চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বিচারব্যবস্থার সংস্কার অপরিহার্য

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ | ৩:০৪ অপরাহ্ণ

অতিসম্প্রতি নবনিযুক্ত মাননীয় প্রধান বিচারপতি সর্বস্তরের বিচারকদের উদ্দেশ্যে অসাধারণ বক্তব্য প্রদান করেছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির যোগ্যতা-দক্ষতা-অভিজ্ঞতা আদালতচত্বরে খ্যাতির শীর্ষে। প্রথমবারের মত অনুষ্ঠিত অভিভাষণে আদালতের কার্যক্রম সুসম্পন্ন করার লক্ষ্যে তিনি কিছু যৌক্তিক পরামর্শ উপস্থাপন করেছেন। আধুনিক যুগোপযোগী আদালত পরিক্রমায় সুবিচার নিশ্চিতকল্পে সুপারিশগুলো অতি তাৎপর্যপূর্ণ। পতিত কর্তৃত্ববাদী সরকারের মতো বা কোনো মহলের আদেশ-প্ররোচণায় রায় প্রদান বাঁধামুক্ত করার জন্য তাঁর বক্তব্য সুধীমহলের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। জাতির দীর্ঘ আকাক্সক্ষা পূরণে স্বাধীন বিচারবিভাগ প্রতিষ্ঠায় প্রধান বিচারপতির ইতিবাচক ভূমিকা প্রত্যাশিত।

 

 

বিচারবিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রথমধাপ হিসেবে পৃথক সচিবালয় করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। তাছাড়া সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রেও তিনি সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছেন। বিচারবিভাগে দুর্নীতির মূলোৎপাটনে তিনি জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। তিনি জানান জেলা জজ ও বিচারকদের দুর্নীতি দমনে ব্যর্থতা তাদের পেশাগত অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে। বিচারকাজে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে বিচারের গতি ও মানকে তরান্বিত করতে দ্রুতই -জুডিশিয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার উপর জোর দেন। উল্লেখ্য, অভিভাষণে তিনি মামলাজটকে বিচার বিভাগের বড় সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেন। মামলার তুলনায় বিচারকের সংখ্যার অপ্রতুলতাকে এর অন্যতম কারণ বলে মনে করেন প্রধান বিচারপতি।

 

২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সমগ্র দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশ্যে দেয়া অভিভাষণে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই যে বিদ্যামান সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধান সমস্যা হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ কার্যকররূপে পৃথক না হওয়া। এর কুফল আমরা সবাই ভোগ করেছিলাম গত দেড় দশক ধরে। এ ছাড়া আছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব। মামলা অনুপাতে বিচারকের নিদারুণ স্বল্পতা, বার ও বেঞ্চের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাবের ঘাটতি, আদালতগুলোর অবকাঠামোগত সংকট, অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো যৌক্তিক-গ্রহণযোগ্য নীতিমালা না থাকা, উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগ-স্থায়ীকরণ-উন্নীতকরণের ক্ষেত্রে কোনো আইন না থাকা এবং প্রথাগত জেষ্ঠতার নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন ইত্যাদি বিষয়গুলো যা আমাদের বারবার পিছিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে বিচারকদের পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো ঘোষিত নীতিমালা নেই। ফলে পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনেক সময়ই বিচারকেরা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। এ বিষয়ে যথোপযুক্ত নীতিমালা দ্রুত প্রণয়ন করব।’

 

 

তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, শুধু বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করলেই হবে না। সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামোয় সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগও প্রণিধানযোগ্য। বিচার বিভাগ যেন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে সেজন্য তিনি জরুরি ভিত্তিতে বিচার বিভাগের কিছু সংস্কার কার্যকারীতায় সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন। তাঁর মতে, এই সংস্কারের উদ্দেশ্য হবে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে তা দূর করে একটি স্বাধীন, শক্তিশালী, আধুনিক, দক্ষ ও প্রগতিশীল বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা। বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার স্বার্থে মাজদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণঙ্গ বাস্তবায়ন একান্ত আবশ্যক। দেশের সংবিধানের ১১৬ক অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের বিচারকেরা বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন বলে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বিচারকদের প্রকৃত স্বাধীনতা তত দিন পর্যন্ত নিশ্চিত হবে না, যত দিন না বিচার বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান দ্বৈত শাসনব্যবস্থা অর্থাৎ সুপ্রিম কোট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এখতিয়ার সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অধীন পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে।

 

সংবাদ মাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রমতে, এখনও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে মনে হয় না। নানা অজুহাতে লোকজন জমায়েত হয়ে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরী করছে। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেকেই আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলতি মাসের ১৭ তারিখ সেনাবাহিনীর হাতে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাও প্রদান করা হয়েছে। তথাপিও আইন বহির্ভূত নৃশংস-বর্বরতম সাম্প্রতিক হত্যাকান্ডগুলো প্রচন্ড পীড়াদায়ক। মানুষ হত্যা ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করা নিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘কোন প্রাণ হত্যা বা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করা ব্যতীত কেউ কোন ব্যক্তিকে হত্যা করল সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকে হত্যা করলো। আর কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করলো। (সূরা মায়েদা, আয়াত ৩২), তোমরা সন্ত্রাস ও দুর্যোগ সৃষ্টি করো না। (সূরা আরাফ, আয়াত ৭৭), নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না সন্ত্রাস ও দুর্যোগ সৃষ্টিকারীদের। (সূরা কাসাস, আয়াত ৮৫)’

 

বাংলাদেশ সংবিধানের ৩১, ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনের আশ্রয় লাভ, আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ, বিচার লাভ, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ লাভ অপরাধী-নিরাপরাধ নির্বিশেষে প্রত্যেক ব্যক্তির মৌলিক অধিকার। ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত ২৫ জনের বেশি মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর পুর্বে ৭ মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) ৩৩ জন নিহত হন গণপিটুনিতে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২২ ও ২০২৩ সালে গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩৬ ও ৫১ জন। বিজ্ঞজনদের মতে, আইনশৃঙ্খলার ভঙ্গুর পরিস্থিতি, আইনের শাসনের অভাব ও বিচার ব্যবস্থায় নানা দুর্বলতার কারণে ঘটছে একের পর এক মব জাস্টিস। শুধু তাই নয়, মানবিক মূল্যবোধের ঘাটতি এবং মনোজগতে এক ধরনের সহিংসতার প্রতিফলনেও ঘটছে এসব ঘটনা।

 

ইতিমধ্যেই শান্তিতে নোবেলজয়ী খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে রাষ্ট সংস্কারে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। দেশের মানুষের অধিকার আদায়ে এই সরকারের গৃহীত উদ্যোগ সমধিক প্রসংশনীয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যা-গণহত্যায় শহীদদের পরিবার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে অসংখ্য মামলা রুজু হয়েছে। ট্রাইবুনালে মামলাসমূহ পরিচালনার জন্য প্রসিকিউটর নিয়োগও দৃশ্যমান। আশা করা যায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে ট্রাইবুনাল গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে বিচার কার্যক্রম সুচারুরূপে পরিচালিত হবে। দেশবাসী মনে করেন যেকোন সরকারের আমলে যারাই নানামুখী অপরাধে জড়িত তাদের বিচার অনস্বীকার্য। যথার্থ যাচাই-বাছাই-তদন্ত সাপেক্ষে সত্য উদঘাটন অনিবার্য। হয়রানি বা ফাঁসিয়ে দেওয়ার অমানবিক কোন কারণে নয়; অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তির বিধান আইনের শাসনকে শক্তিশালী করবে। প্রতিহিংসা-প্রতিশোধপরায়নতায় বশীভূত হয়ে ব্যক্তিগত আক্রোশে কোনো অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়। অভিযোগ সমূহ যথাযথ নিরপেক্ষ আইনি প্রক্রিয়ায় প্রমাণে ব্যর্থ হলে অভিযোগকারীদেরও কঠোর আইনের আওতায় আনা জরুরি।

 

লক্ষণীয় যে, বিগত সরকারের সময়ে নামে-বেনামে বহুপ্রকার গায়েবী মামলা আদালতে উত্থাপিত হয়েছে। বিপুল সংখ্যক এসব মামলা তদন্ত ও বিচারকার্য পরিচালনায় আদালতকে এখনও হিমশিম খেতে হচ্ছে। আদালতের জনবল কাঠামো, পর্যাপ্ত তদন্তে বিলম্বের কারণে অসংখ্য নির্দোষ ব্যক্তি দীর্ঘ সময় কারা অভ্যন্তরে রয়েছে। যারপরনাই যন্ত্রণাদগ্ধ সহজ সরল মানুষগুলো সম্পূর্ণ বিনাদোষে ক্ষেত্র বিশেষে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছে। পক্ষান্তরে অর্থ ও ক্ষমতাবান কথিত প্রভাবশালীদের কদর্য আধিপত্যে দাগী অপরাধীরা কারামুক্ত হয়ে আবারও একই ধরনের অপরাধে যুক্ত হয়েছে। হত্যা-চুরি-রাহাজানি-দখল-অত্যাচার-অনাচারের এসব অরাজক দৃষ্টান্ত আইনের প্রতি মানুষকে বীতশ্রদ্ধ করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। ন্যায় বিচারের স্বার্থে আদালতকে অবশ্যই ঘুষ-দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকতেই হবে।

 

সুখের বিষয় হচ্ছে, বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারে জেলা ও মন্ত্রণালয় পর্যায়ে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অফিস আদেশে জেলা পর্যায়ের কমিটির কার্যপরিধি ও কর্মপদ্ধতি বর্ণনায় বলা হয়, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের জন্য ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদনপত্র দাখিল করতে হবে। আবেদনের সঙ্গে এজাহার ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে চার্জশিটের সার্টিফাইড কপি দাখিল করতে হবে। আবেদনপ্রাপ্তির ৭ কর্মদিবসের মধ্যে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দরখাস্তটি জেলার পাবলিক প্রসিকিউটরের (ক্ষেত্রবিশেষে মেট্রোপলিটন পাবলিক প্রসিকিউটর) কাছে মতামতের জন্য পাঠাবেন। আবেদনপ্রাপ্তির ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে পাবলিক প্রসিকিউটর তার মতামত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর পাঠাবেন। পাবলিক প্রসিকিউটরের মতামত সংগ্রহের পর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবেদনটি ৭ কার্যদিবসের মধ্যে জেলা কমিটির সভার উপস্থাপন করবেন। জেলা কমিটির কাছে যদি প্রতীয়মান হয় যে, মামলাটি রাজনৈতিক বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে হয়রানির জন্য করা হয়েছে তাহলে মামলাটি প্রত্যাহারের জন্য কমিটি সরকারের কাছে সুপারিশ করবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ঐ সুপারিশ মামলার এজাহার, চার্জশিটসহ আবেদনপ্রাপ্তির ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে তথ্যাদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করবে।

 

সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আইনের শাসনকে সর্বাধিক বিবেচনায় আনতে হবে। অপরাধীর যথোপযুক্ত শাস্তি একান্তই কাম্য। তবে নির্দোষ ব্যক্তিকে অপরাধী সাজিয়ে মিথ্যা-ভিত্তিহীন মামলায় জড়ানো আইনি ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। সাময়িক প্রতিশোধপরায়নতায় যেকোন ধরনের আবেগি শাস্তির বিধান কালের আবর্তনে কালো অধ্যায়ে নিপতিত হবে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে সমাদৃত করার সকল প্রকার উদ্যোগ যেন অপরাজেয় থাকে; সচেতন মহলের সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকাটাই বাঞ্চনীয়।

লেখক :  শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট