখবেন। এ আদালতের পাঁচ ফেডারেল বিচারপতির সবাই ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্টদের নিয়োগ পাওয়া, জাতীয় পর্যায়ে যা বিরল ঘটনা।
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে ফিরে শতাধিক নির্বাহী আদেশে সই করেন মি. ট্রাম্প। যার মধ্যে অন্যতম ছিল জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব আইন ( Birthright) বাতিল। দেড়শ বছরের পুরনো সাংবিধানিক অধিকার বাতিল আদেশ স্বাক্ষরের পর প্রেসিডেন্ট নিজেই আশঙ্কা করেছিলেন যে, তার এই সিদ্ধান্ত আইনি চ্যালেঞ্জে পড়তে পারে।

ট্রাম্প দায়িত্ব নিয়েই ফেডারেল সরকারের সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন, কোনো অবৈধ অভিবাসী অথবা সাময়িক ভিসা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন, এমন কেউ সন্তান জন্ম দিলে সেই শিশুকে যেন মার্কিন নাগরিকত্বসংক্রান্ত নথি দেওয়া না হয়। অর্থাৎ এখন থেকে ৩০ দিন পর যে শিশু জন্ম নেবে, তাদের বাবা-মা দুজনের একজন যদি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক না হন বা গ্রিন কার্ডধারী না হন, তাহলে সেই শিশুকে যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্ট ও ভিসা দেয়া হবে না। 

ট্রাম্প এ–সংক্রান্ত নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করার পরপরই আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন সোমবার এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া শিশুকে নাগরিকত্ব না দেওয়ার আদেশ শুধু অসাংবিধানিক নয়, একই সঙ্গে তা মার্কিন মূল্যবোধের বেপরোয়া ও নির্মম প্রত্যাখ্যান।’

ট্রাম্প দীর্ঘদিন থেকে এই নীতি পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে এটি বাস্তবায়ন করা সহজ হবে না।ট্রাম্পের আদেশটি সেই সকল অভিবাসীদের সন্তানের জন্য নাগরিকত্ব অস্বীকার করার কথা বলে, যারা অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন বা যাদের ভিসা অস্থায়ী। তবে এই আদেশটি পূর্ববর্তী নাগরিকত্ব অর্জনকারীদের ওপর প্রযোজ্য হবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিকত্ব সুবিধা নিয়ে নতুন নিয়ম ট্রাম্প কীভাবে কার্যকর করতে চান, তাও এখনো অস্পষ্ট । অধিকাংশ আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এই সাংবিধানিক অধিকার বাতিল করা সম্ভব নয় এবং এটি আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। কারণ, জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের এ সুবিধা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে সংরক্ষিত একটি বিষয়। একটি সাংবিধানিক সংশোধনী জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিল করতে পারে। তবে এর জন্য প্রতিনিধি পরিষদ এবং সিনেট উভয় স্থানেই দুই-তৃতীয়াংশ ভোট এবং যুক্তরাষ্ট্রের তিন-চতুর্থাংশ রাজ্যের অনুমোদন প্রয়োজন।

 

মার্কিন সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীতে ‘জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব’ নীতিমালা রয়েছে । এতে বলা হয়, ‘যে সব ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ বা নাগরিকত্ব লাভ করেছেন এবং সেখানে শাসনের অধীনে আছেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এবং যেই রাজ্যে বাস করেন, সেই রাজ্যের নাগরিক।’

মি. ট্রাম্প জানান, জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়ার (সাংবিধানিক) অধিকারটি একেবারে হাস্যকর এবং তার বিশ্বাস এই বিধান পাল্টে দেয়ার জন্য ভালো আইনগত যুক্তি আছে। ট্রাম্প স্পষ্টভাবেই বলেন, তিনি জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বন্ধ করতে চান কারণ এটি ‘হাস্যকর’।

এনবিসির ‘মিট দ্য প্রেস’-এ ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি মনে করেন অবৈধ অভিবাসীদের সন্তানদের তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে নির্বাসিত করা উচিত, যদিও তারা যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেছে। ট্রাম্প ডিসেম্বর মাসে বলেছিলেন, ‘আমি চাই না পরিবারগুলো ভেঙে যাক। তাহলে একমাত্র উপায় হল, আপনাকে পরিবারগুলোকে একসঙ্গে রাখতে হবে এবং তাদের সবাইকে ফেরত পাঠাতে হবে।’

এর সমালোচকরা বলেছেন, এই পদক্ষেপটি যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক ও বহুসাংস্কৃতিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মূলনীতির পরিপন্থী এবং এটি অভিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনিশ্চয়তা ও ভয় সৃষ্টি করবে। তারা আরও উল্লেখ করেন, এই ধরনের পরিবর্তন দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

পিউ রিসার্চের মতে, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অনুমোদিত অভিবাসী পিতামাতার সন্তান হিসেবে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার শিশু জন্মগ্রহণ করেছিল, যা ২০০৭ সালের শীর্ষ পরিসংখ্যানের তুলনায় ৩৬ শতাংশ কম। ২০২২ সাল পর্যন্ত পিউ রিসার্চ দেখতে পায়, ১.২ মিলিয়ন নাগরিক শিশু অনুমোদিত অভিবাসী পিতামাতার সন্তান। মাইগ্রেশন পলিসি ইনস্টিটিউট মনে করে, যেহেতু সেই সন্তানদেরও সন্তান হবে, জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিল হলে ২০৫০ সালে এটি অবৈধ অভিবাসীদের সংখ্যা ৪.৭ মিলিয়নে নিয়ে আসবে।

বিশ্বের শীর্ষ পরাশক্তি আমেরিকার মোট জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩৩ কোটি। এর একটি বড় অংশ অভিবাসী। ২০২৩ সালের জুলাই মাসের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে অভিবাসীর সংখ্যা ৪ কোটি ৭৮ লাখ ৩০ হাজার, যা মোট জনসংখ্যার ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। অভিবাসীর এই বাড়তি ধারা অব্যাহত থাকায় ২০২৪ সালের মার্চ মাসে অভিবাসীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজারে, যা মোট জনসংখ্যার ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ। সূত্র : রয়টার্স ও দ্য গার্ডিয়ান

মুহাম্মদ মোরশেদ আলম, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাংবাদিক।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন