শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের ভোগান্তি ও খরচ লাঘবে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যায়ক্রমিকভাবে চালু করা হয় গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় ভর্তি-ইচ্ছুক একজন শিক্ষার্থী একটি পরীক্ষা দিয়েই গুচ্ছে অন্তর্ভুক্ত যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটসহ কয়েকটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বতন্ত্রভাবে ভর্তিপরীক্ষা চালু ছিল। উল্লেখ্য, গুচ্ছে না থাকলেও ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি অনেকটা লাঘব করতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে দুই দশকের বেশি সময় ধরে দেশের সব সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে একক ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। পরে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। ফলে মেডিকেলে পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের কোন দুর্ভোগ নেই বললেই চলে।
২০২০ সালের পূর্বে দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদাভাবে ভর্তিপরীক্ষা নেওয়া হতো। ফলে শিক্ষার্থীদের চরম ভোগান্তি ও ব্যয় অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। বিষয়টি নিয়ে সচেতনমহলে যথেষ্ট সমালোচনা হয়েছে। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপেক্ষিতে ২০১৯-২০ সেশন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভর্তিপরীক্ষা চালু করা হয়। প্রথমে সাতটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কৃষিগুচ্ছ, পরবর্তীতে চুয়েট, রুয়েট, কুয়েট নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং গুচ্ছ এবং সাধারণ ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে জেএসটি গুচ্ছভুক্ত হয়ে স্নাতক প্রথমবর্ষে ভর্তিপরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। উল্লেখ্য, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে জেএসটি গুচ্ছভুক্ত কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ থেকে বের হয়ে স্বতন্ত্রভাবে পরীক্ষা নিতে চেষ্টা করলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃঢ় পদক্ষেপের কারণে ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জেএসটি গুচ্ছের আওতায় ভর্তিপরীক্ষা নিতে বাধ্য হয়।
সংবাদে জানা যায়, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষে গুচ্ছ পরীক্ষাপদ্ধতিতে ভর্তির ব্যবস্থা অনুসরণ করতে উপাচার্যদের অনুরোধ করে পত্র দেন। শিক্ষা উপদেষ্টার প্রেরিত পত্রটি আমলে না নিয়ে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্রভাবে ভর্তি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ভর্তিবিজ্ঞপ্তি প্রচার করে- যা অনভিপ্রেত। এর দেখাদেখি আরো কিছু বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে। এ নিয়ে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। মূলত শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি এবং দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তিপরীক্ষা চালু করা হয়। যদি বর্তমানে ভর্তির জন্য একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়, তাহলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জন্য হবে তা চরম ভোগান্তি, এমনকি খরচও বেড়ে যাবে। তাছাড়া স্বতন্ত্রভাবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা হলে পরীক্ষার্থীদের প্রস্তুতিতেও ব্যাঘাত ঘটবে। ইতিমধ্যে শিক্ষার্থীরা প্রচলিত গুচ্ছ পরীক্ষাপদ্ধতি বহাল রাখার দাবিতে প্রধান উপদেষ্টা ও শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছেন।
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী স্বতন্ত্র-এতে কোন সন্দেহ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম কানুন, একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত, ও স্বতন্ত্রতা বজায় রেখেও একটি অভিন্ন/একক ভর্তিপরীক্ষার মাধ্যমে মেধা যাচাই করে শিক্ষার্থী ভর্তি করাই শ্রেয়। স্বতন্ত্র পরীক্ষার পিছনে শিক্ষকদের আর্থিক স্বার্থ জড়িত রয়েছে- বিষয়টি উল্লেখ করে বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। একজন শিক্ষক হিসাবে বিষয়টি আমাকে দারুণভাবে মর্মাহত করেছে। তাই এই ধরনের অভিযোগের ঊর্ধ্বে ওঠে শিক্ষক হিসেবে আমরা আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে যেতে চাই। এটা সত্য যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে আলাদাভাবে ভর্তিপরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি নিয়ে আবারও পুরানো ভোগান্তি ফিরে আসবে। কেননা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ছোটাছুটি করতে হবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এতেই ভোগান্তির পাশাপাশি খরচও বাড়বে। তাই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ইতিবাচক ভূমিকা প্রত্যাশা করে।
ইউজিসির সদস্য থাকাকালীন সময়ে প্রত্যক্ষ করেছি গুচ্ছপরীক্ষা নিয়ে মাঝে মধ্যে কিছু সমস্যা হয়েছে। বিষয়টি আমাদের গোচরিভূত হওয়ার সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট গুচ্ছভিত্তিক ভর্তিপরীক্ষা কমিটির সাথে আলোচনা করে সমাধান করা হয়েছে। এরপরও যদি গুচ্ছভিত্তিক ভর্তিপরীক্ষা পদ্ধতিতে কোন সমস্যা থেকেই তাকে তা-ও সমাধান করা সম্ভব। যেখানে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি ও বাড়তি খরচ প্রশ্ন জড়িত সেখানে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তিপরীক্ষা থেকে সরে আস। সমীচীন হবে না। বর্তমানে ৫৫টি স্বায়ত্তশাসিত ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ১১৪টি অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৮৮১টি কলেজে স্নাতক সম্মান পড়ানো হয়। তাছাড়া বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক সম্মান/সম্মান পর্যায়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ন্যায় শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের ভোগান্তি লাঘব ও সত্যিকার মেধা যাচাইয়ের জন্য যত দ্রুত সম্ভব একটি জাতীয় পরীক্ষা কর্তৃপক্ষ (National Testing Authority-NTA) গঠন করা অতীব জরুরি।
আমার জানামতে, বিষয়টি নিয়ে ইউজিসি থেকে একটি প্রস্তাবনা ইতিপূর্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। উক্ত কর্তৃপক্ষ একক ভর্তিপরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের স্কোর নির্ধারণপূর্বক মেধা অনুসারে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন বিভাগে ভর্তি হতে পারবে সে অনুযায়ী প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় একটি তালিকা প্রেরণ করবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের গাইডলাইন অনুযায়ী মেধা স্কোর ও পছন্দ অনুযায়ী প্রেরিত তালিকা থেকে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাবে। এনটিএ (NTA)এর আওতায় দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করে কম্পিউটারের মাধ্যমে পরীক্ষা গ্রহণ করা যেতে পারে। এনটিএ কর্তৃক সরেজমিনে পর্যবেক্ষণের পর নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা সাপেক্ষে কোন পরীক্ষাকেন্দ্রকে ভর্তিপরীক্ষা নেওয়ার জন্য উপযোগী তা অনুমোদন দেবে। ভর্তিপরীক্ষার জন্য ভর্তি-ইচ্ছুক পরীক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন, রেজিস্ট্রেশন ফি, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও প্রশ্নপত্রের বৈশিষ্ট্য, পরীক্ষাপদ্ধতি, পরীক্ষার সময় ও নম্বর, ফলাফল প্রকাশ, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিসংক্রান্ত যাবতীয় নির্দেশনাবলী এনটিএ ওয়েবসাইটে আপলোড করতে হবে। একক ভর্তিপরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যথাযথভাবে মেধা যাচাই করা যেমন সহজ হবে তেমনি তাদের ভোগান্তি ও ভর্তিসংক্রান্ত খরচ কমে আসবে।
অনেকেই বলে থাকেন মেডিকেলশিক্ষা একই ধরনের, তাই একক ভর্তিপরীক্ষা তাদের জন্য যুক্তিযুক্ত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ধরন যেমন ভিন্ন তেমনি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় স্বতন্ত্র আইনে পরিচালিত হয়। এতদসত্তে¡ও আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, অন্যান্য নিয়মাবলী সমুন্নত রেখে একক ভর্তিপরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাই করা অনেকাংশে সহজ। যদি আইইএলটিএস (IELTS)/জিআরই (GRE)/জিএমএটি (GMAT) পরীক্ষার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাই করে বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়া যায় তাহলে আমাদের দেশেও এনটিএ (NTA) আওতায় সেই ধরনের একটি অভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাই করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা যেতে পারে। যেহেতু এটিএ গঠন সময়সাপেক্ষ সেহেতু ২০২৩-২৪ সালে যেভাবে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তিপরীক্ষা চালু ছিল ঠিক একইভাবে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিপরীক্ষা হওয়াটাই সমীচীন হবে। যদি কোন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা উপদেষ্টার প্রেরিত পত্রটি আমলে না নিয়ে উল্টো পথে যাত্রা শুরু করে তাহলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে শিক্ষার্থী- অভিভাবকদের কল্যাণার্তে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায়, শিক্ষার্থী-অভিভাবকেরা পুনরায় ভোগান্তির শিকার হবে; খরচ বাড়বে- যা কোন অবস্থাতেই কাম্য নয়।
লেখক: প্রফেসর, ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, ঢাকা)।
পূর্বকোণ/ইব