বাংলাদেশের স্বাধীনতার পাঁচ দশকেও আমরা জাতিকে একটি বৈষম্যহীন ও কল্যাণমূলক রাস্ট্রব্যবস্থা উপহার দিতে পারিনি। দিতে পারিনি একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা। তাছাড়া দেশের প্রতিটি সেক্টরে রয়েছে চরম অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, আর অসুস্থ প্রতিযোগিতা। ছাত্র-জনতার সাম্প্রতিক জুলাই-বিপ্লব ছিল সেই সব অনিয়ম আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে। কারণ, তারা বুঝতে পেরেছিল যে, এর মূলোৎপাটন করতে না পারলে দেশের ভবিষ্যত অন্ধকার। এই জুলাই-বিপ্লব অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে এক বিরাট সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে একটি বৈষম্যহীন, সুস্থ, ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রকাঠামো তৈরী করার জন্য। বিশ্লেষকগণ মনে করেন, দেশে একটি সুস্থ রাষ্ট্রব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে দেশের সকল সেক্টরে দরকার পরকল্পিত সংস্কার। বিশেষ করে বেশী গুরুত্ব দেয়া দরকার শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারে। কারণ, দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে দক্ষ মানবসম্পদের কোনো বিকল্প নেই। তাই দেশের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করা দরকার। তাছাড়া, দেশের যেকোন উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন, সঠিক সংগঠন, যথাযথ প্রযুক্তি নির্ধারণ ও তার প্রয়োগের জন্য দরকার দক্ষ, সৎ ও উৎপাদনশীল মানবসম্পদ। আর এজন্য দরকার একটি উত্তম শিক্ষাব্যবস্থা। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় রয়েছে পদে পদে অসঙ্গতি। তাই আমরা মনে করি বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল সংস্কার করার এটাই হল মোক্ষম সময়।
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক চিত্র : বাংলাদেশ সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে ‘সকল শিশুর জন্য বিনামূল্যে এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা’-র বিধান রয়েছে, যা জাতিসংঘের ‘সকলের জন্য শিক্ষা’ মূলমন্ত্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। বর্তমানে বাংলাদেশ জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য-৪ ‘গুণগত শিক্ষা’র উপরও গুরুত্ব আরোপ করে। সেই লক্ষে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয়ে আসছে দেশের শিক্ষামন্ত্রণালয় দ্বারা। অন্যদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় স্থানীয় পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত সকল বিদ্যালয়ের জন্য নীতিমালা বাস্তবায়ন করে আসছে।
একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা প্রধানত তিনটি স্তরে বিভক্ত- প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা। একেকটি স্তরের শিক্ষা তার পরবর্তীস্তরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। এ তত্ত্বটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এবং শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে তা মেনে চলা হয়। কিন্তু, গবেষক ও শিক্ষাবিদগণ মনে করেন আমাদের দেশের এই তিনটি স্তরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। যা হোক, এই তিনটি স্তরের মধ্যে রয়েছে সাধারণ শিক্ষাসহ কারিগরি, প্রকৌশলী, ডাক্তারি, ও ভোকেশনাল ইত্যাদি কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা। আরও রয়েছে মাদ্রাসাশিক্ষা এবং ব্রিটিশ কারিকুলামের ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থা। মাদ্রাসাশিক্ষায় আবার রয়েছে বিভিন্ন ভাগ যেমন- কওমি, আলীয়া ও হাফেজী। তাদের রয়েছে নিজস্ব কারিকুলাম। অন্যদিকে, ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা সারা বিশ্বে বেশ সমাদৃত এবং সারা পৃথিবীতেই ব্রিটিশরা তাদের কারিকুলাম পরিচালনা করে আসছে। কারণ তাদের রয়েছে পৃথিবীর বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় প্রণিত উন্নত কারিকুলাম এবং তা বাংলাদেশে যারা তা বাস্তবায়ন করছে তাদেরও রয়েছে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত শিক্ষক এবং অবকাঠামো। ফলে বাংলাদেশে এটি ভালোভাবেই চলছে।
তবে, লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হলো যে, আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় কর্মমুখী শিক্ষার তেমন প্রসার ঘটেনি, যেটা ঘটেছে বিশ্বের অন্যান্য দেশে। ফলে প্রচলিত পন্থায় কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাধারণ শিক্ষায় ডিগ্রি নিয়ে লাখ লাখ যুবক বেকারত্বের অভিশাপে ধুকছে। এটি অত্যন্ত হতাশাজনক যে, বাংলাদেশে বেকারত্বের হারে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে দ্রুত। ২০২২ সালের সালের বিবিএস এর হিসাব মতে বাংলাদেশে শিক্ষার হার প্রায় ৭৪.৬৬%, এবং বেকারত্বের হার প্রায় ৪.৩০%, যেখানে উচ্চ শিক্ষিত বেকারের হার প্রায় ১২%, এবং যা সংখ্যার দিকে প্রায় ৮ লাখ। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে শিক্ষার হার বাড়ানোর মাধ্যমে একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠি তৈরীর জন্য, শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন আনার চেষ্ঠা করা হয়েছে। অনেক নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, এমনকি অনেক কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা হয়েছে। যদিও নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির নাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কিন্তু সেখানেও রয়েছে সাধারণ শিক্ষার প্রাধান্য। অথচ আমাদের আশেপাশের দেশগুলো কর্মমূখী শিক্ষার উপর বেশী গুরুত্ব দিয়েছে, যেমন, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, এমনকি শ্রীলংকা। ফলে তারা উন্নতির চরম শিখরে উঠে যাচ্ছে দ্রুত, যা আমাদের দেশে হচ্ছে না। উন্নত দেশগুলোর শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই কারিগরি, বৃত্তিমূলক ও পেশাভিত্তিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং যেকারনে তারা কেউই বেকার থাকেনা। কারিগরি, বৃত্তিমূলক ও পেশাভিত্তিক শিক্ষার আর একটি বৈশিষ্ঠ হল এই শিক্ষায় শিক্ষিত যে কেউ চাইলেই ভাল একজন উদ্যোক্তা হতে পারে। যার মাধ্যমে তারা অন্যদের জন্যও কাজের সুযোগ তৈরী করতে পারে।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার প্রচেষ্টা : ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ২৫ বছর আমরা এক ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। কিন্তু স্বাধীনতার পাঁচদশকেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় তেমন বড় রকমের কোনো পরিবর্তন সাধিত হয়নি। বিভিন্ন সময়ে যে সকল পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়েছে সেটাও যথার্থ নয়। কারণ এর মাধ্যমে তেমন কোন গুণগত পরিবর্তন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আসেনি। স্বাধীনতার পরে সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালে ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য জাতীয় শিক্ষাকমিশন গঠন করা হয়। সেই কমিশন ব্যাপক অনুসন্ধান ও চিন্তা-ভাবনার ভিত্তিতে একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানমুখী শিক্ষানীতি তৈরি করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি।
পরে ১৯৭৬ সালে ড কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশের আলোকে জাতীয় পাঠ্যক্রম উন্নয়নের জন্য ‘কমিশন ফর ডেভেলপিং ন্যাশনাল কারিকুলা অ্যান্ড সিলেবি’ কমিটি করা হয়। আবার ১৯৭৮ সালে সরকার কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট পর্যালোচনা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে আবারও জাতীয় শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেন। ১৯৮৩ সালে আবারও গঠন করা হয় মজিদ খান শিক্ষাকমিশন। কিন্তু এর প্রতিবেদনও ব্যাপকভাবে প্রচার হয়নি এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য গৃহীত হয়নি। ১৯৮৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য মফিজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে আবারও একটি জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়, যারা দেশে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার, পুনর্গঠন এবং উন্নয়নের উপায় প্রস্তাব করেন। এই কমিশন বিশেষভাবে দেশে উচ্চশিক্ষার উন্নয়নে তিন বছরের ডিগ্রী কোর্স এবং দুই বছরের মাস্টার্স কোর্স চালু এবং ডিগ্রী কলেজে অবকাঠামো ও পাঠদান সুবিধার উন্নয়নের পরামর্শ দেন। দশ বছর পর, ১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এম শামসুল হকের নেতৃত্বে ৫৬ সদস্যের আর একটি কমিশন গঠন করা হয়, যা শিক্ষা ক্ষেত্রে তিনটি স্তরের পরামর্শ দেন- প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা, এবং প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ ৫ বছরের পরিবর্তে ৮ বছর করার পরামর্শ দেন। যা হোক, ২০০১ সালে শিক্ষাখাতে অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার চিহ্নিত করার জন্য ড. এম. আব্দুল বারীর নেতৃত্বে আবারও একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। পরে, ২০০৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিয়ার নেতৃত্বে গঠন করা হয় ‘বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন’। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন ও সেই লক্ষ্যে সংস্কার শুরু করার জন্য কমিশন তাদের রিপোর্টে সাধারণ শিক্ষা, পেশাগত, বিশেষায়িত, এবং সকল শিক্ষা উপ-খাতে ধর্ম, বর্ণ ও গোষ্ঠী, লিঙ্গ, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং ভৌগোলিক বৈচিত্র নির্বিশেষে সকলের জন্য শিক্ষার সমান প্রবেশাধিকার; অনুন্নত এলাকায় সরকারি অর্থায়নে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষার ব্যাপক প্রসার; সব প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ; একটি একক মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা; শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত সংকুচিত করা; শিক্ষকের যোগ্যতার মানোন্নয়ন; পাঠ্যক্রম ও পাঠদান পদ্ধতির সংস্কার এবং মাধ্যমিক স্তরে মূল্যায়ন ও পরীক্ষা পদ্ধতির উন্নতির পরামর্শসহ ৮৮০টি সুপারিশ প্রস্তাব করেন।
সর্বশেষ ২০০৯ সালে জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি ১৬ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয় একটি নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ণন করার জন্য। অবশেষে ২০১০ সালের নতুন একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়। এই নীতিমালায় বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ আটবছর রেখে অষ্টম শ্রেণির শেষে প্রাথমিকস্তরের চূড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠান এবং এর ফলাফলের ভিত্তিতে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বৃত্তি প্রদান করার প্রস্তাব করা হয়। নতুন নীতিতে আরও সুপারিশ করা হয় যে, মাধ্যমিক স্তরের অধ্যয়ন চারটি শিক্ষাবর্ষের মধ্যে প্রসারিত হবে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। মাধ্যমিক স্তরের চূড়ান্ত পরীক্ষা দ্বাদশ শ্রেণির শেষে অনুষ্ঠিত হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যক্রমের বিভিন্ন ধারায় বাংলা, নৈতিক শিক্ষা, বাংলাদেশ অধ্যয়ন, গণিত, প্রাকৃতিক পরিবেশ, সামাজিক অধ্যয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞানসহ কিছু মৌলিক বিষয় বাধ্যতামূলক করা হবে। নীতিমালায় মাধ্যমিক স্তরের সব প্রতিষ্ঠানে কিছু কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা চালু করার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু ২০১২ সালে আবারও এই শিক্ষানীতিতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, উপরে উল্লেখিত পরিবর্তন গুলোর কোনটাই পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করা হয়নি, কোনটা আবার আলোর মুখই দেখে নাই। যাহোক, সরকার আবারও শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে ২০২১ সালে। এই পর্যায়েও বেশ কিছু পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু এ পরিবর্তনও সুধী সমাজ, শিক্ষক ও গবেষক, এমনকি অভিভাবক মহলে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়।
এখন প্রশ্ন হল, এত কমিশন, এত প্রস্তাবনা, এত সুপারিশ, তার পরেও কেনো বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার তেমন কোন গুণগত পরিবর্তন নাই। বিশ্লেষক, গবেষক, শিক্ষাবিদ্গণ বলছেন, এর মূল কারন হল, অপরিকল্পিত শিক্ষানীতি, পুরানো ধ্যানধারণার পাঠ্যক্রম নির্ভরতা, কর্মমূখী শিক্ষার উপর কম জোর দেওয়া, রাজনৈতিক স্বদিচ্ছার অভাব, এবং শিক্ষা খাতে ব্যাপক দুর্নীতি ইত্যাদি। তাছাড়া বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে বাজেটের বরাদ্দ অপর্যাপ্ত। গত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ছিল মোট বরাদ্দের ১২%, যা ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ছিল ১১.৯%। এউচ অনুপাতের তুলনায় এটি ১.৮৩%, যা বিগত ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বরাদ্দের চেয়েও কম। শিক্ষাক্ষেত্রে এই বরাদ্দ পৃথিবীতে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। ফলে শিক্ষাব্যবস্থায় তেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়নি। সবার একই মত, শিক্ষাখাতে বরাদ্দ অনেক বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা : প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে পরবর্তী সব স্তরের শিক্ষার মূল ভিত্তি। একটি দেশের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাকার্যক্রমের অন্যতম উদ্দশ্যে হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে নাগরিক দায়িত্ব পালন করা, এবং অন্যের মৌলিক অধিকার হরণ না করার মত দ্বায়ীত্ববোধ ও মূল্যবোধ জাগ্রত করা। কিন্তু বিশ্লেষকগণ মনে করেন, বাংলাদেশের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাকার্যক্রম এ দেশে তেমন দায়িত্ববোধ ও মূল্যবোধসম্পন্ন নাগরিক তৈরি করতে সক্ষম হয়নি। এর মূল কারণ হল, ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা। তাই এখন দরকার গুনগতমান ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী করে পাঠ্যসূচি, ও পাঠক্রমের মানোন্নয়ন। এর মধ্যে থাকতে হবে মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নের বিবেচনাও। তবে, মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে মাদ্রাসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ঠ আলেমে দ্বীন ও শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে কমিশন গঠন করতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিটি মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এর প্রয়োগ থাকতে হবে প্রচলিত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সকল শিক্ষাব্যবস্থায়। যাতে করে মূল্যবোধ সম্পন্ন একটি জাতি আমরা তৈরী করতে পারি। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার ও উন্নয়ন এমনভাবে করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরীক্ষামুখী মনোভাবের স্থলে জ্ঞানমুখী মনোভাব সৃষ্টি হয়। অন্যথায় একটি বৃহৎ অদক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরী হবে। প্রচলিত সৃজনশীল পরীক্ষাপদ্ধতির ত্রুটির কারণে কোচিং সেন্টার ও গাইডবুকের ব্যবসার ব্যাপক প্রসার হয়েছে। এর জন্য দরকার চিন্তাশীল ব্যক্তিদের দূরদর্শী চিন্তাভাবনা, আলোচনা ও বিচার বিশ্লেষণ। শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত, আগে সে সম্পর্কে আমাদের লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। তারপরে সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে সমাধানযোগ্য সঠিক কর্মপন্থা ঠিক করতে হবে।
বাংলাদেশে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা : বর্তমানে নতুন শিক্ষানীতি অনুযায়ী শুরু হওয়া মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম নিয়ে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক ও শিক্ষাবিদদের রয়েছে ব্যাপক অসন্তোস। তা নিয়ে সম্প্রতি অনেক শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবক আন্দোলনে নেমেছিলেন। প্রথমত, এ কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য যে ধরনের অবকাঠামো, শিক্ষা উপকরণ প্রয়োজন তা আমাদের নাই। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের যে ধরনের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন আর সে ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য যে রিসোর্স দরকার তাও আমাদের অভাব। ফলে পূর্ণাঙ্গভাবে নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করা আমাদের জন্য অনেক কঠিন। ওই ধরণের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত বিশ্বের জন্য প্রযোজ্য, যেখানে জনসংখ্যা কম। উন্নয়নশীল জনবহুল দেশ হিসেবে আমরা কোনোভাবেই প্রস্তুত নই এ ধরনের কারিকুলাম বাস্তবায়ন করার জন্য। তাই সবাই বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তন চান। এজন্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে বাস্তবমুখী সিলেবাস প্রণয়নের মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার আমূল পরিবর্তন আনা এখন সময়ের দাবি। (চলবে)
প্রফেসর ড. আমির মুহাম্মদ নসরুল্লাহ প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ, লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
পূর্বকোণ/পিআর