জাতীয়বীর বিপ্লবী মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেন ও তাঁরই বিশ্বস্থ সহযোদ্ধা বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদারকে আজ থেকে ৯০ বছর আগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের সাজানো তৃতীয় অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলায় ভারতীয় দন্ডবিধি -১২১, ১২১(এ)-৩০২/৩৪, ৩০২/১০৯, ৩০৭ ধারা; ভারতীয় অস্ত্র আইন ১৯ (এফ) ধারা এবং ভারতীয় বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের ৪ ও ৬ ধারায় মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত করে চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে ফাঁসি প্রদান করে এবং একই মামলায় কল্পনা দত্তকে যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করে।
মাস্টারদা সূর্যসেন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জম্মগ্রহণ করলেও মাতৃভূমির প্রতি বজ্রকঠোর ভালোবাসা ও নেতৃত্বে হয়ে উঠেছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী মহানায়ক।
মাস্টারদা সূর্যসেন স্বামী বিবেকানন্দের জীবনাদর্শ ও বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের অধ্যাপক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী’র সান্নিধ্যে বৈপ্লবিক আদর্শে দীক্ষিত হন। চন্দনপুরা ন্যাশনাল স্কুল’-এ শিক্ষকতা করার কারণে ‘মাস্টারদা’ হিসেবেই পরিচিত। তিনি ‘যুগান্তর’ নামক বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত থাকার পাশাপাশি ১৯২৯ সালে ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি চট্টগ্রাম শাখা’ দল গঠন করেন। অম্বিকা চক্রবর্তী, নির্মল লালা, গনেশ ঘোষ, অনন্ত সিং ও আফসার উদ্দিন মাস্টারদা সূর্যসেন’কে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি নির্বাচিত করেন। বিট্রিশ সাম্রাজ্যবাদের উপর হামলার জন্য ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাস নির্ধারণ করা হলেও পুলিশি তৎপরতায় তা পিছিয়ে যায়।
১৯৩০ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তাঁদের যুববিদ্রোহের প্রস্তুতি চলে। মোট ৬৫ জন বিপ্লবী যুক্ত ছিলেন এই পরিকল্পনায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রামের সাথে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ সংযোগ ধ্বংস ও বিচ্ছিন্ন, অক্সিলারী অস্ত্রাগার আক্রমণ এবং সবশেষে চট্টগ্রাম পুলিশ লাইন অস্ত্রাগার দখল সফলভাবে সম্পন্ন করেন। পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাবটি সেদিন গুড ফ্রাইডে হওয়ায় ক্লাব বন্ধ থাকায় আক্রমণ করা সম্ভব হয়নি। যা সমন্বিতভাবে ‘চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ’ নামে পরিচিত হয়েছিল। তখন হতে ব্রিটিশদের কাছে মোস্ট ওয়ান্টেড হয়ে ফেরারী অবস্থায় থাকার প্রায় তিনবছর পর মাস্টারদা সূর্যসেন পটিয়া উপজেলার গৈরলা গ্রামে ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে এক বৈঠকে থাকা অবস্থায় ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। জেলখানা থেকে তাঁর পাঠানো বাণী ছিল, ‘আদর্শ ও একতা’।
তারকেশ্বর দস্তিদার খুব অল্প বয়সেই মাস্টারদা সূর্যসেনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বিপ্লবী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহের একমাস পূর্বে ১৭টি বোমার জন্য পিকরিক পাউডার বিস্ফোরক তৈরির সময় এক ভয়ংকর বিষ্ফোরণে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন। তাঁর বুক হাত মুখ পুড়ে গিয়েছিলো, শুধু তাই নয়, শরীরের নানা অংশে হাঁড় পর্যন্ত বেরিয়ে পড়েছিলো। তিনি অনন্ত সিংকে বলেছিলেন, আমাকে গুলি করে সংগঠন বাঁচান। গুরুতর আহত থাকায় তিনি চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহে অংশ নিতে পারেননি। সামান্য সুস্থ হলেই সংগঠন গোছানোর কাজ শুরু করেন। ২২ এপ্রিল জালালাবাদ যুদ্ধের পর মাস্টারদা তাঁর বাহিনী নিয়ে গ্রামে তারকেশ্বরের সাথে যোগাযোগ করলে, তিনি তাঁদের গোপনে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। ল্যান্ডমাইন তৈরির জন্য গানকটন ও বিস্ফোরক তিনি তৈরি করে দিতেন।
১৯৩১ সালের ৩১ মার্চ পুলিশের সাথে বরমায় প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে এক কুখ্যাত অফিসারকে আহত করেন তিনি এবং বিনোদবিহারী। মাস্টারদা সূর্যসেন গ্রেপ্তার হওয়ার পর তারকেশ্বর ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি চট্টগ্রাম শাখার ২য় সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহের নেতাদের মধ্যে তাঁর স্থান ছিল সপ্তম। ১৮ মে ১৯৩৩ গহিরা যুদ্ধে গ্রেপ্তারের পর মেজর কিং বুট জুতা পরা পায়ের লাথিতে তারকেশ্বরের চোখের ভিতর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে থাকে। ড. রমন ছদ্ম নামে তাঁর লেখা বোমা তৈরির একটি ফর্মুলাসহ খাতা পুলিশের কাছে জব্দ হয়েছিলো, যা পরবর্তীতে বিচারের সময় উপস্থাপন করা হয়েছিলো।
১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি। ব্রিটিশ শাসকেরা সেদিন মানেনি কোন নিয়ম, মানবিকতা। তারা ফাঁসিতে ঝুলানোর পূর্বে মাস্টারদা সূর্যসেন এবং তারকেশ্বর দস্তিদারকে নির্মমভাবে হাতুড়ি দিয়ে হাত, পা, মুখমন্ডলসহ শরীরের প্রতিটি অঙ্গে আঘাত করা হয়েছিল। হাতের পায়ের নখ তুলে ফেলা হয়েছিলো। তারকেশ্বর দস্তিদার জ্বরে আক্রান্ত হলেও জেলকোড বা বিধি না মেনে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছিলো। নির্যাতন এতটাই ভয়াবহ ছিলো, তারা জ্ঞান হারিয়ে নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিলেন। অত্যাচারে অর্ধমৃত দেহ দুটি টেনে হিঁচড়ে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন।
মৃত্যু নিশ্চিত, ফাঁসির মঞ্চে ঝুলে পড়লেন সূর্যসেন এবং তারকেশ্বর। পরদিন ১৩ জানুয়ারি ভোরে তাঁদের মৃতদেহ দুটি জেলখানা হতে ট্রাকে করে ৪ নম্বর স্টিমার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষমান ব্রিটিশ জাহাজ ‘দি রিনাউন’-এ তুলে বুকের সাথে বেঁধে দেওয়া হয় বড় লোহার টুকরো। তাঁদের নিয়ে জাহাজটি বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর সংলগ্ন এলাকায় সাগরের গভীরে ভাসিয়ে দেয়। পৃথিবীতে এমন পৈশাচিক, নির্মম মৃত্যুদন্ড আর কোথাও হয়েছে, তা জানা নেই। তবে ব্রিটিশরা তাঁদের শারীরিক মৃত্যু ঘটাতে পারলেও ব্যর্থ হয়েছিলো চেতনার মৃত্যু ঘটাতে। তাঁদের দেখানো পথ ধরেই আমাদের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা প্রিয় ও অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে রক্ত গঙ্গায় জেগে উঠেছিলো, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
পরিশেষে সরকারের কাছে আবেদন জানাবো, দুই মহান বিপ্লবীর ফাঁসি দিবসকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করার জন্য। রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের মাধ্যমে বিপ্লবীদের গৌরবগাঁথা ইতিহাসের সোনালী দিনগুলোর কথা আমাদের ছেলেমেয়েদের কাছে তুলে ধরা সম্ভব। একইসঙ্গে জাতীয় বীর বিপ্লবী মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেনের বাড়ি-ঘরের মতো বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদারের বাড়ি-ঘর এবং জায়গা-জমিগুলোও রক্ষা করে আগামী প্রজম্মের জন্য বিপ্লবী ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি জাদুঘর করার উদ্যোগ নেয়া হোক।
পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ