চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

অর্থ পাচার এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্পর্ক

ড. নারায়ন বৈদ্য

১১ নভেম্বর, ২০২৪ | ২:৩০ অপরাহ্ণ

‘পাচার’ শব্দের অর্থ হলো গোপনভাবে হস্তান্তর। কোন বিধি নিষেধ না মেনে সবার অজান্তে যখন কোন পণ্য, অর্থ, মেধা, স্বত্ব ইত্যাদি একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে যাওয়া হয় বা স্থানান্তর করা হয় তখন তাকে পাচার বলে। পাচার শুধু যে পণ্য বা অর্থ হয় তা কিন্তু না। মেধা ও হতে পারে। যেমন বাংলাদেশে সম্প্রতি মেধাবী ছাত্ররা বিদেশে চলে যাচ্ছে। বিদেশে গিয়ে তারা সেখানে বিভিন্ন ধরণের পেশায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে এবং মেধার স্বাক্ষর রাখছে। এমন কি গবেষণা করে নিত্য-নতুন বিভিন্ন ঔষধ, যন্ত্র ইত্যাদি আবিষ্কার করছে।

 

তবে সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে, ছোটকাল থেকে পড়ালেখা করেছে এদেশে আর জটিল রোগের ঔষধ, বিভিন্ন প্রকারের যন্ত্র আবিষ্কার করেছে ঐসব দেশে। যদি ছাত্রটি দেশে থাকতো তবে নতুন নতুন পণ্য, যন্ত্র, ঔষধ আবিষ্কারের সুবিধা ভোগ করতো এদেশের মানুষ। অথচ এখন তা ভোগ করছে ঐ দেশের মানুষ। ছাত্রটির মেধা বিকশিত হয়েছে ঐসব দেশে। এটা মেধা পাচার। মেধা পাচার দেশের অর্থনীতিকে সরাসরি ক্ষতি করে না। কিন্তু অর্থ পাচার দেশের অর্থনীতিকে সরাসরি পঙ্গু করে দেয়। কিন্তু কথা হচ্ছে অর্থ পাচার হয় কিভাবে? ধনী ব্যক্তিরা মাথায় করে দেশের অর্থ কি সরাসরি বিদেশে নিয়ে যায়? তা কখনো সম্ভব নয়।

 

দেশের অভ্যন্তরে আইন রয়েছে। যে কোনো ব্যক্তি দেশ থেকে বিদেশে যাওয়ার জন্য তিনটি পথ আছে। স্থল পথ, জলপথ ও আকাশ পথ। প্রতিটি পথে দেশীয় একজন নাগরিক বিদেশে যেতে হলে পাসপোর্ট, ভিসা থেকে আরম্ভ করে অনেকগুলো নিয়ম মেনে যেতে হয়। এ ক্ষেত্রে অর্থ পাচার করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া দেশীয় টাকা (মুদ্রা) বিদেশে চলে না। বাংলাদেশের টাকা সংশ্লিষ্ট দেশের মুদ্রায় রূপন্তর করতে হয়। অতএব লক্ষ-কোটি টাকা পাচার এভাবে সম্ভব নয়। কিন্তু ঘুষখোর, চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজরা উপার্জিত অর্থ পাচার করার জন্য ভিন্ন পথ অবলম্বন করে। এই ভিন্ন পথগুলো কি?

 

এই ভিন্ন পথগুলোর মধ্যে প্রধান পথ হচ্ছে হুন্ডি। বাংলাদেশে উন্মুক্ত গোপনীয়তা (ওপেন সিক্রেট) বলে একটি কথা আছে। অর্থাৎ অবৈধ বিষয়টি সম্পর্কে সবাই জানে, কিন্তু কেউ বাধা দেয় না। এমন কি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও। বাংলাদেশ থেকে অধিক সংখ্যক মানুষ বিদেশে শ্রমজীবি হিসেবে কাজ করার কারণে তারা ব্যাংকের মাধ্যমে জটিল প্রক্রিয়ায় উপার্জিত অর্থকে দেশে পাঠাতে চায় না। বরং হুন্ডি ব্যবসায়ীরা বিদেশে তাদের বাসস্থানে গিয়ে, তাদের নিকট থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে বাংলাদেশের গভীর গণ্ডগ্রামে অবস্থিত তাদের বাড়ীতে খুবই বিশ্বস্থতার সাথে দেশীয় মুদ্রায় তাদের আত্মীয় স্বজনদের নিকট অর্থ পরিশোধ করে। ফলে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসার কথা ছিল তা আসে না।

 

অপরপক্ষে বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজরা এসব হুন্ডি ব্যবসায়ীদের সাথে যোগসাজশে তাদেরকে দেশীয় মুদ্রা পরিশোধ করে বিদেশে বৈদেশিক মুদ্রা গ্রহণ করে। আর এ মুদ্রা দিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। দুর্নীতিবাজরা হুন্ডি ব্যবসায়ীদের সাথে এ প্রক্রিয়া শেষ করতে একদিন ও সময় লাগে না, অর্থাৎ একদিনেরও কম সময়ে হাজার কোটি টাকা বিশ্বের যে কোন দেশে স্থানান্তর করে ফেলে। অথচ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সব জানে কিন্তু তারাও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পরার কারণে তেমন কোনো এ্যাকশন নেয় না। এই তো গেল একটি প্রক্রিয়া। এবার দ্বিতীয় প্রক্রিয়া আসা যাক। দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটি অধিকাংশ অনুসরণ করে ব্যবসায়ীরা। একজন ব্যবসায়ী তার উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে। বিদেশে রপ্তানিকৃত পণ্যের বিনিময়ে যে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জিত হয় তা বৈদেশিক আয় হিসাবে রিজার্ভে অন্তর্ভুক্ত হয়।

 

সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু তিনি ৫ লক্ষ ডলারের পণ্য রপ্তানি করে সরকারকে হিসাব দিয়েছেন ২ লক্ষ ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। সে হিসেবে ট্যাক্স, ফি, ভ্যাট সব পরিশোধ করলেন। দুর্নীতিবাজ আমলা এবং কর্মকর্তারা সব জেনেও অর্থের বিনিময়ে তারা রপ্তানি অনুমোদন দিয়ে দিলেন। পণ্য শিপমেন্ট হলো। যথাসময়ে বিদেশে পণ্য পৌঁছে গেল। পণ্য ক্রেতা পণ্যের দাম ডলার পরিশোধও করে দিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যবসায়ী পাঁচ লক্ষ ডলারের মধ্যে বাংলাদেশে আনলেন ২ লক্ষ ডলার। আর অবশিষ্ট ৩ লক্ষ ডলার তিনি সেই দেশে ব্যাংক একাউন্টে রেখে দিলেন। এভাবে তিনি লক্ষ লক্ষ ডলার পাচার করলেন। এবার আসা যাক তৃতীয় প্রক্রিয়ায়। তৃতীয় প্রক্রিয়াটি হলো ব্যাংক ঋণ নিয়ে পাচার।

 

বাংলাদেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এদেশে শিল্প কারখানা খুলবে। এসব শিল্প কারখানায় অসংখ্য বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হবে। দেশ আস্তে আস্তে এগিয়ে যাবে। এটাইতো নিয়ম হওয়ার কথা। বাস্তবে অনেক ব্যবসায়ী ঋণ নিয়ে শিল্প কারখানায় বিনিয়োগ করে না। বিশেষ করে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়ে ক্ষেত্র বিশেষে কোনো শিল্প কারখানা স্থাপন না করে সব টাকা বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। আবার কিছু ব্যবসায়ীরা বা শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে দুই-এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সব টাকা বিদেশে পাচার করেছে।

 

এসব অর্থ পাচার করার জন্য তারা হুন্ডির সাহায্য নিয়েছে। অথবা একটি ভুয়া কোম্পানীর নামে দামী কোনো যন্ত্রাংশ আমদানি দেখিয়ে সব টাকা বিদেশে নিয়েছে। অথচ আমদানি করেছে স্বল্প দামে অন্য জিনিস। এরূপ দুর্নীতির ক্ষেত্রে বন্দরের কর্মকর্তা, উর্ধ্বতন অফিসার এমন কি সচিবালয়ের বড় বড় কর্মকর্তাদেরকেও ম্যানেজ করতে হয় লক্ষ কোটি টাকা দিয়ে। এ প্রক্রিয়ায় ব্যবসায়ীকে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়। অবশ্য ব্যবসায়ী তা নিয়ে চিন্তা করে না। কারণ তিনি জানেন, ব্যাংক থেকে ঋণকৃত অর্থ ফেরৎ দিতে হবে না। এই তো গেল ব্যবসায়ীদের কথা। কিন্তু রাজনৈতিক নেতা বা সচিবলায়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কিভাবে অর্থ পাচার করে?

 

এ ক্ষেত্রে তারা দুইটি পথ বেঁচে নেয়। প্রথমটি হচ্ছে তারা সহজে ক্যাশ টাকা ধরতে চায় না। তাদের একটি স্বাক্ষরে ব্যবসায়ীরা বা সুযোগ সন্ধানীরা কোটি কোটি টাকা লাভবান হয়। যেমন- পার্বত্য চট্টগ্রামে আমার ৫০০ একর জায়গা ৯৯ বছরের জন্য লিজ নেয়া দরকার। এখান থেকে এই ৯৯ বছরে হাজার কোটি টাকা বংশানুক্রমে আয় আসবে। কাজেই রাজনৈতিক নেতা এবং সর্বশেষ সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরে জায়গাটি পেলে তাদেরকে এক কোটি করে দুই কোটি টাকা ঘুষ দিতে অসুবিধা কোথায়? কিন্তু এ বিজ্ঞ ব্যক্তিরা কখনো ক্যাশ টাকা নেবে না। এমন কি ব্যাংক একাউন্টেও না। তাহলে? তাদের শর্ত হচ্ছে, বিদেশে তাদের একাউন্টে ঘুষের টাকা পৌঁছে দিতে হবে। অতএব হুন্ডির মাধ্যমে ঐদেশে তাদের একাউন্টে টাকা পৌঁছে দেয়। এভাবে গড়ে উঠেছে কানাডায় বেগমপাড়া।

 

এখানে উল্লেখ যোগ্য যে, কানডার বেগম পাড়ায় সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের বাড়ী নাকি বেশি। পরবর্তীতে রয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ী। কিছুদিন আগে আমার এক বৃদ্ধ বন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, টাকা পাচার হলে দেশের ক্ষতি কি? বন্ধুকে বললাম, তোমাকে তাহলে অর্থনীতি বুঝাতে হবে। তার যুক্তি হলো দেশের মুদ্রা তো বিদেশে চলে না। যদি অর্থ পাচার করে থাকে তবে বিদেশের ডলার বিদেশে চলে গেছে। তাতে আমাদের ক্ষতি কী? বললাম, বন্ধু- আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃত হলো- ইউএস ডলার। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে এ ডলার বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

 

আগে প্রতিটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভিত্তি ছিল গোল্ড। এ ব্যবস্থাকে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড বলা হয়। এখন এ পদ্ধতি বিশ্বের কোন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুসরণ করে না। এখন ইউএস ডলারকে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে যে দেশের রিজার্ভ (ডলার) যতই বেশি সেই দেশের ভিত্তি ততই মজবুত। পাচারকৃত ডলারের বিনিময়ে বিভিন্ন মূলধনী দ্রব্য আমদানি করে দেশের উন্নয়নের গতিকে বাড়ানো যায়। যেমন করে বাংলাদেশে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। কাজের বিদেশে যদি অর্থ পাচার হয়ে যায় তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও হ্রাস পাবে।

 

লেখক: পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউএসটিসি।

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট