বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় বাজারগুলোকে আইন করে পলিথিনমুক্ত করা হয়েছিল। শুরুর দিকে বাজারে পলিথিন দেখা না গেলেও শিথিল নীতি ও যথাযথ তদারকির অভাবে ধীরে ধীরে পলিথিনে বাজারে আবারে সয়লাব হয়ে ওঠে। এখন যত্রতত্র পলিথিনের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। অক্টোবর থেকে বর্তমান সরকার সুপার শপে পলিথিন নিষিদ্ধ করেছে। একইভাবে ১ নভেম্বর থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বাজারে পলিথিনের ব্যবহার। তবে আশার কথা হচ্ছে, দেশের সুপার শপগুলোতে আগে থেকেই পলিথিন ব্যবহার করা হয় না। প্রধানত মীনাবাজার, আগোরা, স্বপ্ন, ইউনিমার্টের মতো সুপার শপগুলো আগে থেকেই নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে পলিথিন ব্যবহার করে না। তবে চট্টগ্রাম-ঢাকাসহ গ্রামগঞ্জের সব হাট-বাজারে দেদারছে পলিথিন ব্যবহার হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর প্রধান কারণ সহজলভ্যতা এবং ব্যবহারে সুবিধা।
সাধারণত একটি চটের ব্যাগের দাম পড়ে ৫০ থেকে ৭০ টাকা। সেখানে ৫০ থেকে ৭০ পয়সার একটি পলিথিনে সমপরিমাণ পণ্য পরিবহন করা যায়। পলিথিন সিঙ্গেল ইউজ পণ্য। একবার ব্যবহার করেই মানুষ এটি ফেলে দেয়। এছাড়া দাম কম হওয়ায় বাজারে বিক্রেতাই পলিথিন সরবরাহ করে। অন্যদিকে বাজারে পাটের ব্যাগ ক্রেতাকে নিয়ে যেতে হয়। একটি ব্যাগ অন্তত ৮ থেকে ১০ বার ব্যবহার করা গেলেও এটি পরিবহন এবং সংরক্ষণের যে অভ্যস্ততা ৮০ বা ৯০-এর দশকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিল, তা ফিরিয়ে আনাই সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ। নিত্যজীবনে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার থাকলেও সাধারণত তা পরিবেশবান্ধব নয়। পরিবেশ রক্ষায় পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়ে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের তৈরি পচনশীল ‘পলিথিন’ ব্যাগ নিয়ে এসেছে বাংলাদেশ জুট মিল কর্পোরেশন, যা কেনা যাচ্ছে মাত্র ১০ টাকায়।
সোনালি ব্যাগ বাজারজাত করতে ২০১৮ সালে একটি পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ৭ এপ্রিল বাংলাদেশ জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় এই ব্যাগ উৎপাদনের জন্য। পরবর্তী সময়ও প্রকল্প নেওয়া হয়। আরেকটি প্রকল্প প্রস্তাবিত পর্যায়ে আছে। তবুও সোনালি ব্যাগ যুগে প্রবেশ করেনি বাংলাদেশ। তবে সীমিত পরিমাণে উৎপাদন হওয়া সোনালি ব্যাগ মতিঝিলে বিজেএমসির কার্যালয় থেকে কেনা যায়। এই উদ্ভাবনের বিষয়টি বহির্বিশ্বে জানান দিতে বিভিন্ন দূতাবাসে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে ‘আলোড়ন সৃষ্টিকারী’ পচনশীল পাটের সোনালি ব্যাগ পলিথিনের বিকল্প হিসেবে সৃষ্টির পরিকল্পনা হলেও পলিথিনের দাপট কেন থামানো যাচ্ছে না, এমন প্রশ্ন অনেকের।
পাট থেকে উৎপন্ন এই ব্যাগকে পলিথিনের বিকল্প বলা হচ্ছে প্রায় ৯ বছর ধরে। কিন্তু বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারছে না সরকার। সময়মতো এই প্রযুক্তি বাজারে এলে বাংলাদেশের চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে পারত। কিন্তু বিগত সময়ে মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বশীলরাই এটির অগ্রযাত্রায় বাধাগ্রস্ত করেছে। সাবেক এক মন্ত্রী নিজেই সোনালি ব্যাগের ব্যবসা নিয়ে ভাবছিলেন, যে কারণে কাজটি শেষ সময়ে এসে আটকে যায়। সোনালি ব্যাগ পচনশীল। দ্রুতই পচে যাবে। এমনকি মানুষের পেটে গেলেও তার ক্ষতি হবে না। পলিথিনের মতো কোথাও গিয়ে জমাট বাঁধবে না, পরিবেশন দূষণ হবে না। ফলে পরিবেশবান্ধব হওয়ার পাশাপাশি পচন সৃষ্টিতে কোনো প্রজেক্ট নেওয়ারও দরকার হবে না। সোনালি ব্যাগের দাম প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, এখন প্রতি কেজি এক হাজার টাকায় বিক্রি হয়। প্রয়োজনে আরও কমতে পারে। ব্রেক ইভেন্ট হলে প্রতি পিস সর্বনিম্ন ৬টা পর্যন্ত বিক্রি করা যেতে পারে।
পলিথিন আমাদের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। স্বাভাবিকভাবে পলিথিন পঁচনশীল নয়। ব্যবহৃত পলিথিনের পরিত্যক্ত অংশ দীর্ঘদিন অপরিবর্তিত ও অবিকৃত থেকে মাটি, পানি ইত্যাদি দূষিত করে। পলিথিন মাটির উবর্বরতা হ্রাস করে ও মাটির গুনাগুন পরিবর্তন করে ফেলে। পলিথিন পোড়ালে এর উপাদান পলিভিনাইল ক্লোরাইড পুড়ে কার্বন মনোক্সাইড উৎপন্ন হয়ে বাতাস দূষিত করে পলিথিনের ব্যাগ ও অন্যান্য জিনিস শহরের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ‘নারডল’ নামক এক প্রকার প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রের পানিতে মিশে পানি দূষিত হচ্ছে। এতে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়ছে।
পলিথিন ও বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্য ব্যাপকভাবে ব্যবহারে সারাদেশে খাল-বিল, নদী-নালা থেকে শুরু করে সমুদ্র পর্যন্ত প্লস্টিক ছড়িয়ে পড়ছে। এতে পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। সেই সাথে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। প্লাস্টিক শুধু আসবাবপত্র বা পলিথিনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বর্তমানে নামিদামি কসমেটিক কোম্পানির সাবান, ফেসওয়াস, টুথপেস্ট, বডিওয়াস, ডিটারজেন্ট, বিস্কিট, চানাচুর, চিফস, মশলা ইত্যাদিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন দ্রব্যাদিও মোড়কে মাইক্রোবিড নামক ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি দেখা যায়। যা ব্যবহারের পর নদী-নালা, খাল-বিল ও অন্যান্য জলাশয়ে যাচ্ছে এবং মাছের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করছে। আর এর ফলে চর্মরোগসহ মারাত্মক ক্যান্সার পর্যন্ত হচ্ছে।
পলিথিন পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ প্লস্টিক। হান্স ফন পেখমান নামের এক জার্মান বিজ্ঞানী ১৮৯৮ সালে গবেষণাকালে দুর্ঘটনাক্রমে এটি আবিষ্কার করেন। এরপর নানা গবেষণা করে ১৯৪৪ সালে বাণিজ্যিকভাবে এটি বাজারজাত করা হয়। বাংলাদেশে ১৯৮২ সালে প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পলিথিনের উৎপাদন শুরু হয়। সেই থেকে চলছে। ২০১৭ সালের এক বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ১০ কোটি টন পলিথিলিন রেজিন উৎপাদিত হয় প্রতিবছর। প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও পলিথিনের মাত্র ১ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়। সমুদ্রে ফেলা হয় ১০ শতাংশ। ব্যবহৃত পলিথিন আগুনে পুড়িয়েও ধ্বংস করা যায় না। কারণ পলিথিন পোড়ালে কয়েক ধরনের বিষাক্ত গ্যাস উৎপন্ন হয়ে বাতাসে মিশে যায়, যা থেকে ক্যান্সার, চর্মরোগ, লিভার, কিডনি ড্যামেজসহ জটিল রোগ হয়।
পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন করতে প্রতিবছর পৃথিবীজুড়ে মোট খনিজ তেলের ৪ শতাংশ ব্যবহৃত হয়। এক টন পাট থেকে তৈরি থলে বা বস্তা পোড়ালে বাতাসে দুই গিগা জুল তাপ এবং ১৫০ কিলোগ্রাম কার্বন ডাই-অক্সাইড ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে এক টন পলিথিন ব্যাগ পোড়ালে বাতাসে ৬৩ গিগা জুল তাপ এবং এক হাজার ৩৪০ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। পরিবেশ সুরক্ষার সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে আমরা চতুর্থ স্থান অর্জন করেছি। না, খুশির খবর নয় এটা। আমরা অর্জন করেছি শুরুর দিক থেকে নয়, উল্টো দিক থেকে। অর্থাৎ খারাপের দিক থেকে চতুর্থ।
এ বছর প্রকাশিত বিশ্ব পরিবেশ সুরক্ষা সূচকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৭তম। এর আগে ২০২০ সালের তালিকায় ১৬২তম ছিলাম। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পরিবেশ সুরক্ষা এজেন্সি (ইপিআই) থেকে প্রতি দুই বছর পর পর প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। তার মানে, দুই বছরে পরিবেশ সুরক্ষায় আমরা ১৫ ধাপ পিছিয়ে পড়েছি। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ ব্যবহার করলে পরিবেশদূষণ রোধ হবে। বর্তমানে বছরে ৫০০ বিলিয়ন পচনশীল ব্যাগের বৈশ্বিক চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদাকে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন ধারা সূচনা হবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলেজ-শিক্ষক।
পূর্বকোণ/ইব