১৮৮৩ সালের কোন এক শুভক্ষণে চট্টগ্রাম জেলার ঐতিহ্যবাহী পটিয়া থানার অন্তর্গত বড়লিয়া গ্রামের ছৈয়্যদ বংশীয় সম্ভ্রান্ত পীর পরিবারে তাশরীফ আনেন আউলাদে রাসূল (দ.) মোজাদ্দেদে মিল্লাত, প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক সাধক, আলেমেদ্বীন হযরত শাহসুফী পীর মাওলানা ছৈয়্যদ আবদুচ্ছালাম আউলিয়া (রহ.)।
তিনি তৎকালীন যুগশ্রেষ্ঠ আলেমেদ্বীন হযরত মাওলানা ছৈয়দ শাহ আবদুর রশীদ (রহ.)-এর দ্বিতীয় সন্তান। বংশ পরম্পরায় হযরত ছৈয়্যদ আবদুচ্ছালাম আউলিয়া (রহ.) ছিলেন সিলেট বিজয়ী বীর হযরত শাহজালাল ইয়ামেনী (রহ.)-এর অনুচরবর্গের অন্যতম সেনাপতি ছৈয়দ নাছির উদ্দীন (রহ.), তথা ইসলামের চতুর্থ খলিফা বেলায়তের সম্রাট হযরত আলী ইবনে আবি তালেব (রা.)-এর অধঃস্থন পঞ্চদশ পুরুষ। এই মহান বীরপুরুষের বংশে হযরত ছৈয়দ আবদ্ধুসঢ়;ছালাম আউলিয়া (রহ.)এর জন্ম। তাঁর কারণেই বড়লিয়া গ্রামটির পরিচয় ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আজ তাঁর ৯২তম ওরশ মোবারক।
হযরত সৈয়্যদ আবদুচ্ছালাম আউলিয়া (রহ.) এর পূর্ববর্তী বংশধরদের মধ্যে বিখ্যাত কয়েকজনের একজন ছিলেন মহাকবি ছৈয়দ শাহ সুলতান (রহ.)। কথিত আছে, বড়লিয়া গ্রামের প্রাচীন নাম ছিল পলাশপুর। এ গ্রামে তখন কোন মুসলমান ছিল না, শুধুমাত্র মগরাই বাস করত। হযরত ছৈয়্যদ সুলতান (রহ.) একটি ঘাটের উপর কাফন পরিহিত অবস্থায় অথৈজলের মৃদু ঢেউয়ের তালে তালে এ লোকালয়ে এসে পৌঁছেন।
গ্রামবাসী তাঁর পরিচয় পেয়ে সম্বোধন করলেন ‘বড় আউলিয়া’। এরপর লোকজন তাঁর নানা অলৌকিক কারামত দর্শন করে বিমুগ্ধ হন। ফলে অসংখ্য বিধর্মী তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। এভাবে মুসলিমদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে পুরো এলাকা মুসলিমদের গ্রামে পরিণত হয়। একদিন তারাই এ মহান সাধকের স্মারকচিহ্ন স্বরূপ ‘বড় আউলিয়া’ তথা পলাশপুর গ্রামের নাম রাখেন ‘বড়লিয়া’।
হযরত ছৈয়্যদ আবদুচ্ছালাম আউলিয়া (রহ.)-এর বয়স যখন চারবছর চারমাস, তখন থেকে তাঁর লেখাপড়ার জীবন শুরু হয়। তিনি একজন অনন্য মেধার অধিকারী শিশু হিসেবে পারিবারিক মক্তবে আরবী, ফার্সী ও বাংলা বিষয়ের উপর প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন। এরপর তিনি তখনকার খ্যাত দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম নিউস্কিম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে তিনি তাঁর মেধা ও উন্নত চরিত্রের অনুপম প্রদর্শনীতে ছাত্র-শিক্ষক সকলের মাঝে অতি প্রিয় হয়ে উঠেন। এনভাবে তিনি অনুপম চরিত্র ও অনন্য মেধার স্বাক্ষর রেখে সেখান থেকে ফাযিল মানের কৃতিত্ব সনদ লাভ করেন। তারপর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন ওপার বাংলার (কলকাতা) বিখ্যাত আলিয়া মাদ্রাসা-সাহরানপুর আলিয়া মাদ্রাসায়। সেখানে তিনি কোরান, হাদীস, ফিকাহ, উসূল, দর্শনশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়ের উপর অগাধ পাণ্ডিত্য।
অর্জনপূর্বক টাইটেল পাশ করেন। এরপর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শেষে তিনি পুনরায় মাতৃভূমি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। লেখা-পড়ার পাশাপাশি এ সাধক নিরলস ইবাদত ও রিয়াযতে মশগুল থেকে মুস্তাকী ও পরহেজগারিত্ব অর্জন করেন। আধ্যাত্মিক জগতের এ মহান সাধক দুইজন মহান আধ্যাত্মিক গুরুর হাতে তরীকতের দীক্ষা নেন। হুজুরের নাতি মাওলানা ছৈয়্যদ মুহাম্মদ মুহাম্মদ ওমর ফারুক (ম.জি.আ.)-এর বর্ণনা মতে, হুজুরের প্রথম পীর মুর্শিদ হলেন ভারতের প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন পীরে কামেল মাওলানা ছৈয়দ আবদুস সামি (রহ.)।
হজুর যখন লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে ভারতে গিয়েছিলেন, তখন তিনি এ মহান সাধক পীরের ছহোবতে থেকে তরিকতের দীক্ষা নিয়েছিলেন। আর অন্যজন ছিলেন তারই পিতৃব্য তৎকালীন খ্যাতনামা আলেমেদ্বীন ও পীর হযরত মাওলানা ছৈয়দ শাহ আবদুল হাকিম (রহ.)। যিনি বেশ কয়েকটি কিতাবের লেখক ছিলেন। এ মহান সাধক পীর চাচাজানের তত্ত্বাবধানে থেকে হযরত আবদুচ্ছালাম আউলিয়া (রহ.) তরিকত, মারেফাত ও হাকিকতের উপর পারদর্শীতা অর্জন করেন।
হযরত সৈয়্যদ আবদুচ্ছালাম আউলিয়া (রহ.)-এর জীবনকালে অলৌকিকভাবে প্রাপ্ত কিছু জিনিসপত্রের বর্ণনা : হযরত ছৈয়্যদ আবদুচ্ছালাম আউলিয়া (রহ.)-এর সুযোগ্য পূর্বপুরুষ বাংলার বিখ্যঠু মহাকবি হযরত ছৈয়্যদ শাহ সুলতান (রহ.) যখন বার্মায় শেষবারের মত চলে যান তখন তিনি সেখান থেকে তাঁর ব্যবহার্য একখানা খাট, খাটের উপর একটি কোরআন শরীফ, একটি রেয়াল, এক জোড়া খড়ম, একটি চিঠি, এবং একটি কলম দিয়ে বার্মার নাফ নদীতে ভাসিয়ে দেন। আর খাটখানাকে নির্দেশ দিয়ে বলেন- ‘এই খাট! তুমি বাংলাদেশে যেখানে আমার বংশধরগণ অবস্থান করছে সেখানে চলে যাও’। আল্লাহর অলির নির্দেশ পেয়ে সেই জড়পদার্থ খাটখানা নৌকা হয়ে মাঝিবিহীন পরিচালনায় নদীর উজান-ভাটা উপেক্ষা করে বর্তমান ছৈয়্যদ বাড়িতে চলে আসে।
তাঁর বংশধরগণ এই অলৌকিক জিনিসপত্র গ্রহণ করে হেফাজতে রাখেন। পরবর্তীতে তাঁর বংশধরদের হাত ধরে এইগুলো হযরত সৈয়্যদ আবদুচ্ছালাম আউলিয়া (রহ.) প্রাপ্ত হন। এগুলো তিনি ব্যবহারও করেন। কিন্তু তাঁর ইন্তেকালের পর আর কেউ এগুলাে ব্যবহারের সাহস পাননি। তবে জনৈক দাম্ভিক মৌলভী ঘুমানোর দুঃসাহস দেখিয়ে দম্ভ করে বলেন যে তিনিই পারবেন এই খাটে শয়ন করতে। কথা মতো সেই রাতে তিনি ঐ খাটে শয়ন করলেন। পরদিন ভোরে দেখা গেল খাটসমেত ঐ মৌলভী বাড়ির আঙ্গিনায় পড়ে আছে।
এছাড়াও এই খাটের আরেকটি অলৌকিক ঘটনা হচ্ছে হযরত সৈয়্যদ আবদুচ্ছালাম আউলিয়া (রহ.)-এর ওফাত শরীফের পর একদিন বাড়িতে আগুন লাগে। আগুনের ধ্বংসলীলা মুহূর্তেই পুরো বাড়ি গ্রাস করে ফেলে। ক্ষণিক সময়ের ব্যবধানে পুরো ছৈয়্যদবাড়ি পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। আগুন যখন সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শান্ত হল, তখন দেখা গেল অলৌকিকভাবে খাটখানা সামনের পুকুরে ভাসছে। শুধু তা নয়, হযরত সৈয়্যদ আবদুচ্ছালাম আউলিয়া (রহ.)-এর জীবনচরিতের মাঝে আরো অনেক কারামত আছে।
বর্তমানে তার মাজার শরীফকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এতিমখানা, মসজিদ, মাদ্রাসাসহ সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান। আশেক-ভক্তদের সহযোগিতায় এসব প্রতিষ্ঠান সমাজের উন্নয়নে রেখে যাচ্ছে প্রশংসনীয় অবদান। তিনি বিভিন্নভাবে মানবসেবায় অনন্য নজির স্থাপন করে গেছেন। তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে তিনি মানুষকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন এবং মানুষের ভালো তথা কল্যাণ করতেই সদা-সর্বদা মগ্ন থাকতেন। তাঁর সারা জীবনই ব্যয় হয়েছে সাধারণ মানুষের কল্যাণে। তাঁর জীবনটা আমাদের জন্যে একটি সুন্দর আদর্শ। তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ অনুসরণে একটি সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠায় সকলের মনোযোগী হওয়া উচিত। তিনি আমাদের কাছে তাঁর কর্মগুনে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন এবং থাকবেন।
লেখক: মোহাম্মদ শাহজাহান, প্রাবন্ধিক, ব্যাংকার ও পরিবেশ-মানবাধিকারকর্মী।
পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ