প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। ফলশ্রুতিতে অহংকার-দাম্ভিকতা-স্বেচ্ছাচারিতার কদর্য আচরণে জনদুর্ভোগ বৃদ্ধি পায়। ব্যক্তি-স্বজন-পরিবারপ্রীতির আড়ালে দুর্নীতি-অপকর্ম-দেশবিধ্বংসী কার্যে জড়িত হতে কথিত মহল কুণ্ঠাবোধ করে না। ভয়ংকর পরিণতির দিকে এগিয়ে নিতে নানামুখী অপরাধকর্মে অতিশয় তৎপরতা লক্ষণীয়। কোন ধরনের বাচবিচার না করে অহংবোধকে প্রাধান্য দিয়ে তারা জনগণকে নিগৃহীত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকে। নির্বিচারে হত্যা-গণহত্যা-জেলজুলুম-গুম-খুন ইত্যাদি বেপরোয়া পর্যায়ে নিপতিত হয়। আপরাধীকে শাস্তির বিপরীতে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গর্হিত কর্মকে আড়াল করার পন্থা অবলম্বনে নির্লজ্জভাবে তাদেরকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। কোন ধরনের রাখঢাক না রেখে প্রকাশ্যেই ঋণ খেলাপি-অর্থপাচারকারী-আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি সহযোগিতার অদৃশ্য হাত বিস্তৃত থাকে। কথিত রাজনীতির মোড়কে দল-উপদলীয় সংগঠনের মাধ্যমে চাঁদাবাজী-দখলদারি-লুটতরাজসহ বিভিন্ন কুৎসিত কর্ম পরিচালনায় তারা সিদ্ধহস্তÍ। সাধারণ জনগণকে নিঃস্ব করে দিয়ে নিজেদের সম্পদ বাড়ানোর প্রলোভন চরম আকার ধারণে সমাজকে করে পর্যুদস্ত। ক্ষমতাবান প্রভাবশালীরা এসব অপাংক্তেয়-অবাঞ্চিত কর্মকে গুরুত্ব দিয়ে নিজের আধিপত্য বিস্তারে ব্যতিব্যস্ত থাকে। গণবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে জনজীবনকে তারা দুর্বিষহ করে তুলে। অপরাজনীতির আড়ালে ভয়াবহ সব অপরাধ ঘটিয়ে তারা প্রভাব বলয় বিস্তারে বিরোধী শক্তিকে দমন-পীড়ন-নির্যাতনের নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত নির্মাণ করে। কখনো এটুকু উপলব্ধি করতে পারে না যে ইতিহাসের কালো অধ্যায়ে তারা নিজেদেরকে সংযুক্ত করছে। কালক্রমে তারা ফ্যাসিবাদি ও কর্তৃত্ববাদীর অসহনীয় রূপ পরিগ্রহ করে।
এটি সর্বজনবিদিত যে, ‘ফ্যাসিজম’ হচ্ছে একটি ঘৃণ্য রাজনৈতিক মতাদর্শ। ১৯১৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এর সদর্প উপস্থিতি পরিলক্ষিত। ‘ফ্যাসিজম’ বা ‘ফ্যাসিবাদ’ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ইউরোপে উগ্র-ডানপন্থী জাতীয়তাবাদের আবির্ভাব ঘটে। এই মতাদর্শে বিরোধীপক্ষের কোন স্থান ছিল না। কর্তৃত্বময় শাসন ক্ষমতাই ছিল ‘ফ্যাসিবাদ’ এর মূলমন্ত্র। ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রকেই সবসময় সর্বাধিক গুরুত্ব দিত। তাতে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র ছিল উপেক্ষিত। এর মাধ্যমে তারা ব্যক্তি স্বাধীনতাকে হরণ করতো এবং ক্ষমতাকে একটি কেন্দ্রে আবদ্ধ রাখতো। তাদের চাওয়া ছিল রাষ্ট্র ক্ষমতায় একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ। রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি চার্চ-আদালত-বিশ্ববিদ্যালয়-সামাজিক ক্লাব-খেলাধুলাসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-সংস্থায় কর্তৃত্ব স্থাপন। ফ্যাসিস্ট দলগুলো ছিল সবসময় এক ব্যক্তির সর্বময় কর্তৃত্ব ও শাসনে বিশ্বাসী। তারা মনে করতো যে রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং রাষ্ট্রের প্রধান একই ব্যক্তি থাকবেন, যার হাতে সকল ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব থাকবে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালিতে ফ্যাসিবাদ ধারণাটির উৎপত্তি। কালক্রমে এটি জার্মানি এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। জার্মানিতে হিটলারের নেতৃত্বে ‘নাৎসিজম’ বা ‘নাৎসিবাদ’ এর উত্থান ছিল ফ্যাসিবাদের একটি রূপ। ফ্যাসিবাদের মধ্য দিয়ে ইউরোপে হিটলার ও মুসোলিনির মতো বিতর্কিত নেতার উদ্ভব হয়। তারা যেটাতে বিশ্বাসী ছিল সবাইকে সেটাই মানতে বাধ্য করেছিল। তারা তাদের সমালোচনার জবাব দিতো শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে। দেশে যেকোন ধরনের সমস্যার জন্য তারা অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দিত। অনেক ইতিহাসবিদদের ধারণা ফ্যাসিজম এর কোন সর্বজনীন সংজ্ঞা নেই। তাঁদের মতে, ফ্যাসিস্টরা মার্ক্সবাদীদের বিরোধী ছিল। শুধু বিরোধীতা নয়, মার্ক্সবাদীদের রীতিমতো ঘৃণা করতো ফ্যাসিস্টরা। আবার অনেক পর্যবেক্ষকদের মতে, ফ্যাসিস্ট এবং সোভিয়েট কমিউনিজমের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য ছিল। ফ্যাসিস্টরা ছিল সংসদীয় গণতন্ত্রের বিরোধী। যদিও ক্ষমতায় আসার আগে হিটলার ও মুসোলিনি দুজনেই নির্বাচনের রাজনীতিতে জড়িত হবার আগ্রহী ছিলেন। মার্কিন রাষ্ট্র বিজ্ঞানী লরেন্স ব্রিট ফ্যাসিবাদের ১৪টি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন। তন্মধ্যে জাতীয়তাবাদের ক্রমাগত প্রচার, মানবাধিকার হরণ, সেনাবাহিনীকে সুবিধা দেয়া, গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ, কর্পোরেট স্বার্থ ও প্রতারণার নির্বাচন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ফ্যাসিস্ট দলগুলোর আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল জনসমাবেশ করে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করা।
আমাদের সকলের জানা, বেশকিছু কাল ধরে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিবেশ পর্যালোচনায় আত্ম সমালোচনা-আত্মবিশ্বাস-আত্মশুদ্ধির অপরিসীম অবজ্ঞা পরিলক্ষিত হয়েছে। পারষ্পরিক সমঝোতা-সৌহার্দ-সম্প্রীতির বিপরীতে জঘন্য সহিংসতা-চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র-অসহিষ্ণু আচরণে রাজনীতির প্রতি পুরো জাতির চরম অনাগ্রহ তৈরি হয়। এটিও সত্য যে, মানুষের মর্যাদা সুদৃঢ় করার জন্য প্রয়োজনীয় নাগরিক স্বাধীনতা অপরিহার্য। জাতিরাষ্ট্রের সকল জনগণের সামগ্রিক সুযোগ-সুবিধা অবারিত ভোগ করার মধ্যেই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ। আধুনিক সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় মুক্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনগণের অধিকার প্রয়োগ অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গতিশীল করে। সমাজের স্বয়ম্ভরতা অর্জনে মুক্তচিন্তার অবাধ প্রকাশ এবং সাংস্কৃতিক বিবেকের জাগরণ একান্ত প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচ্য। ধারাবাহিকতায় একুশ শতক ছিল সবচেয়ে সৃষ্টিশীল শতক যা বিশ্বের প্রায় সকল মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে স্পন্দিত এবং তা অর্জনে প্রচন্ড শক্তি যুগিয়েছিল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক মনীষী এরিস্টটল বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বস্তুবাদী দর্শনের ঐতিহ্যিক মাত্রায় শুধু জীবনের প্রয়োজনে নয়, বরং উত্তম জীবন সচল করার প্রয়োজনেই রাষ্ট্রের উৎপত্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ব্যক্তিকে সর্বোৎকৃষ্ঠ জীবনের দিকে পরিচালিত করার লক্ষ্যে মানুষ সকল সামাজিক সম্পর্ক এবং শক্তির বন্ধনে জাগতিক ও সামষ্টিক মূল্যায়নে রাষ্ট্র গঠন নিশ্চিত করেছে। এজন্যই রাষ্ট্র মানুষের পরিপূর্ণ জীবনপ্রবাহের গতিময়তায় একটি অনিবার্য প্রতিষ্ঠানরূপেই প্রতিভাত। মানবসত্ত্বার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ বা পরিবার-সমাজের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা, নিরাপত্তা-মঙ্গল প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার সার্থকতা সর্বজনস্বীকৃত।
খ্যাতিমান সমাজবিজ্ঞানী লুসিয়ান-পাই রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যাখায় বলেছেন, কোন জাতিরাষ্ট্রে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি-বিশ্বাস-আদর্শিক মনোভাবের সমষ্টিগত প্রক্রিয়ায় শৃঙ্খলাবদ্ধ আচরণের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা-বিধিবিধান ও নীতিনৈতিকতার সমাহার রাজনীতির মৌলিক ভিত্তি তৈরি করে। মূলতঃ রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূল উপাদান হচ্ছে কোন দেশে বিরাজিত রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রতি নাগরিকদের সনাতন মূল্যবোধ-অনুভূতি এবং আস্থার সামগ্রিক প্রতিচ্ছবি। মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গ্যাব্রিয়েল অ্যালমন্ড সর্বপ্রথম রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রত্যয়টি ব্যবহার করেন। তাঁর মতে, ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি হল রাজনৈতিক ব্যবস্থার সদস্যদের রাজনীতি সম্পর্কে মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির রূপ ও প্রতিকৃতি।’ কোন একটি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার গতি-প্রকৃতির প্রবাহমানতায় সে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি উদ্ভাসিত। রাজনীতি নিয়ে সমাজের চিন্তাচেতনা-ধ্যানধারণা, রাজনৈতিক মূল্যবোধ-বিশ্বাস-মতাদর্শ, জ্ঞানগত কার্যকলাপ-আগ্রহের পরিমাপ-মূল্যায়নমূলক অভিযোজনে নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাবলীল উত্তরণ। জনগণ সম্যক অবগত আছেন, রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি পারষ্পরিক সম্পূরক-পরিপূরক। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি হচ্ছে সমাজে বসবাসরত ব্যক্তিবর্গের উন্নয়ন ও সমষ্টিগত মূল্যবোধ সৃষ্টিসোপান। ব্যক্তি স্বাধীনতার পাশাপাশি পুরো সমাজ উন্নয়নে পরিমার্জিত পারষ্পরিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-পরমতসহিষ্ণুতা-অপরের বক্তব্যকে অবজ্ঞা না করার প্রবণতা রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে উঁচুমাত্রিকতায় নির্দেশিত করে।
যেকোন জাতিরাষ্ট্রের উন্মেষ ও চলমান প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান-সমাজের সার্বিক চিত্রপট মানবকল্যাণের জটিল মিথস্ক্রিয়ায় নির্মিত হয় রাজনৈতিক রীতি-নীতির পাঠ্যক্রম। একনায়ক-সামরিক-স্বৈর-গণতান্ত্রিক গতিধারায় গ্রহণ-বর্জনের নানাবিধ পন্থায় পরিচালিত হয় স্বকীয় সত্ত্বার রাষ্ট্র ব্যবস্থা। আদর্শের ঘাত-প্রতিঘাতে উম্মোচিত হয় দল-উপদল-দলীয় নেতৃত্ব ও কর্মীর আচার-আচরণ। দল গঠনের প্রণিধানযোগ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে; ধর্ম-বর্ণ-দলমত-অঞ্চল নির্বিশেষে সমগ্র জনগোষ্ঠীর পরিপূর্ণ মঙ্গল চরিতার্থে মাটি ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধের প্রতিফলন। আদর্শিক ভিন্নতায় বিরোধ-বিচ্ছেদ, প্রতিযোগিতা-প্রতিহিংসা-পরশ্রীকাতরতা নিধন করে সংগত-সংযত সমাজস্বীকৃত আচরণবিধির অনুশীলন জনমনজয়ী চরিত্র গঠনে সহায়ক। এতে দেশ ও দেশবাসীকে উপকৃত করার ইস্পাতকঠিন ব্রত গ্রহণের মধ্যেই নেতৃত্বের পরিশীলিত গ্রহণযোগ্য বিকাশ। উল্লেখিত বিষয়সমূহ বা ঐতিহ্য-শিক্ষা-অভিজ্ঞতা-সততা-ন্যায়পরায়নতা-মনন ও সৃজনশীলতার দৃশ্যমান অবগাহনে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃঢ়তা নির্ভর করে।
সমাজ-ইতিহাস বিশ্লেষণে এটি স্পষ্ট যে, বল প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্র শাসন বরাবরই পরাভূত। দমন-পীড়ন-নিপীড়ননির্ভর রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি রাজনীতিকে কলুষিত করে। নিকৃষ্ট কর্মযজ্ঞে জড়িত কতিপয় ব্যক্তি-দল-প্রতিষ্ঠান যুগে যুগে অভিশপ্ত হওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিয়ে উত্থান-পতনের বিভাজন অনুধাবনে তারা ব্যর্থ। সকলেরই মনে রাখা উচিত অর্থ-ক্ষমতা কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়। এসব নিয়ে অযাচিত পদক্ষেপে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার হীন প্রবণতা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
পূর্বকোণ/পিআর