বর্তমান বিশ্ব ভয়াবহ নৈতিক সংকটে নিপতিত। যার প্রভূত প্রভাব মানবজীবনকে অস্থির করে তুলছে। ফলশ্রুতিতে হিংসার আগুন মানবিক সত্তাকে অঙ্গারে পরিণত করছে। যার দরুণ সন্তাস, সংকট, অসুস্থ প্রতিযোগিতা এবং নৈতিকতার অবক্ষয় সামগ্রিক জীবনে সংকটের ইন্ধন যোগাচ্ছে। যার থেকে পরিত্রাণের দাওয়াই একমাত্র নিহিত রয়েছে আধ্যাত্মিক এবং এর ধারক-বাহকগণের অনুসৃত জীবনধারায়। মুশকিল কোশা, হাযত রাওয়া, হযরত শাহজাহান শাহ্ (রহ.) হচ্ছেন সেই আলোর সারথিদের একজন, যার জীবনাদর্শে রয়েছে মানুষের ইহজাগতিক ও পারলৌকিক জীবনের মুক্তির সঠিক বার্তা। এ জনপদের জাতি-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই তাঁর মাজার জিয়ারত করেন এবং মকছুদ হাসিলকরণে উছিলা হিসেবে সাহায্য প্রার্থনা করেন। এই প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য হচ্ছে আধ্যাত্মিকতার সাথে নৈতিকতার সম্পর্ক নির্ণয়পূর্বক সমকালীন বিশ্ব সংকটকে আলোচনা করা এবং এই সংকট দূরীকরণে সুফি ব্যক্তিত্বদের আদর্শ কিভাবে মোক্ষম দাওয়াই হতে পারে, তার স্বরূপ বিশ্লেষণ করা।আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে স্বীয় আত্মার চরম উৎকর্ষসাধনপূর্বক স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের উপযুক্ততা অর্জন করা।
আল্লাহ্পাকের নৈকট্য লাভের প্রধান শর্ত হচ্ছে নিজ আত্মাকে কলুষমুক্ত করে, স্রষ্টার আরাধনাকে প্রধান বিবেচনাপূর্বক ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াকে তাচ্ছিল্য করা। যারা এ প্রক্রিয়ায় আত্মশোধনে সফল হয়েছে, তাঁরাই সম্মানের আসনে উজ্জীবিত হয়েছে। দেহ হচ্ছে পাপ-পুণ্যের আধার। মানুষের এই ক্ষুদ্র, পচনশীল দেহটি রহস্যে ভরপুর। সুন্দর চামড়ার আবরণের ভেতর রয়েছে বীভৎস সব উপকরণ। গল্পের সেই স্বর্ণের ডিমপাড়া হাঁসের মতো। ক্ষুদ্র দেহ অথচ এখানেই রয়েছে পাপ-পুণ্য-কাম-ক্রোধ-হিংসা ইত্যাদি। এগুলোকে পরাভূত করে, স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণের সাধনাই হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা। শরীর রহস্যের উৎসমূল। চেনা বড় দায়, অথচ নিজের প্রাণের সাথে সম্পৃক্ত। কবি বলেছেন, “সারা জীবন পোঁয়ারে, ন চিনিলাম তোমারে’। অর্থাৎ নাফসাহু, ফাকাদ আরাফা রাব্বুহু। অর্থাৎ যে নিজেকে চিনেছে, যে আল্লাহ্কে চিনেছে।”
বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্ব মানুষের অন্তর্জগতে ভয়াবহ পরিবর্তন ঘটিয়েছে। মানুষ ভোগবাদের বিনাশী ছোবলে কান্ডজ্ঞান হারিয়ে উন্মত্ত আচরণে লিপ্ত। তাই পৃথিবী জুড়ে অশান্তি। মানুষ হিশেহারা। সব কিছুই পণ্যের মতো দরে বিক্রি হচ্ছে। মানুষ আখের-জাহান ভুলে পণ্যের দাসত্বে মশগুল। বেমালুম কিয়ামত সম্পর্কে। সম্পূর্ণ উদাসীন আউলিয়ায়ে কেরাম সম্পর্কে। ইহজগত ভুলিয়ে দিয়েছে নিজের ভেতর লুকানো অন্তর্শক্তিকে। তারুণ্যের অমিত তেজও আজ বিভ্রান্ত। এর মূলে রয়েছে তথাকথিত আধুনিকতা। আসলে যার প্রকৃত নাম হওয়া উচিত বিকৃতি। প্রযুক্তির উৎকর্ষের ইতিবাচক ব্যবহারের পরিবর্তে তা নৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে। ফলে একদিকে আধ্যাত্মিকতার সংকট আর অন্যদিকে নৈতিকতার চরম অবক্ষয় বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে।
এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য আল্লাহ্পাকের মকবুল ওলিদের তরিকা মোতাবেক চলতে হবে। অনুসরণ করতে হবে সিরাতুল মোস্তাকিমের পথ। আল্লাহ্পাক এই ধরাভূমে যে সমস্ত গাউস-কুতুব পাঠিয়েছেন, পথভ্রান্ত মানবসম্প্রদায়ের দিশারীরূপে, তাঁদের যাপিত জীবন থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আল্লাহ্ কঠোর পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে তার খাসবান্দাদের পছন্দপূর্বক অতি রূহানি শক্তি প্রদান করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা বহু কেরামত প্রদর্শন করেন। জগৎপূজ্য সাধক হযরত শাহজাহান শাহ্ (রহ.)-এর মাজারকে কেন্দ্র করে এ রকম বহু অলৌকিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। হাযত পূরণের ওসিলায় জিয়ারত করেন নারী-পুরুষ, জাতিভেদ ভুলে। এ জনপদে এ এক অনন্য উদাহরণ। কথিত আছে, বাবা হযরত শাহজাহান শাহ্ (রহ.)-এর মাজারে বনের হাতি পর্যন্ত এসে জিয়ারত করে যায়। এসব শুনে অনেকে অবিশ্বাসের ঢেঁকর তুলে। যুক্তির নিরিখে বিচার করলেই স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যাবে। মানুষ যদি বনে বিশালাকার হাতিকে ধরে নিয়ে এসে সার্কাসে নাচাতে পারে, মাহুত যা ইশারা করে তাই করে, তাহলে পরম স্রষ্টার নির্দেশে সে হাতি কি মাজারে আসতে পারে না? অবশ্যই পারে। সৃষ্টির সেরা মানুষ নাফরমানি করলেও বনের প্রাণীরা তা করে না।
হযরত শাহজাহান শাহ্ (রহ.) নিজ জন্মভূমি ইয়েমেনের সমস্ত মায়া ত্যাগ করে আল্লাহ্‘র রাহে জীবন উৎসর্গ করে এ জনপদে এসেছিলেন। মানুষের আত্মার মুক্তির জন্যে, শ্বাপদ-সঙ্কুল জনপদে রহমতের সুধা বিলিয়েছেন, যখন জীবন ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। সে অবস্থাতেই বাবাজান তাঁর কলবের নূর দিয়ে তিমির অমানিশা দূর করে মানবাত্মার কল্যাণে নিজেকে সঁপেছিলেন পরম প্রভুর দরবারে। ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর মায়াবীবন্ধন ছিন্ন করে সমস্ত প্রাণীজগতের মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। অথচ মানুষ কিসের মোহে যেনো পরম দয়াময় ও তাঁর মনোনীতদের প্রতি উদাসীন! দুনিয়া তাদেরকে গাফেল করে রেখেছে। এ সম্পর্কে হযরত আলী (র.) তাঁর নাহজ-আল বালাঘা কিতাবে বলেন, “কিভাবে আমি এ দুনিয়ার বর্ণনা দেব যার প্রারম্ভ দুঃখ-দুর্দশা এবং পরিসমাপ্তি ধ্বংসে। এখানে হালাল কাজের জন্য জবাবদিহিতা রয়েছে এবং নিষিদ্ধ কাজের জন্য শাস্তি রয়েছে। এখানে যে ধনবান, তাকে ফেতনা-ফ্যাসাদ মোকাবেলা করতে হয়, আর যে দরিদ্র সে দুঃখ-দুর্দশায় নিপতিত। যে ব্যক্তি দুনিয়ার প্রতি লালায়িত হয় সে তকা পায় না। আবার যে ব্যক্তি দুনিয়া থেকে দূরে সরে থাকে তার দিকে দুনিয়া এগিয়ে যায়। যদি কেহ দুনিয়ার মধ্য দিয়ে দেখতে চায়, তবে দুনিয়া তাকে অন্ধ করে দেয় (অর্থাৎ গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট করে দেয়)”। [Imam Ali Ibn Abu Talib: Nahjul Balagha (Peak of Eloquence), Tahrike Tarile Qur’an, Inc., New Yourk, 1986, p.205-06]। হযরত আলী (র.) দুনিয়া সম্পর্কে যে উপলব্ধির বয়ান করেছেন তা আল-কোরআন দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ্পাক এরশাদ করেছেন, “এ দুনিয়ার প্রারম্ভ দুঃখ-দুর্দশায়, এর সমাপ্তি ধ্বংসে [৪০:৪]”।
আজকে দুনিয়াব্যাপী জুলুম চেপে বসেছে। মজলুমের আর্তনাদে আল্লাহ্’র আরশ কেঁপে উঠে আর জালেমের বোধোদয় হয় না। নৈতিকতার অবক্ষয় তাদের অন্তরকে নিষ্প্রাণ পাথরে পরিণত করেছে। নৈতিকতা হচ্ছে নীতির সঠিক প্রকাশভঙ্গি। অন্তরের অন্তর। নৈতিকতা বিসর্জিত হলে নষ্ট হওয়ার অবশিষ্ট আর কিছু থাকে না। ব্যক্তি দেহ রক্ত-মাংস আর হাড়ের সমন্বয়ে গঠিত। এ প্রাণশক্তি হচ্ছে নৈতিকতা। ব্যক্তির আসল মেরুদন্ড হচ্ছে নৈতিকতা। শারীরিক কাঠামো যতোই সুন্দর হোক না কেন, যদি মেরুদন্ড না থাকে, তাহলে দেহ দাঁড়াতে পারবে না। মানুষের জীবনে নৈতিকতাও তাই মেরুদন্ডস্বরূপ। নীতিহীন-চরিত্রহীন ব্যক্তি পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির শত্রু। আজকে নীতিহীনতাই সমস্ত বিশ্বব্যাপী মানবিক সংকট সৃষ্টি করছে। হযরত শাহজাহান শাহ্ (রহ.)-এর শিক্ষা আজকে এজন্যই প্রয়োজন যে, তাঁর নির্মোহ জীবনবোধই তাঁকে সুদূর ইয়েমেন থেকে এ জনপদে নিয়ে এসেছে। জীবনে ত্যাগের যে শিক্ষা, তা তাঁর অনুপম চরিত্রে প্রতীয়মান। তাই ধলই শাহী দরবার শরীফ আজ রহমতের বাগিচায় পরিণত হয়েছে।
ধৈর্য্যহীনতাই অনৈতিকতার জন্ম দেয়। আজকে পৃথিবী জুড়ে যে অস্থিরতার হাওয়া আতঙ্কের সৃষ্টি করছে, তার মূল নিহিত রয়েছে অনৈতিকতার খোলসে। একমাত্র সবর এবং বিবেকবোধের সমন্বয়সাধনের মাধ্যমে এ দুর্বিষহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ সম্ভব। এ সম্পর্কে হযরত আলী (র.) বলেন, “হে লোক সকল। সংযম হলো কামনা-বাসনাকে কমিয়ে ফেলা, আল্লাহ্্র নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তা থেকে দূরে সরে থাকা। আল্লাহ্’র নেয়ামত প্রাপ্তিতে শুকরিয়া জ্ঞাপন করতে ভুলে যেয়ো না। যদি শুকরিয়া জ্ঞাপনে ভুল না হয় তবে নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ তোমাদের ধৈর্য্যকে পরাভূত করতে পারবে না।…এ দুনিয়া দূষিত, ময়লাযুক্ত ও কর্দমযুক্ত পানীয়ের উৎস। এর বহির্ভাগ হৃদয়কাড়া আকর্ষণীয় এবং অভ্যন্তরভাগ ধ্বংসাত্মক। এটা ছলনাময়ী, প্রবঞ্চনা ও বাঁকা স্তম্ভ।” [Imam Ali Ibn Abu Talib: Nahjul Balagha (Peak of Eloquence), Tahrike Tarile Qur’an, Inc., New Yourk, 1986, p.205-06].
আমাদের জীবনে যদি আল্লাহ্, তাঁর প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ (স.) ও আল্লাহ্‘র ওলি-বুজুর্গের শিক্ষা কাজে-কর্মে ফতিফলন ঘটাতে পারি, তাহলে পৃথিবীতে শান্তির বাতাস বইবে। আজকে হযরত শাহজাহান শাহ্ (রহ.)-এর মাজার হচ্ছে রহমতের বাতিঘর। সাধনাসিদ্ধ হলেই এরকম জগৎপূজ্য ওলির সৃষ্টি হয়। আল্লাহ্‘র রহমত এবং মুশকিল কোশা, হাযত রাওয়া হযরতের ওসিলায় যেন বিশ্বব্যাপী অস্থিরতার অবসান ঘটে।
লেখক : রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
পূর্বকোণ/ইব