‘যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তিসেনা দে না তোরা দে না সে মাটি আমার অঙ্গে মাখিয়ে দেনা’। পটিয়া উপজেলা পরিষদ থেকে দক্ষিণপাশে পৌরসভা ৪নং ওয়ার্ড-র ন্যাপনেতা আবুল মাসুদ চৌধুরী সড়ক হয়ে একটু সামনে গেলে চোখে পড়বে মরহুম কালামিয়া সওদাগরের বাড়ি। বাড়ির সামনে গোপালমাঝি পুকুর। স্বচ্ছপানিতে একদল হাঁস স্নান করতে ব্যস্ত। পুকুরপাড়ে বাঁশ ও নারিকেল বাগান। ঘাটের দু’পাশে কাঠ বাদাম গাছ ছাতার মতো ছায়া দিয়ে ঢেকে রেখেছে। পুকুরের পানিতে গাছের ছায়া পানির জলতরঙ্গ ঢেউ এ যেন এক অপরূপা জলছবি।
বাড়ির সামনে পুকুরটি এলাকায় গোপাল মাঝি অনেকে গোয়ালমাঝি পুকুর বলে। জনৈক গোপাল মাঝির নামে পুকুরের নামকরণ। গোপাল মাঝির কাছ থেকে কালামিয়া সওদাগার জমি ক্রয় করে বাড়িঘর নির্মাণ করেন। গোপাল মাঝি পুকুরের পানি ছিল স্বচ্ছ। সে সময় এলাকায় নলকূপ বলতে ছিল না। গোপাল মাঝি পুকুরের পানি পান করার জন্য চতুরদিকে বাড়ির লোকজন কলসি করে নিয়ে যেতেন। ঘাটের দেয়ালে ১৯৬৩ সালের কে এম লেখা আছে। ধারণা করা হয়, ঘাট নির্মাণ করা হয়েছিল ১৯৬৩ সালের দিকে। প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জন লোক বসে আড্ডা দিতে পারে ঘাটে। গ্রীষ্মকালে ক্লান্তপথিক বাদামগাছের নিচে বসে। পুকুরের জলে হাত মুখ ধোয়ে ঘাটে বসে ক্লান্তি জেড়ে ফেলে।
পুকুরের পূর্বপাশে খেলার মাঠ ছিল, সেই মাঠে কৈশোরে ছুটিয়ে ক্রিকেট, ফুটবল খেলতাম। ব্যাঙের ছাতার মতো অট্টালিকা দাঁড়িয়ে গেছে। পাশে প্রয়াত আহমদ সওদগারের কবরস্তানে ফুলকপির মতো শতবর্ষী রেইনট্রিটি পুরো কবরস্তানকে ছায়া দিয়ে ঢেকে রেখেছে। মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম স্মৃতিপুকুর ঘাটে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা রাতের অন্ধকারে বসে পাকাহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গোপন বৈঠক করতেন।
কালা মিয়া সওদাগর বাড়িতে প্রবেশ করতে চোখে পড়বে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম কুঠির’ বুঝতে বাকি রইলো না বাড়িটি মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিবিজড়িত।
মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম চাচা ১৯৫৩ সালের ২ মে পটিয়া পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের কালা মিয়া সওদাগার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম আবদুস সালাম। মাতা মরহুম রাশেদা বেগম। তিনি ছিলেন বাবা মায়ের জেষ্ঠ্য সন্তান। বাবা ছিলেন কয়লা ব্যবসায়ী। মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চবিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি ও পটিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে পটিয়া কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হন। কৈশোর থেকে দস্যিপনার মধ্যে দিয়ে তাঁর বেড়ে ওঠা। ছেলেবেলা কেটেছে নিজ গ্রামে। কালাম চাচা পাড়ার ছেলেদের সাথে হৈ চৈ করে ছুটে বেড়াতেন। তিনি মেধাবী ও মিষ্টভাষী ছিলেন। ফুটবল ব্যাটমিন্টন ছিল প্রিয় খেলা। ভোজনরসিকও ছিলেন। গরুর বুনা মাংস ও পরোটা দিয়ে গরম জিলাপী আর মাখন খেতে বেশ পছন্দ করতেন।
পটিয়া কলেজে ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপ ছিল কান্ডারী ও দিশারী। কালাম চাচা ছিলেন কান্ডারী গ্রুপের অন্যতম নেতা। কান্ডারী গ্রুপে থাকার সময় পটিয়া কলেজসংলগ্ন খোকা মহাজনের মিষ্টির দোকানে তাঁদের বেশ আড্ডা ছিল। খোকা মহাজনের মিষ্টির দোকানটি মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি বিজড়িত। এলাকার বিচার আচারে কালাম চাচার ডাক পড়ত। সৎ ও ব্যক্তিত্ববান হওয়াতে এলাকায় তাঁর বেশ সম্মান ও সুনাম ছিল। পোষাক আশাকে ও ছিলেন বেশ পরিপাটি। ইশকুলবেলায় কালাম চাচার কাছে যুদ্ধদিনের গল্প শুনতাম। ১৯৭১ সালে একদা রাতে, কালাম চাচা বাড়ি থেকে মুক্তিবাহীনিদের সাথে অপারেশনে বের হবে- ঠিক সেসময় পড়লেন মহাবিপদে, তাঁর দাদা কালা মিয়া সওদাগরকে বাড়ির সবাই ভয় পেতেন। বাড়ি থেকে কিছুতে বাহির হতে পারছিল না।
সহযোদ্ধা শহীদ ছবুর শীষ দিচ্ছেন বের হওয়ার জন্য। বাড়ির পালা কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে। হঠাৎ তাঁর দাদা নাকি কে কে? বলে বার বার উঠে হারিকেন দিয়ে দেখছিল কোন চোর এল কিনা। দাদা চিৎকার করে বলল, খবরদার দেশের পরিস্থিতি ভালো না, কেউ ঘর থেকে বাহির হবে না। এই কালাম ঘুমিয়ে পড় তুই জেগে আছিস কেন? কুকুরকে পাউরুটি খেতে দিয়ে রাতের অন্ধকারে ছোট একটা কাপড়ের পটলা নিয়ে কান্ডারি দলের সহযোদ্ধাদের সাথে বেরিয়ে পড়েন। পরদিন তাঁকে সবাই খুঁজতে লাগল। পরে জানতে পারল সে পাকহানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে রাতের অন্ধকারে মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছেন। ২২ বছরের টগবগে তরুণ কালাম চাচা কয়েকমাস পরে যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরলেন।
কালাম চাচা সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে তৎকালীন দক্ষিজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার চৌধুরী মাহাবুব জানান, “১৯৭১ সালে ৯ এপ্রিল থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত ভারত থেকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে রামগড় হয়ে অধ্যাপক এবিএম সামসুল ইসলামের (সর্বপ্রথম গ্রুপ কমান্ডার) নেতৃত্বে দেশে ফিরে আসি। ফেরার পথে চোখে পড়ে খালের পানিতে লাশ ভাসছে বেশ কিছু গলিত লাশ। সেই দৃশ্য দেখে কালাম, শহীদ ছবুর, আসলাম, রফিক, আহমেদ কবিরসহ সবাই প্রতিশোধের আগুনে ফুসি উঠি। মুক্তিযোদ্ধা কালাম পাকাহানাদারবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছেন। বন্ধু কালামের বীরত্ব ও সাহসিকতা সত্যি ভুলার নয়। আমি খুব কাাছ থেকে দেখেছি, যেখানে অন্যায় দেখতে সেখানে হুঙ্কার দিত বাহু উচিয়ে। কালাম চাচা একদিন রাতে এলাকার এক দন্ধ থামাতে গিয়ে পুকুর ঘাটলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছিলেন।
কালাম চাচার ছেলে মামুন টেকনাফ থানার সহকারি সাব-ইন্সপেক্টর। তাঁর প্রয়াত বাবার কথা বলতে গিয়ে বলেন, বাবা ছিলেন আমার কাছে বট বৃক্ষের মতো। আমার সফলতা বাবা দেখে যেতে পারেনি। বাবা অন্যায়ের কাছে কখনও মাথা নত করতেন না। বাবা বড়শী দিয়ে মাছ ধরতে পছন্দ করতেন। বাবার সাথে বড়শী হাতে বসে থাকতাম পুকুর পাড়ে। বড়শীতে মাছ লাগলে বাপ ছেলে দুজনে খুশি হয়ে তালি দিতাম। একদিন পুকুরে মাছ ধরতে গিয়ে বাবার বড়শী লেগে যায় গাছে। গাছে বড়শী লেগে বড়শী ছিড়ে যায়। বাবার খুব মন খারাপ হয়। মামুন বাসা থেকে দা এনে ঐ গাছের ডাল কাটতে গিয়ে দায়ের কুপে নিজ হাতের আঙ্গুলে ইনজুরি হয়। কালাম চাচা বড়শী ফেলে মামুনকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড় দিলেন।
মামুনকে বললেন, ‘বাবাকে খুশি করতে নিজের হাত কেটে ফেললি মামুন। এরকম পাগলামি কেউ করে? সেদিন থেকে বাবা আর বড়শি দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ করেদেন। বাবা নেই, আজ তাঁর সেই বড়শি আমি আজও যত্ন করে রেখেছি। মাঝে মাঝে বাবার কথা মনে পড়েল বড়শিটি হাতে নিয়ে ,মিছেমিছি বাবার হাতে ছোঁয়া স্পর্শ করি, গামছা দিয়ে যত্ন করে মুছে রাখি। ২০০৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর একাত্তরের বীর মু্িক্তযোদ্ধা আবুল কালাম চাচা না ফেরার দেশে চলে যান। ২১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: রশীদ এনাম- লেখক, ব্যাংকার।
পূর্বকোণ/ইব