দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু, ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও ভয়াবহ অভিজ্ঞতার আলোকে পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রপ্রধান ঐকমত্য হয়ে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে জাতিসংঘের চার্টার অব ডিমান্ড অনুসারে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়, যা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ তাদের নিজ নিজ দেশের সংবিধানে মানবাধিকার সনদে উল্লেখিত অধিকারসমূহ অন্তর্ভুক্ত করে রাষ্ট্র পরিচালনা করে আসছে।
১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানের ২য় অধ্যায়ের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে মানবাধিকার সনদে বর্ণিত বিষয়গুলো উল্লেখিত রয়েছে। এটা সত্য যে, মানবাধিকার প্রত্যেক ব্যক্তির সহজাত ও জন্মগত অধিকার। এ অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা অনৈতিক। বস্তুত: মানবাধিকার মানুষের ন্যূনতম মৌলিক অধিকারসংক্রান্ত স্বার্থগুলো সংরক্ষণ করে থাকে এবং তাকে সম্ভাব্য আক্রমণকারী ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা দেয়। তাছাড়া বর্তমানে মানবাধিকার সনদে বর্ণিত বিষয়গুলো বিশ্বব্যাপী মানুষের ন্যায্য দাবি আদায়ে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে।
মূলত: কোন্ কোন্ বিষয়গুলো মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত- এ ব্যাপারে ধারণা দেয়ার নিমিত্তে আজকের প্রবন্ধের অবতারণা। মানবাধিকারসংক্রান্ত বই, সাময়িকী ও প্রবন্ধগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মানবাধিকারকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
(১) অষ্টাদশ শতাব্দীর নবজাগরণ ও উদারপন্থী ভাবধারায় যারা বিশ্বাসী ছিলেন (অর্থাৎ প্রথম প্রজন্ম) তারা মানবাধিকার বলতে সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারকে বুঝিয়েছেন। এর মধ্যে মত প্রকাশের অধিকার, সমবেত হবার অধিকার, আইনের চোখে সাম্যের অধিকার, ভোট দেবার অধিকার, পছন্দমতো ধর্মের অনুশীলনের অধিকার, মর্যাদার অধিকার, বৈষম্যহীনতার অধিকার ইত্যাদি অন্যতম।
(২) পরবর্তীতে (দ্বিতীয় প্রজন্ম) অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারকে (অন্ন ও বস্ত্র পাবার অধিকার, শিক্ষার অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার, বাসস্থানের অধিকার) মানবাধিকার হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।
(৩) তৃতীয় প্রজন্ম সমষ্টিগত অধিকারকে (উন্নয়নের অধিকার, জাতিগত অধিকার, পরিবেশের অধিকার) মানবাধিকার হিসেবে বিবেচনা করেছেন।
Thomas Hobs, John Lock, Thomas Pain, Edmund Burke, Jeremy Bentham, Karl Marx সহ অনেকে মানবাধিকার নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন। এ অধিকারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- (ক) মত প্রকাশের অধিকার (খ) স্বাধীনতার অধিকার (গ) সাম্যের অধিকার (ঘ) জীবনের অধিকার (ঙ) সম্পত্তির অধিকার (চ) নিরাপত্তার অধিকার। এ অধিকারসমূহের মধ্যে কিছু ব্যক্তিগত, আর কিছু সমষ্টিগত। ব্যক্তিগত অধিকারগুলোর প্রয়োগ ও ভোগ করার ক্ষমতা একান্তই নিজের। যার উপর সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।
পক্ষান্তরে সমষ্টিগত অধিকারগুলো রক্ষা করার দায়িত্ব সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর বর্তায়। তাই মানবাধিকার সংক্রান্ত বিজ্ঞজন মনে করেন, রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে সমাজে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং ব্যক্তির অধিকার ভোগ করার নিশ্চয়তা প্রদান করা, যাতে নাগরিকগণ অধিক নিরাপত্তায় ও স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারে। সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের উপর ভিত্তি করে ১৯৬৬ সালে জাতিসংঘ আরো দুটো আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদন করে।
(১) Int’l covenant-on Economic, Social and Cultural Rights (ICESCR) (2) Int’l covenant on Civil and Political Rights (ICCPR), এ দুটো চুক্তিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংক্রান্ত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, আয়ের নিশ্চয়তা, লিঙ্গ বৈষম্য, শিক্ষা, মতপ্রকাশ, রাজনৈতিক ও ভোটের অধিকার, অভিবাসীদের সুরক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে বিশদ বর্ণনা রয়েছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো যথা: Amnesty Int’l, HR watch, HRC, Office of the UN High Commissioner for human rights, Int’l Rehabilitation Council of Torture victims, Centre for Economic and Social rights ইত্যাদি সংগঠন মানবাধিকার নিয়ে অনেকটা সোচ্চার রয়েছেন। তাছাড়া অনেক দেশে সরকার কর্তৃক গঠিত মানবাধিকার কমিশনও বেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে।
এটা সত্য যে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনসমূহ মানবাধিকার সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সামাজিক অনাচারের পরিমাণ যেমন হ্রাস পাচ্ছে, তেমনি সামাজিক প্রথাগুলো বাস্তবায়নে কমিউনিটিগুলো অনেকটা তৎপর রয়েছে। মানবাধিকার আজ সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত। তাই যেকোন রাষ্ট্রকে মানবাধিকার সনদে বর্ণিত অধিকারসমূহ প্রতিপালনে সচেষ্ট থাকতে হয়। যতদিন পর্যন্ত বিশ্বে আইন লঙ্ঘন করে এক দেশ অন্য দেশের উপর হস্তক্ষেপ করবে, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রীয় প্রশাসন মানবাধিকার সনদে বর্ণিত অধিকারগুলো অমান্য করবে; যতদিন একটি ন্যায় ও সমতাভিত্তিক মানবিক উন্নয়ন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হবে, ততদিন পর্যন্ত সর্বজনীন মানবাধিকার সনদে বর্ণিত বিষয়গুলো বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রে প্রাসঙ্গিক থাকাটাই স্বাভাবিক।
লেখক : প্রফেসর, ম্যানেজমেন্ট বিভাগ ও সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদালয়, সাবেক সদস্য বাংলাদেশ বিশ্ববিদালয় মঞ্জুরী কমিশন, ঢাকা।
পূর্বকোণ/ইব