চট্টগ্রাম বুধবার, ০৮ জানুয়ারি, ২০২৫

সুশাসনের জন্য প্রয়োজন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’

সুপ্রতিম বড়ুয়া

৫ জানুয়ারি, ২০২৫ | ৩:৫৪ অপরাহ্ণ

আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি এমন ধরনের পোক্ত আসন গেড়েছে যে, একে চুরমার করে রাতারাতি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ বানিয়ে ফেলার কাজটি একেবারে সহজ না হলেও অসম্ভব নয়। কংক্রিটের দেয়াল যত শক্তই হোক তাকে ভাঙ্গতে হাতুড়ির আঘাতই যথেষ্ট। হয়ত ক্ষেত্রবিশেষে জোরে আঘাত করতে হয়। দুর্নীতিকে এদেশ থেকে পুরোপুরি বিতাড়িত করতে আমাদের সদিচ্ছার কার্যকর প্রয়োগ ঘটানোটা ঠিক যেমন হাতুড়ির আঘাতের মতোনই। তাছাড়া আমাদের দেশে আমরাই দুর্নীতি করছি, কোনো এলিয়েন এসে এখানে দুর্নীতি করছে না। কাজেই সত্যি সত্যি আমরা কি চাই সেটা একটা মস্ত ফ্যাক্টর।

 

আমরা দেখতে পাই, অর্থ-বিত্ত ও আভিজাত্যের প্রতি লোভ ও আকর্ষণ কিছু মানুষের স্বভাবজাত। এসব অর্জনে মানুষ দুর্নীতি করে। আর এই দুর্নীতি হচ্ছে দেশ ও জাতির জন্য একটি ক্যান্সার। ক্যান্সার যেমন মানবদেহের সকল কিছুকে আস্তে আস্তে ধ্বংস করে দেয়, ঠিক তেমনি দুর্নীতিও একটি জাতির সকল সম্ভাবনাকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দেয়। দুর্নীতির সীমা-পরিসীমা অত্যন্ত ব্যাপক এবং বিস্তৃত। ঘুষ, চুরি, আত্মসাৎ, চাঁদাবাজি, জালিয়াতি, প্রতারণা, পক্ষপাতিত্ব, স্বজনপ্রীতি সবই দুর্নীতি। ঘুষ ছাড়া একজন কর্মকর্তা কাজ করে না, এটা যেমন দুর্নীতি, তেমনি কলমের মাধ্যমে অন্যায়ভাবে কাউকে কিছু দেয়াটাও দুর্নীতি। অকারণে ফাইল আটকে রাখা এবং ঘুষের বিনিময়ে সেই ফাইল অনুমোদন করাটা মস্তবড় দুর্নীতি। ক্ষমতার অপব্যবহার করাটাও দুর্নীতি।

 

ন্যায়বিচার না করা এবং বিচারকে বিলম্বিত করাও দুর্নীতি। অন্যায়ভাবে টেন্ডার আয়ত্ত করা, ওজন এবং পরিমাপে কম দেয়াও দুর্নীতি। খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল দেয়া এবং কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বেশি মুনাফা অর্জনের জন্য পণ্যদ্রব্য মজুদ করাও দুর্নীতি। দায়িত্বে ফাঁকি দেয়া এবং অবহেলা, অপরকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করাও দুর্নীতি। যথাযথ ট্যাক্স না দেয়া এবং ট্যাক্স যথাযথ আদায় না করাও দুর্নীতি। সত্য কথা না বলা, মিথ্যা কথা বলা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া এবং মিথ্যা রিপোর্ট করাও দুর্নীতি। চরিত্র হচ্ছে একজন মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ। মানুষের যখন চারিত্রিক গুণাবলী ধ্বংস হয়ে যায়, তখন সে শুধু অপকর্ম করতে থাকে। দুর্নীতিই হয়ে ওঠে চরিত্রহীন মানুষের প্রধান কাজ। চারিত্রিক অধঃপতনের কারণে আজ আমাদের সবই নষ্ট হয়ে গেছে।

 

সমাজে শান্তি এবং উন্নয়ন নিশ্চিত করতে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে হবে। এ জন্য দুর্নীতিকে নির্মূল করতে হবে। কিন্তু কেবলমাত্র আইন করে এবং দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দিয়ে দুর্নীতি নির্মূল করা ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করা কিছুতেই সম্ভব নয়। দুর্নীতি নির্মূল ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করতে প্রয়োজন সৎ মানুষ। কারণ, আইনের প্রয়োগ যিনি করবেন, তিনি যদি সৎ না হন তাহলে সেখানে আইন যথাযথ কার্যকর হবে না। একটি গাড়ি যতই ভালো হোক না কেন, ড্রাইভার যদি ভালো না হয় তাহলে ওই গাড়ি যাত্রীদের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। এক্ষেত্রে ওই ড্রাইভার কেবল যাত্রীদের জন্য দুর্ঘটনাই নিয়ে আসে। ঠিক তেমনিভাবে আইনের প্রয়োগকারী ব্যক্তি যদি সৎ না হয়, তাহলে সেই আইনও মানুষের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। বরং সেক্ষেত্রে আইনের অপপ্রয়োগ হয় এবং সেই আইন মানুষের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনে।

 

সৎ মানুষ তৈরি করার দায়িত্ব আমাদের সবার। প্রথমত, এ কাজটা শুরু করতে হবে সমাজের একেবারে প্রাথমিক স্তর পরিবার থেকে। পরিবারের মূল ভিত্তি হচ্ছে মা-বাবা এবং তাদের দায়িত্ব হচ্ছে, সন্তানকে ছোট বয়স থেকেই সততা, নৈতিকতা এবং ন্যায়পরায়নতা শিক্ষা দেয়া। পিতা বেশির ভাগ সময় বাসার বাইরে থাকায়, এক্ষেত্রে মাতার দায়িত্ব বেশি। এক্ষেত্রে বিখ্যাত ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপোর্ট এর উক্তিটি বলা যায় তিনি বলেছিলেন, Give me a good mother, I will give a good nation. অর্থাৎ আমাকে একটি ভালো মা দাও, আমি তোমাদের একটি ভালো জাতি দেব। মা-বাবারা তাদের সন্তানকে ঠিকই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করা, চাকরি অথবা ব্যবসার মাধ্যমে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।

 

কিন্তু পাশাপাশি নৈতিকতা, সততা এবং উত্তম চারিত্রিক গুণাবলী শিক্ষা দিচ্ছেন না। ফলে সন্তানেরা ঠিকই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে, বড় বড় ডিগ্রি নিচ্ছে, চাকরি অথবা ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে এবং একই সাথে চারিত্রিকভাবে সৎ হিসেবে গড়ে না ওঠার কারণে দুর্নীতিও করছে। এভাবে শিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে যে সন্তানের সৎ জীবনযাপন ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার কথা ছিল, সেই সন্তানই হয়ে যাচ্ছে দুর্নীতিবাজ এবং দুর্নীতি বিস্তারের সৈনিক। কথাটি সত্য বলেই সরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থানীয় কিছু কর্মকর্তা আজ দুর্নীতি নির্মূল না করে উল্টো নিজেরাই মহা দুর্নীতি করেছেন। আর শীর্ষ কর্তারা দুর্নীতি করলে, তাদের অধীনস্তরাও দুর্নীতি করে। সুতরাং দুর্নীতিমুক্ত সমাজের জন্য পরিবার থেকেই সৎ মানুষ তৈরির কাজ শুরু করতে হবে।

 

সন্তাদের নিজ নিজ ধর্মশিক্ষা দিতে হবে। সব ধর্ম সৎ জীবনযাপনের নির্দেশ দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাতে নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠে, সেজন্য বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনতে হবে এবং চারিত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। শিক্ষককে বলা হয় দ্বিতীয় জন্মদাতা। সৎ ও আদর্শ নাগরিক সৃষ্টির ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। যদি পাঠ্যপুস্তকে নৈতিকতাসম্পন্ন শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং শিক্ষকেরা যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেন তাহলে অতি সহজেই সুযোগ্য এবং সৎ নাগরিক গড়ে উঠবে, যারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে সৎ জীবনযাপন করবে এবং দুর্নীতিকে প্রতিরোধ করবে। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ক্রীড়া সংগঠনগুলোতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে করে সংগঠনের কর্মীরা সততা এবং নৈতিকতার ওপর শিক্ষা লাভ করে এবং সে হিসেবে গড়ে ওঠে।

 

দেশের ব্যাপকসংখ্যক মানুষের ওপর রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ক্রীড়া সংগঠনগুলোর সরাসরি প্রভাব থাকে এবং এসব সংগঠনের নেতাদের চরিত্র ও কর্মসূচি দ্বারা নেতাকর্মীরা প্রভাবিত হয়। সুতরাং রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ক্রীড়া সংগঠনগুলোতে সততা ও নৈতিকতার চর্চা করতে হবে। চতুর্থত, দেশের সাংস্কৃতিক মাধ্যমকে নৈতিকতার আলোকে সমৃদ্ধ করতে হবে। নাটক-সিনেমা হচ্ছে সমাজের দর্পণ, সমাজকে পরিবর্তনের উৎকৃষ্ট হাতিয়ার। এমন নাটক এবং সিনেমা তৈরি করতে হবে যাতে এসব নাটক এবং সিনেমা দেখে মানুষের মধ্যে সততা এবং নৈতিকতা জেগে ওঠে। অতীতের অনেকগুলো দিনকে আমরা নষ্ট করেছি। আমাদের উচিত, ভবিষ্যতকে সুন্দর করার জন্য সবাই মিলে একটি সৎ এবং চরিত্রবান প্রজন্ম গড়ে তোলা।

 

প্রবাদ আছে, Save a generation to save a nation.. অর্থাৎ একটি জাতিকে রক্ষার জন্য একটি প্রজন্মকে রক্ষা কর। সুতরাং, একটি জাতিকে রক্ষার জন্য প্রজন্মকে রক্ষা করতে হবে। জাতি গঠনের জন্য একটি প্রজন্মকে গঠন করতে হবে। আমরা যদি সৎ এবং দুর্নীতিমুক্ত প্রজন্ম গড়ে তুলি, তাহলে সেই প্রজন্ম তার পরবর্তী প্রজন্মকে সৎ এবং দুর্নীতি মুক্ত হিসেবে গড়ে তুলবে। এভাবে ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যতে একদিন পুরো জাতিটাই সৎ এবং দুর্নীতিমুক্ত হিসেবে গড়ে উঠবে। বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে গড়তে দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের গণপ্রতিবাদ তুলে থামাতে হবে। এবং তরুণরা তা অবশ্যই পারবে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর বহু কবিতায় তারুণ্যের জয়গান গেয়েছেন। আমি এই বাংলার বুকে এমন তারুণ্যদীপ্ত তরুণদের কোনো অভাব দেখতে পাচ্ছি না।

 

লেখক: প্রিন্সিপাল, রামু সরকারি কলেজ, কক্সবাজার।
পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন