আগামী ১৮ নভেম্বর ২০২৪, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৮ বছর পূর্ণ হবে। ১৯৬৬ সালের এই দিনে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা বৈচিত্র্যময় পাহাড়-নদী-সাগরবেষ্টিত নিরুপম সুষমামণ্ডিত চট্টগ্রাম শহর থেকে ২২ কিলোমিটার উত্তরে হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের ২৩১২ একর পাহাড় – টিলাভূমিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ এই ক্যাম্পাসকে ভালোবেসে অনেকে ‘পাহাড়ে ঘুমানো ক্যাম্পাস’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে জ্ঞানচর্চা ও এর উৎকর্ষতা সাধন, গবেষণা ও উদ্ভাবন, মুক্তচিন্তা, মেধা- মননের বিকাশ সাধন, সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন-আধুনিক-বিজ্ঞানমনস্ক দক্ষ, যোগ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর মানবসম্পদ উন্নয়নে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সৃষ্টি করেছে অসংখ্য আলোকিত মানুষ, যারা বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, প্রশাসক, ব্যবস্থাপক, রাষ্ট্রচিন্তাবিদ হিসেবে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে মুক্তিযোদ্ধা শহীদের প্রতি গণতান্ত্রিক সম্মেলন আন্দোলন সংগ্রামী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অবদান উজ্জ্বল করেছে।
সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধসহ এর প্রতিটি গণতান্ত্রিক-সাম্যের আন্দোলন-সংগ্রামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের রয়েছে অসামান্য অবদান ও গৌরবোজ্জল ভূমিকা। এই সমস্ত অর্জন বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যদের জন্য অত্যন্ত গৌরব ও আনন্দের।
প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়টির আবেদন ছিল ভিন্ন রকমের। ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য এ. আর. মল্লিক বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় হলেও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে পঠন-পাঠন ও গবেষণায় ভিন্নতা থাকবে। চট্টগ্রামের ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আর্টস, সাইন্স, কমার্স ও সোশ্যাল সাইন্সের সাধারণ বিষয়গুলোর পাশাপাশি মেরিন বায়োলজি, মাইক্রোবায়োলজি, ওশোনোগ্রাফি, ডিপসি, ফিশারিশ, ফরেস্ট্রি, ফাইন আর্টস ইত্যাদি বিষয়ে পঠন-পাঠনে গুরুত্বের কথা তুলে ধরেছেন।’
চারটি বিভাগ (বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, অর্থনীতি) নিয়ে ১৯৬৬-৬৭ শিক্ষাবর্ষে পঠন -পাঠন শুরু হলেও বর্তমানে ৯টি অনুষদের আওতায় ৪৮টি বিভাগ, ৬টি ইনস্টিটিউট, ৫টি গবেষণাকেন্দ্র, ১৪টি হল, ৯৯৩জন শিক্ষক, ২৭,১২৯ জন শিক্ষার্থী, ৪৫০ জন কর্মকর্তা, ১৫০০ কর্মচারীর পদচারণায় বছরজুড়ে কর্মচাঞ্চলে মুখরিত থাকে।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়র প্রায় সাড়ে তিন লক্ষের অধিক গ্র্যাজুয়েট আজ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে। নৈসর্গিক এই ক্যাম্পাসের পরতে পরতে মিশে আছে সকলের আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসা।
শিক্ষা, গবেষণা, উদ্ভাবন, প্রশাসনিক, পাঠক্রম অন্তর্ভুক্ত/বহিভুক্ত কার্যক্রমসহ নানাবিধ কর্মকাণ্ডে এ বিশ্ববিদ্যালয় সদা অগ্রগামী। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক রেংকিংয়ে এর অবস্থান সসুনিশ্চিত করেছে। আগামীতে আন্তর্জাতিক রেংকিংয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয় আরো ভালো করবে- এই প্রত্যাশায় করছি।
বিশ্বায়নের এই যুগে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সফল অংশীদার হওয়ার জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি-নির্ভর, মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন সৃজনশীল মানবসম্পদ হিসাবে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলার জন্য প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা, একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান প্রস্তুত করা, দক্ষ-অভিজ্ঞ শিক্ষক -কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রদান, সেল্ফ এসেসমেন্ট চালুকরুন, যুগোপযোগী ও আন্তর্জাতিক মানের আউটকাম বেইজড এডুকেশন কারিকুলাম প্রণয়ন, উন্নত মানের জার্নালে প্রকাশনার জন্য প্রণোদনা প্রদান, বিশ্ববিদ্যালয় জনবলের কর্মদক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য মানসম্মত প্রশিক্ষণ অতীব জরুরি।
তাছাড়া ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া কোলাবরেশন, গবেষণা, ইনকিউবেশন ও উদ্ভাবনের- বাণিজ্যিকীকরণের উপর জোর দিতে হবে।ভাষা, আইসিটি ও উদ্যোক্তা হবার দক্ষতা অর্জন যেন সকল শিক্ষার্থী করতে পারে সেজন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘স্কিল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা অতীব জরুরি। চট্টগ্রাম শহরের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় এর সামাজিক মেলবন্ধন রচনার জন্য টিএসসি’র আদলে একটি সিটি সেন্টার গড়ে তুলতে হবে, যেখানে ছাত্র-শিক্ষক মিলনকেন্দ্র, লাইব্রেরী, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র অন্তর্ভুক্ত থাকবে। যেহেতু শহর থেকে অধিকাংশ শিক্ষার্থী যাতায়াত করে সেহেতু উক্ত সমস্যা দূরীকরণার্থে আরেকটি শাটল ট্রেন যুক্ত করার জন্য ইতিমধ্যেই যে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে তা এগিয়ে নেওয়ার জন্য বর্তমান প্রশাসনকে আরো সক্রিয় হতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিকল্পিত উন্নয়নের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হল অর্থসম্পদের অপ্রতুলতা। চাহিদা মোতাবেক অর্থের বরাদ্দ না পাওয়ায় অনেক সময় উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হয়। তবে অপচয়মূলক খরচ নিয়ন্ত্রণ, আয় বৃদ্ধির জন্য অভ্যন্তরীণ উৎসের উদ্ভাবন, সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থের বিজ্ঞোচিত, পরিকল্পিত ও কার্যকর ব্যবহার সুনিশ্চিত করা গেলে আথিক প্রশাসনে গতিময়তা ও উৎকর্ষতা আনয়ন সম্ভব। উপরন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় এলামনাই অ্যাসোসিয়েশন এবং বিভাগভিত্তিক -ব্যচভিত্তিক এলামনাই এসোসিয়েশনগুলো অ্যান্ড্রোম্যান ফানড গঠনপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে। এই ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণপূর্বক দ্রুত এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করছি।
দীর্ঘ ৫৮ বছরে ৬বার চাকসু নির্বাচন হয়েছে। নিয়মিত চাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গণতন্ত্র চর্চা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের নেতৃত্ব সৃষ্টির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ফলে রাজনীতির মঞ্চে সুবিধাবাদী লোক কিংবা প্রবঞ্চক, ব্যবসায়ী-বেসামরিক-সরকারি আমলার দৌরাত্ম ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা রাজনীতি তথা জাতির জন্য মোটেই শুভকর নয়। আশা করি বর্তমান প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে এগিয়ে যাবেন।
গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মতপার্থক্য থাকাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। এমনকি আদর্শগত বৈসাদৃশ্য থাকাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিভিন্ন মত ও আদর্শের প্রতি আমাদের যদি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ-পরমত সহিষ্ণুতা বজায় থাকে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে আমরা যদি অভিন্ন লক্ষ্যে কাজ করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হই, তবে অনাগত দিনগুলোতে এই বিশ্ববিদ্যালয় অনুসরণযোগ্য গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে, ইনশাআল্লাহ।
আমার জীবনের অধিকাংশ সময় (১৯৭৯-২০২৪) কেটেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে। প্রথমে এই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ও পরে শিক্ষক হতে পেরে আমি গর্বিত। সর্বশেষ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাওয়ার জন্য আমি মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া জানাচ্ছি। উপাচার্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের কল্যাণের জন্য সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি।
ডিগ্রীর জন্য বা একাডেমিক কাজে বা ডেপুটেশনে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ছিল আমার অনন্য ভালোবাসা ও আকর্ষণ যা আমৃত্য থাকবে। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার প্রাপ্তি অনেক, যার দায় শোধ হবার নয়। তাইতো জীবনে যখনই সুযোগ পেয়েছি, চেষ্টা করেছি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কিছু করার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট যেকোনো সুসংবাদ আমার মনকে যেমন আনন্দে উদ্বেলিত করে তেমনি কোন অনিয়ম কিংবা খারাপ সংবাদ মনকে ভীষণ ব্যথিত করে তোলে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আজ এক মহীরুহ অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্তে¡ও তা ছুটে চলেছে নতুন নতুন জ্ঞান ও শিক্ষার্থীদের অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণে। সৌরভে-গৌরবে ও উৎকর্ষতায় এই বিশ্ববিদ্যালয় দীপশিখার মত প্রজ্জ্বলিত থাকুক অনন্তকাল।
সবশেষে আশা করছি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ, শোষনমুক্ত-বৈষম্যহীন-দুর্নীতিমুক্ত-মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় বর্তমান শিক্ষার্থীরা তাদের পূর্বসূরীদের ন্যায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে আরো সমৃদ্ধ করবে, শিক্ষা-দীক্ষায়,জ্ঞান- বিজ্ঞানে, মেধা-মননে, গবেষণা-নতুনত্ব উদ্ভাবনে অনেকদূর এগিয়ে যাবে। তাই আসুন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যিকার অর্থে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, ন্যায়নীতিভিত্তিক নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলা, শিক্ষক- শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি, বিশ্ববিদ্যালয়ে মননশীলতার ক্ষেত্র প্রস্তুত এবং সর্বোপরি শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চয়তা বিধানের জন্য একযোগে কাজ করি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মদিনের মাহেন্দ্রক্ষণে যারা আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। একইসাথে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারসহ সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনদের প্রতি রইল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও চিরন্তন ভালোবাসা।
ড. মো. আবু তাহের প্রফেসর, ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, চবি; সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, ঢাকা ও সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
পূর্বকোণ/এমটি