শেষপর্ব। বিশ্বব্যাপী ডলার সংকটের কারণ-
ক) আমদানী রফতানী ঘাটতি, খ) রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধের ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপসহ মিত্র দেশগুলোর সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি, গ) রেমিটেনস প্রবাহ কমে আসা, ঘ) রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে যুক্তরাস্ট্রের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধ আরোপ, ঙ) জ্বালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও সরবরাহ কমে যাওয়া, চ) উন্নয়নশীল দেশগুলোয় দুর্নীতি ও বিদেশে টাকা পাচার, ছ) অস্বাভাবিক মুনাফা লাভের আশায় ব্যবসায়ীদের দ্বারা অতিরিক্ত ডলার কিনে মজুদ করা।
বাংলাদেশে ডলার সংকটের কারণ :
ক) বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুল নীতি: বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দর স্থিতিশীল রাখতে গিয়ে ডলার বাজারের উপর কড়াকড়ি আরোপ করে। এতে ব্যাংকগুলো বেশী দরে ডলার কিনেনি। যার সুযোগ নিয়েছে অবৈধ ডলার ব্যবসায়ী বা হুন্ডি এজেন্টরা। তারা বেশী দরে ডলার কেনায় প্রবাসীরা অবৈধপথে রেমিটেনস পাঠান। এতে রেমিটেনস কমে যাবার প্রভাব পড়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। খ) প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়াই বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপনের অনুমতি দেয়া: ২০১১ সালে কোন ধরনের প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়াই ব্যক্তিখাতে বিদ্যুৎপ্লান্ট স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়। সব রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের জন্য প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয়েছে। রেন্টার পাওয়ার প্লান্ট এর জন্য যেসব উপকরণ বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়েছে বা হচ্ছে তার মূল্য পরিশোধ করতে হয় বৈদেশিক মুদ্রায়। একই সময়ে সাপ্লাইয়ারস ক্রেডিট পরিশোধের সময় চলে আসে। সব মিলিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার উপর চাপ সৃষ্টি হয়। গ) পদ্মা সেতুর টোল আদায়ের দায়িত্ব কোরিয়ান ও চীনা কোম্পানীকে দেয়া : যা টোল আদায় করা হবে তার থেকে কোরিযান ও চীনারা নিজেদের পাওনা বা হিস্যা নিজ দেশে নিয়ে যেতে পারবে মার্কিন ডলারে। ফলে আমাদের মার্কিন ডলার রিজার্ভের উপর অহেতুক চাপ পড়ে। ঘ) এলএনজি গ্যাস আমদানী: বাংলাদেশে গ্যাস পাওয়ারসমূহ সম্ভাবনা থাকলেও গ্যাস অনুসন্ধানের পরিবর্তে সরকার আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এলএনজি আমদানীর চেষ্টা চালাচ্ছে। ব্রুনাই এর সঙ্গে দুই দুইবার ২০১৯ ও ২০২৩ যৌথ ঘোষণা সত্ত্বেও সে দেশসহ বিভিন্ন উৎস থেকে প্রতিযোগিতামূলক শর্ত বা দরে আমদানী না করে অন্য দেশ থেকে এলএনজি আমদানী করতে হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাজারে এলএনজির মূল্য অনেক বেড়েছে। ফলে এলএনজি আমদানী বাবদ বাংলাদেশকে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে। ঙ) টাকা পাচার বেড়ে যাওয়া: জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়ে যায়। যারা বিদেশে অর্থ পাচার করেন তারা স্থানীয় মুদ্রার বিনিময়ে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে তা বিদেশে পাচার করে থাকেন। দেশ থেকে অর্থ পাচার কিভাবে বেড়েছে তার একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ১৪.১ শতাংশ। অর্থবছর শেষে ১০.৫৮ শতাংশ অর্জিত হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল, একই সময়ে শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল আমদানী কমেছে ১৪ শতাংশ। মধ্যবর্তী পণ্য আমদানী কমে যায় প্রায় ২৪ শতাংশ এবং ক্যাপিটেল মেশিনারিজ আমদানী কমে যায় প্রায় ৩৭ শতাংশ।তাহলে প্রশ্ন জাগে, ব্যক্তিখাতে যে ব্রাংকঋন দেয়া হয়েছিল তা কোথায় গেল? অর্থাৎ, ব্যক্তিখাতে যে ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছিল তা অন্যখাতে প্রবাহিত করা হয়েছে। অর্থাৎ, ঋণের বৃহদাংশ বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
বাংলাদেশে ডলার সংকটের প্রভাব:
ক) বিদ্যুৎখাত: ডলার সংকটে বিল বকেয়া থাকায় পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। খ) জ্বালানী খাত: শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে তেল আমদানীর বিল দিতে পারেনি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন। গ) জরুরি পণ্য, মেডিকেল ডিভাইস ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধ আমদানী কমেছে। ঘ) এলসি খোলা কমেছে। ঙ) এফ কমার্স ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া: বাংলাদেশে ফেসবুকে বিজ্ঞাপনের কার্যক্রম সীমিত করার ঘোষণা দেয় এইচটিটিপুল। চ) শিল্পখাত : মোংলা বন্দর দিয়ে গাড়ী আমদানী কমেছে। ছ) সিমেন্ট শিল্প: গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় লোডশেডিং এর কারণে বেশ কিছুদিন ধরে সিমেন্ট উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। জ) প্রকৌশল শিল্প: সামগ্রিকভাবে শিল্প উৎপাদন কমে গিয়েছে।
বাংলাদেশে ডলার সংকট উত্তরণে করণীয় :
ক) সরকারী দুর্নীতিগ্রস্থ অফিসার/আমলারা টাকা পাচার করেছেন। বেশী দামে যন্ত্রপাতি ক্রয় আদেশ দিয়েছেন ইত্যাদি। এগুলো সংশোধন হবার নয়। একটি বিশেষ প্রাণীর লেজ কখনও সোজা হয় না। দুর্নীতির সিনডিকেট ভেঙে দিতে হবে। খ) বৈধ পথে রেমিটেনস কম আসা। কয়েক লক্ষ রেমিটেনস যোদ্ধা আছে সারা দুনিয়ায়, যারা বৈধপথে রেমিটেনস পাঠাতে চাইলেও পাঠাতে পারেন না। কারণ তারা গেছেই অবৈধ পথে, থাকে অবৈধ ভাবে, বৈধ কাগজ পত্রই নেই। ব্যাংকে যাবার সাহস নেই,পায়না ব্যাংকিং/ এম্বাসির কোন সহযোগিতা। অন্যদিকে অবৈধপথে পাঠালে বিনিময় রেট ভাল পায়। কাগজপত্র ঘাটাঘাটির দরকার হয় না। কাজেই ২ শতাংশ বোনাস আসলে কোন কাজের ঘোষণা নয়। গ) খোলা বাজারে কিন্তু ডলারের সংকট নেই। কিন্তু বৈধভাবে তা সরকারী খাতায় দেখানো সম্ভব নয়। আগে কাঁচা সোনা যেমন আসতো, এখন ক্যাশ ডলার হু হু করে মানুষ পকেটে করে নিয়ে আসছে। কয়টা ধরা পড়ে? সরকারের উচিৎ লোভনীয় ডলার বহনের সুযোগ দেয়া ফেরত যাত্রীদের জন্য। যেমন ফেরত যাত্রীরা ১০ হাজার ডলার নয়, বরং ৩০ হাজার ডলার নিয়ে দেশে ঢুকতে পারবে প্রতি মাসে। ভ্রমণ ভিসায় ৫০০ ডলারের উপর নিতে পারবে না। ভ্রমণ ভিসা তারাই পাবে যাদের বাৎসরিক ইনকাম ২০ লক্ষ টাকার উপরে। ঘ) স্টুডেন্ট ভিসা/ভ্রমণ/চিকিৎসা ভিসা কমিয়ে দেয়া দরকার। শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। ঙ) বিদেশী শ্রমিক যারা বাংরলদেশে কর্মরত আছেন, তাদের বেতন সেই দেশের প্রচলিত মুদ্রায় হবে। সরাসরি সেই দেশের মুদ্রায় বেতন পাবে এমন রুল জারি করতে হবে। ডলারে কনভার্ট করা হবে না। যেমন, ভারতীয় যারা গার্মেন্টসসহ অন্য জায়গায় কাজ করছেন তাদের বেতন হবে রুপীতে। রুপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রে যে সহস্রাধিক রাশিয়ান কর্মী আছেন তারা রুবেলে বেতন পাবে। এভাবে ডলারের উপর চাপ কমবে। চ) ভিসা আবেদন ফি থেকে প্রাপ্য অর্থ ডলারে কোন দেশ নিতে পারবে না নিয়ম করতে হবে। নিতে হবে নিজ দেশের মুদ্রায় বা বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বেঁধে দেয়া মুদ্রায়। ধরা যাক, ইউএস ভিসা ফি প্রায় ২০ হাজার টাকা এবং সেখান থেকে প্রাপ্য অর্থ তারা নিজ দেশে নিয়ে যায় ডলারে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০০০ আবেদন করে। তার মধ্যে প্রায ১০ শতাংশ কনফারমেশন পায়। এই প্রক্রিয়ায় (২০০০ গুন ২০০০০ ) ২ কোটি টাকা। মাসে ৫০ কোটি টাকা।এভাবে ৫১টি এম্বাসি প্রতি মাসে ১০২ কোটি টাকা এবং বছরে প্রায় ১২২৪ কোটি টাকা। সব নিয়ে যাচ্ছে ডলারে। ছ) বিলাসীদ্রব্য আমদানীতে কড়াকড়ি আরোপ করা।
আলোচনার সারমর্ম হিসাবে বলতে চাই যে, রিজার্ভ সংকট এবং ডলার সংকট কাটিয়ে উঠতে আমলাতান্ত্রিকতা পরিহার করে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ নিয়ে স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেয়া উচিৎ। নচেৎ বাংলাদেশে রিজার্ভ সংকট উৎরানো কঠিন হবে।
লেখক: ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে, স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক।
পূর্বকোণ/ইব