চট্টগ্রাম রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪

মধ্যপ্রাচ্যে ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ প্রতিষ্ঠার নীলনকশা

আবসার মাহফুজ

১২ নভেম্বর, ২০২৪ | ৪:০০ অপরাহ্ণ

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে ইসরায়েলি বর্বর হামলায় গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ৮ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে নিহতের মোট সংখ্যা ৪৩ হাজার ৫৫২ জন ছাড়িয়ে গেছে। নিহতদের ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু। এছাড়া গত বছরের অক্টোবর থেকে চলা এই হামলায় আহত হয়েছেন আরও লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ মনে করছে, গাজা উপত্যকা জুড়ে ধ্বংস হওয়া বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও ১০ হাজারেরও বেশি লোক নিখোঁজ রয়েছেন। এছাড়া ইসরায়েলি আগ্রাসনের কারণে প্রায় ২০ লাখেরও বেশি বাসিন্দা তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। মূলত ইসরায়েলি আক্রমণ গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। জাতিসংঘের মতে, ইসরায়েলের বর্বর আক্রমণের কারণে গাজার প্রায় ৮৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। আর খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং ওষুধের তীব্র সংকটের মধ্যে গাজার সকলেই এখন খাদ্যনিরাপত্তাহীন অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। এছাড়া অবরুদ্ধ এই ভূখ-ের ৬০ শতাংশ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসরায়েল ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে।

 

মূলত গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব সত্ত্বেও ইসরায়েল অবরুদ্ধ এই ভূখ-ে তার নৃশংস আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের নজিরবিহীন আন্তঃসীমান্ত হামলার পর থেকে ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় অবিরাম বিমান ও স্থল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলি এই হামলায় হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবির, মসজিদ, গির্জাসহ হাজার হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে শুধু ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যাকা নয়, পশ্চিম তীরেও গণহত্যা অব্যাহত রেখেছে ইসরাইয়েল। হিজবুল্লাহ নির্মূলের নামে লেবাননেও নৃশংস বোমা হামলা চালাচ্ছে দেশটি। গত বছর অক্টোবর থেকে লেবাননে ইসরায়েলের বিমান হামলায় নিহতের সংখ্যা চার হাজারে পৌঁছেছে। ইরানের সাথেও সংঘাতে জড়িয়েছে ইসরায়েল। ইতোমধ্যে দুইবার হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটেছে দেশ দুটির মধ্যে। যদিও ইসরায়েল হামাস এবং হিজবুল্লাহকে এমন পরিস্থিতির জন্যে দায়ী করছে। এবং ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ তত্ত্বের প্রচার করছে। কিন্তু হামাস ও হিজবুল্লাহ যে একটি বাহানা তা যে কোনো সচেতন মানুষের পক্ষে বুঝা কঠিন নয়। ইসরায়েল এসব পৈশাচিক গণহত্যার মাধ্যমে আসলেই যে একটি ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ রাষ্ট্রের নীলনকশা পূরণের পথে হাঁটছে তা তাদের অপতৎপরতা দেখলেই বুঝা যায়। তবে সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, ইসরায়েলি লেখক আভি লিপকিনের একটি সাক্ষাৎকার এবং উগ্র ডানপন্থী ইসরায়েলি মন্ত্রীদের বক্তব্যে তা খোলাসা হয়ে গেছে।

 

বিবিসি বলেছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে, ইসরায়েলি লেখক আভি লিপকিনের একটি সাক্ষাৎকার বেশ ভাইরাল হয়, সেখানে তিনি বৃহত্তর ইসরায়েলের ধারণা সম্পর্কে বলেছিলেন- ‘এমন এক দিন আসবে যেদিন আমাদের সীমানা লেবানন থেকে সৌদি আরবের বিশাল মরুভূমি, ভূমধ্যসাগর থেকে ফোরাত নদী (ইরাক) পর্যন্ত বিস্তৃত হবে’। গাজায় হামলার পর লেবাননে ইসরায়েলের চলমান অভিযানের পর থেকে ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’-এর ধারণাটি আবারও সামনে এসেছে। এর একটি কারণ হল গাজায় স্থল-অভিযানের সময় কিছু সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে দাবি করা হয়েছিল যে কিছু ইসরায়েলি সৈন্য তাদের ইউনিফর্মে ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ মানচিত্রযুক্ত ব্যাজ পরেছিল। অন্যদিকে উগ্র ডানপন্থী ইসরায়েলি মন্ত্রীরাও অতীতে এই ধারণাটির কথা উল্লেখ করেছিলেন। আরব দেশগুলোর সোশ্যাল মিডিয়া ইউজাররা এ বিষয়ে বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কারণ ‘দ্য প্রমিজড ল্যান্ড’ (প্রতিশ্রুত ভূখ-) এর মানচিত্রে জর্ডান, ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক এবং মিশরের অংশ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোতে ইসরায়েলি তৎপরতা দিন দিন বাড়ছে। গত কয়েক মাস ধরে ইরান, সিরিয়া এবং লেবাননের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে তারা। যুদ্ধবিরতি ডাকার ক্ষেত্রে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশ ও সংস্থা ব্যর্থ হওয়ায় এবং ৫ নভেম্বরের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ায় ইসরায়েলের কর্মকা- আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। উল্লেখ্য, ইসরায়েলের অনেক ইহুদি বিশেষ করে উগ্র ইহুদিবাদীরা এই অঞ্চলটিকে ‘এরিটজ ইসরায়েল’ বা ‘ইসরায়েলের পবিত্র ভূমি’ বলে মনে করে, যা কিনা ইসরায়েলের বর্তমান সীমানা থেকেও অনেক বড় একটি ভৌগোলিক এলাকা। প্রসঙ্গত, ইহুদীবাদের প্রতিষ্ঠাতা থিওডোর হার্জলের ‘প্রমিজড ল্যান্ড’ বা বৃহত্তর ইসরায়েলের মানচিত্রে মিশরের নীল নদ থেকে ইরাকের ফোরাত নদী পর্যন্ত বিভিন্ন অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ ফিলিস্তিন, লেবানন, জর্ডান, ইরাক, ইরান, সিরিয়া, মিসর, তুরস্ক এবং সৌদি আরবও বৃহত্তর ইসরায়েলের অংশ হবে। তবে ইহুদি ধর্ম অনুযায়ী ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ বলতে মধ্যপ্রাচ্যের সেই সব প্রাচীন এলাকাকে বোঝানো হয় যেগুলো একসময় অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল এবং যেখানে ইহুদিরা বসবাস করত।

 

উল্লেখ্য, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ মেন্ডেট শেষ হওয়ার পর, তৎকালীন লীগ অব নেশনস (বর্তমান জাতিসংঘ) ফিলিস্তিনকে ভাগ করার প্রস্তাব আনে। ওই প্রস্তাবে একটি ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল এবং একটি আরব রাষ্ট্র ফিলিস্তিন এবং মাঝে জেরুজালেমকে একটি আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল করার সুপারিশ করা হয়। এ নিয়ে ইসরায়েলি রাজনীতিবিদ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন বলেন, ‘ফিলিস্তিনের এই বিভাজন ছিল অবৈধ’। তার মতে, ‘জেরুজালেম সবসময় আমাদের (ইহুদি) রাজধানী ছিল এবং থাকবে, সেইসাথে এরিটজ ইজরায়েলের সীমানা চিরতরে পুনরুদ্ধার করা হবে’। এ প্রসঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণকারী ওয়াশিংটনভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক তাকি নুসিরাত বলেন, বৃহত্তর ইসরায়েলের ধারণাটি ইসরায়েলি সমাজে গেঁথে আছে এবং ইসরায়েলি সমাজে সরকার থেকে শুরু করে সেনাবাহিনী পর্যন্ত সবাই এই ধারণাকে সমর্থন করে। তার মতে, ইসরায়েলিরা বিশ্বাস করে যে ধর্মীয় এবং ঐতিহাসিকভাবে এই ভূখ-ের ওপর তাদের অধিকার রয়েছে। আর এই কল্পিত বৃহত্তর ইসরায়েলের ভূখ- কেবল নদী থেকে সমুদ্রের দূরত্বে নয় বরং ‘নদী থেকে নদী পর্যন্ত’ বিস্তৃত, অর্থাৎ ফোরাত নদী থেকে নীল নদ পর্যন্ত এবং এর মধ্যবর্তী পুরো এলাকা ইসরায়েলি ভূখ-ের আওতাভুক্ত হবে। বর্তমান সময়ে যে বৃহত্তর ইসরায়েলের কথা বলা হচ্ছে, তার ধারণার সূচনা এখান থেকেই।

 

নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে উগ্র ইহুদিরা এখন বৃহত্তর ইসরায়েলের নীলনকশা বাস্তবায়নে মনোযোগী হয়েছে। এবং তা তারা করতে চাইছে পৈশাচিক গণহত্যার মাধ্যমে। সে জন্যেই তারা আগ্রাসনের মাধ্যমে ক্রমশ নিজেদের সীমানার বাইরের অঞ্চলগুলোকেও তাদের ভূখ-ের অংশ করছে। তারা বহু আগেই পশ্চিম তীর, গাজা এবং গোলান হাইটস দখল করেছে। এখন লেবানন দখল করতে হামলা জোরদার করেছে। এরপর অন্য দেশগুলোর দিকে নজর দেবে। আর এভাবে তারা ‘প্রমিজড ল্যান্ড’ তথা বৃহত্তর ইসরায়েলের স্বপ্ন পূরণ করবে। এ ক্ষেত্রে তাদের সহযোগী হিসেবে পাশে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলো। রাশিয়া এবং ভারতেরও সায় আছে। মুসলমানদের অনৈক্য এবং নতজানু নীতির কারণে ইসরায়েল এ ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা ইতোমধ্যে নিয়ে ফেলেছে। তবে ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ এর নীলনকশা বাস্তবায়নে এখন প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে ইরান। দেশটি ইতোমধ্যে ইসরায়েলের কিছু সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে ভয় ডুকিয়ে দিয়েছে। তুরস্কও হুঙ্কার দিয়েছে। ইরান সমর্থিত ইয়েমেনের হুতি ও লেবাননের হিজবুল্লাহ তো ইসরায়েলের পথের কাঁটা হয়েই আছে বহু আগ থেকেই। এ অবস্থায় অন্য মুসলিম দেশগুলো একত্রিত হয়ে ইসরায়েল ঠেকাতে জোটবদ্ধ হলে ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন মাঠেই মারা যেতো। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মুসলিমবিশ^ শুধু তেল অস্ত্র প্রয়োগ করলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইসরায়েলের মিত্ররা দেশটির পৈশাচিক আচরণ সমর্থন ও নানা ভয়ঙ্কর অস্ত্রসহ বহুমাত্রিক সহযোগিতা দিতে কুণ্ঠিত হতো।

 

তবে এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি। ইরান যেভাবে সাহসিকতার সাথে ইসরায়েলকে মোকাবিলা করছে; নানা ভয়ঙ্কর ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ইসরায়েলের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে, তা অব্যাহত রাখা সম্ভব হলে ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন মাঠেই মারা যাবে। ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ তো দূরের কথা বর্তমান ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বও রক্ষা করা কঠিন হবে। ইতিহাস বলছে, অতীতেও ইহুদিরা কয়েকবার স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু কোনো সময়ই সেসব রাষ্ট্র ৮০-১০০ বছরের বেশিদিন টিকেনি। কারণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তারা অন্য সম্প্রদায় এবং পাশর্^বর্তী রাষ্ট্রগুলোর ওপর আগ্রাসন চালাতো। যদিও প্রথমে তারা সফল হতো, কিন্তু পরে মজলুম জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইহুদি রাষ্ট্রের পতন ঘটাতো। গাজা এবং পশ্চিম তীর ও লেবাননে ইসরায়েলের বেপরোয়া আগ্রাসন ও গণহত্যার ধরণ দেখে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন- দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশগুলো ইসরায়েলের ‘পকেটে’ থাকার পরও এই রাষ্ট্রটি অস্বাভাবিক রকম অস্থির আচরণ করছে। বিশেষ করে হামাসের হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল গাজার মুসলমানদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে দানবের মতো যা করছে, তা ইসরায়েল কর্তৃপক্ষের ভেতরকার নাজুকাবস্থা ও অস্থিরতাকে সামনে নিয়ে এসেছে। কয়েকদিন আগে ইসরায়েলের একজন মন্ত্রী বলেছেন, গাজায় পারমাণবিক বোমা ফেলা উচিত। মনে হচ্ছে, অস্তিত্ব সংকটে পড়ার মতো কোনো অনুভূতি রাষ্ট্রটির নেতাদের আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। সব দিক থেকে সমৃদ্ধ ও সুসজ্জিত থাকার পরও ইসরায়েল রাষ্ট্রের এমন অস্থির আচরণ তার পতনের ইঙ্গিত বলেই মনে করছেন অনেকে। প্রসঙ্গত, ইসরায়েলকে জড়িয়ে ‘অষ্টম দশকের অভিশাপ’ শীর্ষক একটি শব্দগুচ্ছ আছে। ইংরেজিতে এই টার্মটিকে বলে ‘কার্স অব এইট্থ ডেকেড’। আরবিতে বলে ‘লা’নাতুল আকদিস সামিন’। ‘অষ্টম দশকের অভিশাপ’ টার্মটির জন্ম হয়েছে ইহুদিদের অতিগুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ন্যায়শাস্ত্র তালমুদ-এর একটি ভবিষ্যদ্বাণী থেকে। ভবিষ্যদ্বাণীটি হলো- কোনো ইহুদি রাষ্ট্র আট দশকের বেশি টিকবে না। ভেঙে যাবে। আর সে ভাঙন বাইরের কোনো শক্তির কারণে হবে না। হবে নিজেদের মধ্যকার জাতি-উপজাতির কোন্দল থেকে। এর সত্যতা আছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, গত দুই হাজার বছরে বিভিন্ন স্থানে ছোট বড় সার্বভৌম ইহুদি রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর মধ্যে কিং ডেভিডের (নবী দাউদ আ.) রাজত্ব আর হাসমোনিয়ান রাজত্ব ছাড়া আজ পর্যন্ত কোনো ‘ইহুদি রাজ্য’ ৮০ বছরের বেশি টিকেনি। এই দুই রাজত্বের ভাঙন ধরেছিল ৮০ বছরের মাথায়। এরপর সে দুটো রাজত্ব টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। ফিলিস্তিনের বুকে জোর করে গড়ে উঠা আজকের এই ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ ইসরায়েলের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মে। ২০২৮ খ্রিস্টাব্দে ৮০ বছর পূরণ হবে। তালমুদের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হলে আর তিন-চার বছরের মধ্যে ইসরায়েলের পতন ঘটবে। বিভিন্ন গবেষকের দাবি, এখন এর অনেকগুলো লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে। এর একটি হচ্ছে- গাজা ও পশ্চিম তীর এবং লেবাননে গণহত্যা ও ইরানের সাথে সংঘাতে জড়ানো। ইরান বলেছে, তাদের হাতেই ইসরায়েল নামক জারজ ও অত্যাচারী জায়নবাদী রাষ্ট্রটি নিশ্চিহ্ন হবে। এ অবস্থায় বিশ্লেষকদের অনেকেই বলেছেন, ইসরায়েল বড়জোর শতবছর পূরণ করবে হয়তো, কিন্তু দীর্ঘজীবী বা চিরজীবী হতে পারবে না।

 

উল্লেখ্য, ইসরায়েল শুধু ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে ও তাদের জায়গা-জমি দখল করে নিচ্ছে, তা নয়; দেশটির অভ্যন্তরীণ বিভাজনও এখন চরমে। ইসরায়েলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক সম্প্রতি এক নিবন্ধে বলেছেন, ‘ইসরায়েল সমাজে বিভাজন ও বিভেদ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। বামপন্থী বনাম ডানপন্থী; ধর্মীয় গ্রুপ বনাম সেক্যুলার গ্রুপ; ধর্মীয় জায়নবাদী বনাম ধর্মীয় ইহুদিবাদী গোটা ইসরায়েলি সমাজকে শতধা বিভক্ত করছে, যা ইসরায়েল রাষ্ট্রটির জন্য হুমকি হয়ে পড়েছে।’ এহুদ বারাকের মতোই বিভক্তি নিয়ে তারও আগে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছিলেন, ইসরায়েলের সাবেক প্রেসিডেন্ট রিউভেন রিভলিন। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি হার্জলিয়া কনফারেন্সে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন, ইসরায়েলে ৩৮ শতাংশ সেক্যুলার ইহুদি, ১৫ শতাংশ জায়নবাদী ইহুদি, ২৫ শতাংশ আরব এবং জায়নবাদী নয় এমন উগ্র অর্থোডক্স মৌলবাদীরা আছে ২৫ শতাংশ। রিউভেন বলেছিলেন, এরা নিজেদের মধ্যে যেভাবে বিবাদে জড়াচ্ছে তা উদ্বেগের বিষয়। আগের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট ২০২০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর নির্বাচনী প্রচারে বলেছিলেন, ‘আমাদের অবশ্যই দেশের ভেতর থেকে ভেঙে না পড়ার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে; কারণ ইসরায়েলের মুখোমুখি সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা হলো অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি। আমরা সেই বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছি, যা ইহুদিদের পূর্ববর্তী রাজ্যগুলোর সঙ্গে ঘটেছিল।’ দ্য মিডল ইস্ট মনিটর পত্রিকায় ২০২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ মে প্রকাশিত একটি কলামে লিগ অব পার্লামেন্টারিয়ানস ফর আল কুদস-এর মহাপরিচালক মোহাম্মাদ মাকরাম বালাবি বলেছেন, ইসরায়েলিদের মধ্যে নানা বিভেদ ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান হচ্ছে। হেরেদি সম্প্রদায় ও ধর্মীয় জায়নবাদীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব অনেক গভীর হয়েছে। ২৫ বছর আগে হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমাদ ইয়াসিন বলেছিলেন, ইসরায়েলের ভেঙে পড়ার সময়কাল শুরু হয়ে গেছে। হামাসের বর্তমান মুখপাত্র আবু উবায়দাও তাঁর সর্বশেষ ঘোষণায় ইহুদিদের উদ্দেশে বলেছেন, ইসরায়েলের সময় শেষ। এই যুদ্ধই চূড়ান্ত যুদ্ধ।

 

 

একটি প্রচলিত প্রবাদ হচ্ছে- ‘চেরাগ নিবে যাওয়ার আগে বেশি জ্বলে। ইসরায়েরের আচরণেও এখন তার প্রকাশ ঘটে চলেছে। তাছাড়া ইসরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিতেই বলিয়ান হয়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালাচ্ছে। তাদের ভূমি কেড়ে নিচ্ছে। এমনকি ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু সে পরাশক্তি আমেরিকাও পতনের দিকে হাঁটছে। আমেরিকা শক্তিহীন হওয়া মানে তো ইসরায়েলের পতন অনিবার্য। সুতরাং ইসরায়েল যে শিগগির ‘ন্যাচারাল জাস্টিস’ এর কাঠগড়ায় দাঁড়াচ্ছে তা একপ্রকার নিশ্চিত। আর যেখানে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করাই কঠিন, সেখানে বৃহত্তর ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে, সন্দেহ নেই।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট