চট্টগ্রাম বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

আঞ্চলিক যোগাযোগের নতুন দিগন্তে বাংলাদেশ-ভারত

খালেদ সাইফুল্লাহ

২৩ জুলাই, ২০২৩ | ৬:১৮ অপরাহ্ণ

২০০৯ সালে বাংলদেশ আওয়ামী লীগ, দেশের ক্ষমতায় আসার পর, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম ভারত সফরকালে, অনেক সিদ্ধান্তের মধ্যে, উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধির সুবিধার্থে, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলাধীন ‘রামগড়’ এবং রাঙ্গামাটি জেলাধীন ‘ঠেগামুখ’ এলাকায়, পৃথক দুটি এলসি স্টেশন চালুর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

উক্ত সিদ্ধান্তের মধ্যে স্ব স্ব দেশের উপকারের লক্ষ্যে ‘রামগড়’কে এলসি স্টেশন/স্থলবন্দর হিসেবে চালু করায়, ভারতীয় পক্ষ তাদের অতিরিক্ত আগ্রহ দেখায়; আর বাংলাদেশ পক্ষ ‘ঠেগামুখ’কে এলসি স্টেশন/স্থলবন্দর হিসেবে চালু করার বিষয়ে বেশি আগ্রহ দেখায়। এর ধারাবাহিকতায় ঐ বছরেই (২০০৯) ‘রামগড়’ ও ‘ঠেগামুখ’কে ‘এলসি স্টেশন’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশের স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সরকারি আদেশ জারী করে, তথায় কিছু বাঁশের ঘর তৈরিকরণের মাধ্যমে, প্রাথমিক কার্যাদি সমাপ্ত করা হয়। এরপর ২০১০ সালে শুধুমাত্র ‘রামগড়’ এলসি স্টেশনকে স্থলবন্দরে উন্নীত করে, এতদসংশ্লিষ্ট কার্যক্রম সম্পাদনের নিমিত্ত স্থানীয়ভাবে প্রজেক্ট ডিরেক্টর বা পিডি নিয়োগ দান করা হয়।

ইতোমধ্যে ২৫ অক্টোবর ২০১৮, পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের দুটি সমুদ্রবন্দর তথা চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের বিষয়ে ‘ভারত-বাংলাদেশের’ মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির ধারাবাহিকতায় ‘রামগড়’ স্থলবন্দর দিয়ে, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে সংশ্লিষ্ট পন্য ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রোম নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে, মহাযজ্ঞ শুরু হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ১৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে, বর্তমানে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর আওতায় আন্তর্জাতিক মানের প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল তৈরিকরত এর অভ্যন্তরে বিজিবি চেকপোস্ট, কাস্টমস ইমিগ্রেশন অফিস স্থাপনকরত, এতে প্রবেশ ও বাহির হওয়ার ব্যবস্থা রেখে, এককেন্দ্রিক সেবা প্রদানের লক্ষ্যে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন আরম্ভ হয়েছে। এছাড়া ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে, রামগড়ের ‘মহামুনী’ নামক স্থানে, এ বন্দরের জন্য ৪১২ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৪.৮০মিটার প্রশস্থ একটি ব্রিজ, আন্তর্জাতিক ফেনী নদীর উপর ইতোমধ্যে তৈরি সম্পন্ন করা হয়েছে; যা ২০২১ সালের শুরুর দিকে এক ভার্চুয়াল প্রোগ্রামের মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ-১’ নামে, বাংলাদেশ ও ভারত; উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং নরেন্দ্র মোদী উদ্বোধন করেছিলেন।

একইসাথে ১১০৭.১২ কোটি টাকা ব্যয়ে, রামগড় থেকে হেঁয়াকো হয়ে চট্টগ্রামের ‘বারোইয়ার হাট’ পর্যন্ত, বিদ্যমান আঞ্চলিক সড়কটিকে, প্রশস্থ করার কার্যক্রমও হাতে নেওয়া হয়েছে। এতে ভারতীয় সরকার এর লাইন অব ক্রেডিট এর ৫৯৪.০৭ কোটি টাকা এবং অবশিষ্ট অর্থ (৫১৩.০৫ কোটি টাকা) বাংলাদেশ ব্যয় করছে। ৩৮ কি.মি. দৈর্ঘ্য এ সড়কের নির্ধারিত কার্যাবলীর মধ্যে ৯টি সেতু (মোট দৈর্ঘ্য ২৪৯.২০ মিটার), ২৩টি কালভার্ট (মোট দৈর্ঘ্য ১০৮ মি.), আরসিসির টেইনিং ওয়াল নির্মাণ ৩৮০০ মিটার, সসার ড্রেইন নির্মাণ ৩০,০০০ মিটার, আরসিসি ইউ ড্রেন নির্মাণ ১০,০০০ মিটার, সড়কের প্রশস্ততা ১১.৩০ মি., সর্বোপরি ৬৮.৬১ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহনের কার্য্য নির্ধারিত রয়েছে।

জানা যায়, বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের মধ্যে গত ৫ এপ্রিল ২০১৭, নয়াদিল্লীতে ৩য় লাইন অব ক্রেডিট (LOC-III) এর জন্য একটি Memorandum Understanding (MOU) স্বাক্ষরিত হয়। উক্ত (MOU) বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রকল্পের মাধ্যমে ৩৮.০০ কি. মি. দীর্ঘ সড়কটির প্রশস্ততা ৫.৫০ মিটার (১৮ ফুট) হতে বৃদ্ধি করে, ১১.৩০ মিটার (৩৮ ফুট) করা হবে। তাছাড়া প্রকল্পের মাধ্যমে ৯টি সেতু (২৪৯.২০ মিটার) এবং ২৩টি কালভার্ট (১০৮ মিটার) নির্মাণ করা হবে। উল্লেখ্য, উক্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (8FYp) অনুসারে, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ১২,৭০০ কি. মি., আঞ্চলিক/জেলা মহাসড়ক/ উন্নয়ন/পুনর্বাসন ৩৭,৫০০, মিটার সেতু/কালভার্ট নির্মাণ ৩৭৫ কি.মি. রিজিড পেভমেন্ট নির্মাণ এর অংশ বিশেষ বাস্তবায়িত হবে।

অনুমোদিত প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রকল্পের ব্যয় ১১০৭.১২ কোটি টাকা; যার মধ্যে জিওবি ৫১৩.০৫ কোটি টাকা এবং প্রকল্প ঋণ ৫৯৪.০৭ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ৩টি পূর্ত প্যাকেজ এবং নির্মাণ কাজ তদারকীর জন্য ১টি পরামর্শক সেবা প্যাকেজ রয়েছে। বিবেচ্য PW1-2 পূর্ত প্যাকেজের আওতায়, ২২.৭০ কি. মি. সড়ক (৫.৫০ মিটার হতে ১১.৩০ মিটার প্রশস্ততায়) প্রশস্তকরণ, ১৩.৮০ কি.মি. সড়ক উচুকরণ, ১.৫০ কি.মি. রিজিড পেভমেন্ট নির্মাণ করা হবে। এছাড়াও প্যাকেজের আওতায় ৯টি সেতু ও ২৩টি কালভার্ট নির্মাণ/প্রশস্তকরণসহ, রক্ষাপদ কাজ, ড্রেন নির্মাণ ও সাইন সিগন্যাল স্থাপন কাজ করা হবে।

আশা করা হচ্ছে- উক্ত প্রকল্পটি, প্রতিবেশি দেশের সাথে আমদানি-রপ্তানির পাশাপাশি, আঞ্চলিক ও উপ আঞ্চলিক সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে। এটি বাস্তবায়িত হলে, ভারত-বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন দ্বার উম্মোচিত হবে।

সাব্রুম (ত্রিপুরা)/রামগড় (খাগড়াছড়ি) স্থলবন্দর, উভয় দেশের ব্যবসায়িক কর্মকান্ডে শিল্প সম্ভাবনার সৃষ্টি করবে। প্রস্তাবিত সড়কটি, ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়কের মিরসরাই এর বারৈয়ারহাট হতে শুরু হয়ে, খাগড়াছড়ির রামগড়ে শেষ হয়েছে। রামগড় স্থলবন্দরটি, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর হতে মাত্র ১০৮ কি. মি. ও রাজধানী ঢাকা হতে ২০৪ কি.মি. দূরত্বে অবস্থিত। তাই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও ঢাকার সাথে, সাব্রুম (ত্রিপুরা)/রামগড় (খাগড়াছড়ি) স্থলবন্দর এর সংযোগ স্থাপন হবে এবং এর মাধ্যমে অত্র অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং সামাজিক সমৃদ্ধি বেগবান হবে।

পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির সাথে চট্টগ্রাম বিভাগসহ, সারাদেশের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপিত হবে। বিশেষজ্ঞগণের মতে, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে রামগড় দিয়ে পন্যাদি আনা-নেওয়া আরম্ভ হলে, বাংলাদেশের সাথে ভারতের ব্যবসা ১৭২% বৃদ্ধি পাবে। প্রজেক্টটি শেষ হতে আরও একবছর সময়ের প্রয়োজন হতে পারে মর্মে বাংলাদেশ পক্ষ থেকে অবহিত হবার পর, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রজেক্ট শেষ হওয়ার আগেই, অস্থায়ীভাবে এ স্থল বন্দর দিয়ে ইমিগ্রেশন এর কার্যক্রম শুরু করার জন্য অনুরোধ করার প্রেক্ষিতে, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আগামী সেপ্টেম্বর মাস থেকে, তা আরম্ভ করা হতে পারে বলেও প্রাথমিক ভাবে তথ্য পাওয়া গেছে।

ভারতীয় পক্ষের অতি আগ্রহ এবং বাংলাদেশ পক্ষের সম্মতিতে, ‘রামগড়’ স্থলবন্দরকে নিয়ে যখন এতো বেশি কর্মচাঞ্চল্য চলছে, তখন উত্তর-পূর্ব ভারতের অপর রাজ্য, মিজোরামের ‘দেমাগ্রী’ থেকে বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি জেলাধীন ‘তেগামুখ’ এলসি স্টেশনটিকে, ‘স্থলবন্দরে’ উন্নীত করাতো দূরের কথা, বরং সর্বশেষ তথ্য পাওয়া পর্যন্ত, উল্টো প্রাসঙ্গিক এলসি স্টেশনটিকে (তেগামুখ) ইতোমধ্যে ‘নন-অপারেটিভ’ ঘোষণা করা হয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, রামগড়কে অতি দ্রুত ভারতের সাথে, যোগাযোগের কেন্দ্রস্থলে পরিণত করার বিপরীতে, ‘তেগামুখ’কে ত্যাগ করা কি যুক্তিসঙ্গত হবে? অভিজ্ঞমহলের মতে, উভয় দেশের ‘উইন-উইন’ অবস্থা অক্ষুণ্ন রাখাসহ আনুসঙ্গিক গুরুত্ব বিবেচনায়, ‘ঠেগামুখ’এলসি স্টেশনকে যত দ্রুত সম্ভব ‘স্থলবন্দরে’ উন্নীত করে, প্রস্তাবিত উক্ত স্থলবন্দরটিকে অপারেটিভ করা এখন সময়ের দাবি।

 

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট