চট্টগ্রাম রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

মাটির যত্ন মানেই জীবনের যত্ন

প্রফেসর আবুল কাশেম

৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ২:৩৮ অপরাহ্ণ

পরিবেশের অসংখ্য উপাদানের মধ্যে মৃত্তিকা অন্যতম। ইহা একটি প্রাকৃতিক সম্পদ, আমাদের সৃষ্টি নয়। ছোট জীব থেকে শুরু করে মানবগোষ্ঠী পর্যন্ত সকলকে প্রয়োজনীয় নানা উপাদানের যোগান দিয়ে থাকে এই মৃত্তিকা। মৃত্তিকা বা মাটি ছাড়া মানুষের জীবন কল্পনা করা যায় না। যেখানে মাটি আছে, সেখানে জীবন আছে, সভ্যতা আছে। পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে, যাদের ভূমি আছে, কিন্তু আবাদযোগ্য জমি নাই।

 

আজ ৫ ডিসেম্বর বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস। মৃত্তিকার সম্পদের সঠিক ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার উপর সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০০২ সালে ওটঝঝ এর সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে ঋঅঙ সম্মেলনে এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ৫ ডিসেম্বর ২০১৪’কে প্রথম বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস হিসেবে মনোনীত করেন। উল্লেখ্য যে, থাইল্যান্ডের রাজা আদুলিয়াদেজ ভূমিবল মৃত্তিকা সম্পদের গুরুত্ব, তার ভাবনা ও আন্তরিকতা এবং এই সম্পদের প্রতি আবেগ সারা বিশ্বে মৃত্তিকা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। আদুলিয়াদেজ ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী রাজা। তিনি ১৯২৭ সালের ৫ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৩ অক্টোবর ২০১৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

 

প্রয়াত রাজার সম্মানার্থে, তাঁর জন্মদিনের স্মরণে প্রতিবছর ৫ ডিসেম্বর এই দিবসটি পালন করা হয়। এটি মৃত্তিকা সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা প্রচারের জন্য একটি বার্ষিকীতে পরিণত হয়েছে। ২০২৪ সালের এই দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো মাটির যত্ম: পরিমাপ, পর্যবেক্ষণ ও পরিচালনা। মৃত্তিকার শক্তি প্রতিটি জীবনের শক্তি নির্ধারণ করে এবং প্রতিটি জীব তা পেয়ে থাকে তার খাদ্যের মাধ্যমে। খাদ্য হলো একটি শক্তিশালী ওষুধ। এ প্রসঙ্গে একটি প্রাচীন বৈদিক প্রবাদে বলা হয়েছে, যখন খাদ্য ঠিক থাকে, তখন ওষুধের প্রয়োজন হয় না; খাদ্য ঠিক না থাকলে, ওষুধ সেবনে কোন লাভ হয় না। স্বাস্থ্যকর মাটি হলো জীবনের ভিত্তি।

 

স্থান-কালভেদে এই মাটি জীবিত এবং মৃত উভয় অবস্থায়ই থাকে। তাই, মহান আল্লাহ তাআলা আল কুরআনে (২:১৬৪, ৭:৫৭, ৩৬:৩৩, ৩৯:২১) উল্লেখ করেছেন যে, আমি মেঘমালা থেকে পানি বর্ষণ করে মৃত ভূমিকে জীবিত করি এবং তা থেকে ফসল বাহির করে আনি। উল্লেখ্য যে, আমাদের পায়ের নিচে এক টেবিল চামচ আবাদি জমির মাটিতে বসবাসরত অনুজীবের সংখ্যা পৃথিবীর লোক সংখ্যার চেয়েও বেশি, যারা আল্লাহ তায়ালার অন্যান্য সৃষ্টির মতোই অনুগত এবং আল্লাহ তায়ালাকে সেজদা করে।

 

পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে (১৩:১৫, ১৬:৪৯, ২২:১৮), যত সৃষ্টি আসমানসমূহে এবং জমিনে আছে, তারা সবাই আল্লাহতায়ালাকে সেজদা করছে, সেজদা করছে চন্দ্র, সূর্য, তারকারাজি, পর্বতসমূহ, বৃক্ষরাজি, জমিনের উপর বিচরণশীল সব জীবজন্তু, এমনকি তাদের ছায়াগুলোও সকাল-সন্ধ্যায় তাদের মালিককে সেজদা করে। অন্যদিকে এই অনুজীবগুলো পচনশীল সব বস্তুকে ভেঙ্গে মাটির সাথে মিশিয়ে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে এবং মাটিকে দূষণমুক্ত করে তোলে, যা দিয়ে “তায়াম্মুম” পবিত্র হয়ে নামাজ পড়ারও বিধান রয়েছে (আল কোরআন, ৫:৬)।

 

মাটির চারটি (খনিজ, জৈব, পানি ও বায়ু) উপাদানের মধ্যে জৈব পদার্থ ও পানির গুরুত্ব অপরিসীম। মাটিতে দীর্ঘ সময় পানি ধরে রাখার অন্যতম মাধ্যম হলো জৈব পদার্থ। অণুজীবগুলো জৈব পদার্থ ও পানি ছাড়া বাঁচতে পারে না এবং গাছের পুষ্টি উপাদানগুলোও গ্রহণযোগ্য অবস্থায় আসে না। তাই শুষ্ক জমিতে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করেও কোন লাভ নেই। বর্তমানে আমাদের আবাদি জমির (৮৮,২৯,২৬৬ হেক্টর) প্রায় ৭৫% তার উর্বরতা শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

 

শুধুমাত্র অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সারের ব্যবহার ও জৈব পদার্থের ঘাটতি এর মূল কারণ। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশে প্রায় ৮৫% জমিতে তার ঘাটতি রয়েছে। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই, ২০২০) তথ্য অনুযায়ী ৩৫% ফসলের জমিতে তার পরিমাণ অতি নিম্ন (১% এর নিচে) থেকে নিম্ন (১.১-১.৭%) এবং ৬০ শতাংশ জমিতে তার পরিমাণ মধ্যম (১.৭ থেকে ৩.৪%) অথচ তার পরিমাণ ৫% থাকা উচিত। এ ধরনের প্রভাব চট্টগ্রাম অঞ্চলের মাটিতে বেশি।

 

মৃত্তিকাকে সুস্থ রাখার নিমিত্তে উল্লেখযোগ্য যযত্ন সমূহ:

১। মৃত্তিকার নমুনা পরীক্ষা করা: মৃত্তিকার নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে তার ভৌত রাসায়নিক ও জৈবিক বৈশিষ্ট্যগুলো জানা যায়, যার উপর ভিত্তি করে শস্য নির্বাচন ও সঠিক মাত্রায় সার প্রয়োগ করা যায়। আমাদের কৃষকগণ এ ব্যাপারে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) সহযোগিতা নিতে পারেন, যারা নামমাত্র মূল্যে অতি দ্রুত সময়ে মৃত্তিকা পরীক্ষা করে সঠিক পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

 

২। জৈব সার যোগ করা: জৈব সার বা জৈব পদার্থ হলো মাটির প্রাণ। জৈব পদার্থ মাটির গুনাগুন উন্নয়নের অন্যতম উপায়। এটি মাটির গঠন উন্নত করে পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ায়, উপকারী জীবাণুর কার্যক্রম বৃদ্ধি করে এবং উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজন প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করতে সাহায্য করে। বর্তমানে আমাদের দেশের মাটিকে সুস্থ রাখার একমাত্র উপায় হলো জৈব সার যোগ করা, যা আমরা দুইটি উৎস থেকে পেতে পারি। যেমন: গরুর গোবর ও গৃহস্থালির পচনশীল ময়লা আবর্জনা।

 

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের খামার শাখার তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রায় ২ কোটি ৪৮ লাখ ৫৬ হাজার পশু রয়েছে। দৈনিক ১০ কেজি হিসেবে উক্ত পশুসমূহ থেকে বছরে গোবর আসে প্রায় ৯ কোটি ১২.৫ লাখ টন যা থেকে কেঁচো, ব্লাক সোলজার ফ্লাই বা ট্রাইকো কম্পোস্ট ইত্যাদির মাধ্যমে কমপক্ষে ৪ কোটি ৬০ লাখ টন জৈব সার উৎপন্ন হবে। যা দেশের সকল আবাদি জমিতে হেক্টর প্রতি ৫ টন হিসেবে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

 

অন্যদিকে, আমাদের নগরগুলোতে দৈনিক প্রায় ২৫ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, তার মধ্যে রয়েছে ১৭ হাজার মেট্রিক টন পচনশীল বর্জ্য আবর্জনা (অযসবফ, ২০১৯)। যাদেরকে কালো সৈনিক পোকার (Black soldier fly larva: Hermetia) মাধ্যমে মূল্যবান সম্পদে পরিণত করা সম্ভব। বিভিন্ন তথ্য এবং আমাদের অভিজ্ঞতা অনুসারে, এই পোকার বেবী লার্ভা মিশ্রিত আবর্জনা ২ সপ্তাহের মধ্যে খেয়ে পূর্ণাঙ্গ লাভায় পরিণত হয় এবং এর সাথে জৈব সারও উৎপাদন হয়। সাধারণত ৬ কেজি মিশ্রিত আবর্জনা থেকে ১ কেজি লার্ভা ও ১ কেজি জৈব সার পাওয়া যায়।

 

এই লার্ভাতে প্রোটিনের পরিমাণ অত্যন্ত বেশি থাকায় (প্রায় ৫০% এর উপরে) হাঁস-মুরগি, মাছ, পশু-পাখি, বিড়াল-কুকুরের আকর্ষণীয় উত্তম খাবার হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। বাংলাদেশেও এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে ১ কেজি লার্ভার মূল্য ৫০ টাকা এবং জৈব সারের মূল্য ১৫ টাকা। উক্ত হিসাবে দৈনিক ১৭ হাজার টন আবর্জনা থেকে বছরে আয় আসবে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। অনুরূপভাবে গবাদি পশুর গোবর ব্যবস্থাপনা থেকে বছরে উপার্জন হবে কমপক্ষে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। উক্ত ব্যবস্থাপনায় বর্তমানে ব্যবহৃত ভারি ধাতু মিশ্রিত মৎস্য ও পশু খাদ্য এবং রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরশীলতা অনেকাংশে কমে আসবে। তাছাড়া, ভর্তুকি বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকার সাশ্রয় হবে, সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান, রক্ষা পাবে আমাদের পরিবেশ এবং সুস্থ থাকবে আমাদের মাটি।

 

৩। ইটের পরিবর্তে ব্লক ইটের ব্যবহার বাড়ানো: বাংলাদেশের প্রায় ৮ হাজার (বৈধ এবং অবৈধ) ইটভাটা আছে। তারা বছরে প্রায় ১৩ কোটি টন মাটি ব্যবহার করে ৩,৫০০ কোটি ইট তৈরি করে। উক্ত মাটি আমাদের ৬৫ হাজার হেক্টর জমির উপরে স্তরের মাটির সমান। ইট তৈরির উত্তম উপাদান হলো আবাদি জমির মাটি। ইটভাটার কারণে পার্বত্য এলাকার পাহাড়গুলোও এখন ঝুঁকিতে রয়েছে। আবাদি জমির মাটি রক্ষার্থে ইটভাটার মালিক এবং ব্যবহারকারীদেরকে পরিবেশবান্ধব ব্লক ইটের সুবিধা, তার উৎপাদন ও ব্যবহারে আকৃষ্ট করতে হবে। ব্লক ইট তৈরিতে আবাদি জমির মাটির প্রয়োজন হয় না।

 

৪। প্লাস্টিকের ব্যবহার সীমিতকরণ: প্লাস্টিক বর্জ্য মাটিতে ক্ষয় হতে ৪০০ থেকে ৫ হাজার বছর লাগে। উক্ত বর্জ্য উৎপাদনে চীন প্রথম এবং বাংলাদেশ ১০ম স্থানে রয়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্য উদ্ভিদের পুষ্টি, পানিগ্রহণ ও অনুজীবের কার্যকলাপকে বাধাগ্রস্ত করে এবং উদ্ভিদের শেকড় গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। পলিব্যাগ ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের সরবরাহ, ব্যবহার ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের সিদ্ধান্তসমূহকে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা। তার জন্য সর্বপ্রথম করণীয় হলো প্লাস্টিক পণ্যের বিকল্প পণ্য জনগণের কাছে সহজলভ্য করে দেওয়া, অন্যথায় কোন উদ্যোগই আলোর মুখ দেখবে না। তাছাড়া আইন মানার ক্ষেত্রে আমরা নিজেরাও অনেক সময় উদাসীন থাকি। যেমন- সরকারি, বেসরকারি অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক প্রচারণায় বেদারসে প্লাস্টিকের ব্যানার ও ফেস্টুন ব্যবহার করে যাচ্ছি, এগুলো কিন্তু আমাদের পরিবেশকে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে চলছে।

 

আমাদের মাটিকে সুস্থ রাখার স্বার্থে উল্লেখিত যত্ন সমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশন এবং জনসাধারণকে একসাথে এগিয়ে আসতে হবে।

 

লেখক : প্রফেসর, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট