চট্টগ্রাম শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

দেশে বিভাগগুলো প্রদেশে রূপান্তরিত করা সময়ের দাবি

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী

৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ | ১২:২০ অপরাহ্ণ

দেশের বিভাগগুলোকে প্রদেশে উন্নিত করার ব্যাপারে অনেক আগে থেকে বক্তৃতা বিবৃতি শুনে আসছিলাম। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বক্তৃতা বিবৃতিতেও শুনেছিলাম বলে মনে পড়তেছে। গত ৮ সেপ্টেম্বর একটি দৈনিকে একটি বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশিত হয় প্রথম পৃষ্টায় অতীব গুরুত্ব দিয়ে ফলাও করে। বিশেষ নিবন্ধটি লিখেন বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা সাবেক নিবার্চন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন। অনেকে অবসরে গিয়ে নীরবে নিবৃত্তে চলে যান, কিন্তু সাখাওয়াত হোসেন এর ব্যতিক্রম। তিনি বক্তব্য বিবৃতির মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় জাগ্রত রয়েছেন। তাঁর বিশেষ নিবন্ধটি দেশের কল্যাণে যুগপোযুগী। তিনি দেশের কল্যাণে একাধিক সুপারিশ উল্লেখ করেন। তৎমধ্যে একটি হল দেশের বিভাগগুলোকে প্রদেশে উন্নিত করা। তাঁর সাথে আমি শতভাগ একমত এবং তা পাকিস্তান আমলেই হওয়া উচিত ছিল; অথচ হল না। স্বাধীন বাংলাদেশের শুরু থেকে আমাদের দায়িত্ব ছিল বিভাগগুলোকে প্রদেশে উন্নিত করা। কিন্তু আমাদের সরকারপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান তা গ্রহণ করলেন না, মেনে নিলেন না। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি তাঁরা ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষপাতি নয়। পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে আমাদের এ অংশে জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি। পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল আরও কম। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল চার প্রদেশ। সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ খাইবার পাখতুনখাওয়া। বর্তমানে ৫৩ বছরের ব্যবধানে আমাদের জনসংখ্যা ৭ কোটির স্থলে দ্বিগুণের চেয়ে বেশি বেড়ে ১৭ কোটিরও অধিক।

 

আমাদের দেশে শুধুমাত্র নির্বাচন জনসংখ্যাকেন্দ্রীক। বাকী প্রশাসনিক যাবতীয় কিছু ঢাকাকেন্দ্রীক তথা রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধানের একক নিয়ন্ত্রণ বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বিভাগগুলোকে প্রদেশ করার পক্ষে যুক্তিতে উল্লেখ করেছেন যে, ‘বাংলাদেশ জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে ৮ম বৃহত্তম দেশ। জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি। ছোট দেশ হলেও এত বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে সরকারকে নিয়ে যেতে হলে বাংলাদেশকে ন্যূনতম ৫টি প্রদেশে ভাগ করে একটি ফেডারেল কাঠামোর রাষ্ট্র করা যেতে পারে।’ পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলে ২টি করে ৪টি প্রদেশ এবং ঢাকা নিয়ে আরেকটি প্রদেশ। মেট্রোপলিটন ঢাকা কেন্দ্রশাসিত থাকবে। কেন্দ্রের হাতে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, সীমান্ত ও সমুদ্রনিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ ও বৈদেশিক সাহায্য সহযোগিতার মত বিষয়গুলো থাকবে। বাকী বিষয়গুলোতে প্রদেশগুলো ব্যবস্থাপনায় থাকবে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণও হবে প্রাদেশিক সরকার কাঠামোতে। বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক ও চিন্তাবিদরা অনেক আগে থেকেই দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের দাবী করে আসছেন। এটি শুধু সময়ের দাবীই নয় আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনা ও সুষ্ঠু ধারার রাজনীতির জন্য আবশ্যক। প্রসঙ্গক্রমে আরও বলতে হয়, বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলতে চাচ্ছেন সার্কের ‘একমাত্র মালদ্বীপ ছাড়া অন্য সব দেশে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ বিদ্যমান।’ সব সার্কভুক্ত দেশে গমন করা হয়েছে আমার। কিন্তু মালদ্বীপের পাশাপাশি ভূটানেও দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট থাকার কথা জানা নেই।

 

ফেডারেল তথা রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংস্কারের অন্যতম দিক হওয়ায় নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকেও সংস্কারের আওতায় আনতে হবে। পরিবর্তন করতে হবে ভোটের আইন এবং পদ্ধতি। অর্থাৎ একদলীয় শাসনের একনায়কতন্ত্র আগামীতে যাতে পুনঃ প্রবর্তন হতে না পারে সে লক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সচেষ্ট থাকতে হবে। বস্তুত দেশের বিভাগগুলোকে প্রদেশে রূপান্তর করা এখন সময়ের দাবী। বিদেশ থেকে একটি রাজনৈতিক দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ঘোষণা প্রচার মাধ্যমে বারে বারে জানতে পারা যাচ্ছে, তিনিও বলতেছেন ‘দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট করার জন্য।’ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বিগত ৫৩ বছরের ইতিহাসে সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক একনায়কতন্ত্র শাসন ছিল বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। বিরোধীদলের স্বাধীনতা ও ভিন্নমত দমন করাই ছিল ক্ষমতাসীন দলের বৈশিষ্ট্য। ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রামের বৈশিষ্ট্য, আভিজাত্য কম বেশি গুরুত্ব পেত বলে প্রতীয়মান হত। স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৩ বছরে এই চট্টগ্রাম গুরুত্ব হারাতে হারাতে অনেকটা অন্যান্য বিভাগীয় শহরের পর্যায়ে নেমে আসে। মাত্র ৪ শত বছরের ঢাকা হাজার বছরের চট্টগ্রামের সক্রিয় অবস্থান পর্যায়ক্রমে ঝিমিয়ে ফেলা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এতে সচেতন চট্টগ্রামবাসীর শতভাগ হৃদয় ব্যতীত বলে আমার বিশ্বাস।

 

প্রাদেশিক সরকার গঠিত হলে দেশ লাভবান হবে তাতে কোন ইতস্ততা নেই। আজ ঢাকার পরিবেশ বিপর্যস্থ বায়ুদূষণসহ অত্যধিক চাপে মানুষের বসবাসের অযোগ্য প্রায়। ঢাকা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম ভয়াবহ যানজটের শহর। প্রায় ২ কোটির অধিক লোকের বসবাস। বিভাগীয় সদরের প্রধান প্রধান ব্যক্তিদেরকে ঘনঘন ঢাকা দৌড়াদৌড়ি করতে হয় অনুমতি ও সিদ্ধান্ত পাওয়ার লক্ষে। এতে তাদেরও মন-মানসিকতার পরিবর্তন আসে। পরিবর্তন আসে পরিবার পরিজন ঢাকায় রেখে দেয়ার জন্য। নির্বাচন ব্যবস্থাপনা, পুলিশ প্রশাসনসহ রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো যদি সরকার প্রধানের একনায়কতন্ত্র তথা কঠোর নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত না হয় তবে প্রাদেশিক সরকার প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও শতভাগ সুফল পাবে বলে মনে হয় না। এ নিয়েও অন্তর্বর্তী সরকারকে ভাবতে হবে যাতে সরকার প্রধানের একনায়কতন্ত্র বাস্তবায়ন করার সুযোগ না পায়। অতি ক্ষমতালোভী হয়ে হীনমন্যতা নোংরা মানসিকতা চরিত্রার্থ করতে না পারে।

 

একটি রাজনৈতিক দল বাদে মনে হয় সকল রাজনৈতিক দল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যতেষ্ট সময় দেয়ার পক্ষে। জনগণের মধ্যে দেশে রাজনৈতিক দলের সাথে সক্রিয় বা সম্পৃক্ত হয়ত শতকরা ২০/৩০ জন হতে পারে। দেশ প্রেমিক শতকরা ৭০/৮০ জন মানুষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমর্থক। পাশাপাশি সংস্কারের লক্ষে সময় দেয়ার পক্ষে। যাতে দেশকে সুন্দরভাবে গুছিয়ে আনা যায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এমন পরিবেশ এনে বিদায় নিতে হবে যাতে তাদের তত্বাবধানে সুন্দর নির্বাচনের পর নির্বাচিত সরকার দুর্নীতি করতে না পারে, একনায়কতন্ত্র যাতে কায়েম না হয়, প্রাদেশিক সরকারসমূহ যাতে যথাযথ স্বায়ত্তশাসন লাভে স্বাধীনভাবে কাজ করে যেতে পারে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ বিশাল ভারত। তাদের পুলিশ বাহিনী প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে। সামরিক বাহিনী বাদেও আভ্যন্তরীণ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীসহ একাধিক বাহিনী রয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এক পার্টি হয়ে প্রাদেশিক সরকার অন্য পার্টি হলে ঐ সমস্ত বাহিনী প্রতিপক্ষ পার্টির উপর শতভাগ না হলেও নানান প্রভাব বিস্তার করতেছে বলে জানা যায়। যদিওবা তারা আইনের শাসনের লক্ষ্যে বলতেছে।

 

আমাদের দেশে প্রাদেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করলে, ঢাকার কেন্দ্রীয় সরকার এক পার্টির হয়ে প্রাদেশিক সরকার অন্য পার্টি হলে পরে তখন কেন্দ্রীয় বাহিনী নামধারণ করে প্রাদেশিক সরকারকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিবে কিনা বলা মুশকিল। এ বিষয়গুলোও অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারকে ভাবতে হবে। বিভাগকে প্রদেশে রূপান্তরিত করতে হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে প্রাদেশিক সরকারের আইনগত স্বাধীনতার উপর কেন্দ্রীয় সরকার যাতে হস্তক্ষেপ করতে না পারে; সে লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কাজ করতে হবে, সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। যেহেতু নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও যে দল ক্ষমতায় বসবে সেই দল বিভাগকে প্রদেশে রূপান্তর করলেও হয়ত বা তা নামে মাত্র হবে। বাস্তবতায় কেন্দ্রীয় সরকার দেশকে হাতের মুঠোয় রাখতে চাইবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সুপারিশ থাকবে দীর্ঘদিনের আলোচিত প্রত্যাশিত দেশের বিভাগগুলোকে যেন প্রদেশের মর্যাদা দান করা হয়। সাথে সাথে এমনও কঠোর আইন রাখতে হবে ঢাকার কেন্দ্রীয় সরকার যেন প্রস্তাবিত প্রদেশসমূহ স্বাধীনভাবে কাজ করতে যাতে বাধা হয়ে না দাড়ায়। প্রভাব বিস্তার করতে না পারে।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক,গবেষক, কলামিস্ট।

 

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট