চট্টগ্রাম রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের পুরোধা ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী

১৯ এপ্রিল, ২০২৩ | ৪:৩৪ পূর্বাহ্ণ

মনে হয় ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কর্মজীবন যথার্থভাবে মূল্যায়িত হয়নি আর এমনটি ভাবার পর্যাপ্ত কারণও রয়েছে। এমনকি তার মহাপ্রয়াণের পরও শোক প্রকাশে আমরা যথেষ্ট উদার হতে পারিনি। ভাল আর মন্দের অনিশ্চিত দোলাচলে তার জীবন বিতর্কিত হয়েছে। রাউজানে জন্ম নেয়া ক্ষণজন্মা এ পুরুষটি বিত্ত-বৈভবের মধ্যে আয়েশি জীবন অনায়াসে কাটাতে পারতেন কিন্তু তিনি তা না করে দেশমাতৃকার সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। অন্তরের তাগিদে স্বাধীনতার ডাক শুনতে পেয়েছিলেন সেই ডাক উপেক্ষা করা আর তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফিরে এসে যোগ দিলেন প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধে, স্থাপন করলেন সীমান্তসংলগ্ন ত্রিপুরার মেলাঘরে বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল। স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুললেন একদল প্যারামেডিক্স, যার ধারাবাহিকতায় পরে সৃষ্টি হল সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। নামটি অবশ্য তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে পরামর্শ করে স্থির করেছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য চিকিৎসাব্যবস্থা প্রবর্তন। পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়ন। তিনি বিশ্বাস করতেন সকল মানুষই অপার সম্ভাবনাময়। তাই শাড়ি পরা গ্রাম্য নারীদের পরবর্তীকালে দেখা গেল ইউনিফর্ম পরে মেকানিক, প্লাম্বার, কাঠমিস্ত্রি, গাড়ি চালানোর মতো দক্ষ কারিগরের। সম্ভবত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম পেশাদার নারী গাড়িচালক নিয়োগের কৃতিত্বের দাবিদার।

 

তবে ডাক্তার জাফরুল্লাহর মূল কীর্তি এই দেশের ঔষধশিল্পে অবদান। সেই ৫০ বছর আগে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন চিকিৎসাব্যয়ের সিংহভাগ ওষুধ ক্রয়ে ন্যস্ত হয় এবং এই ঔষধের বাজার প্রায় সম্পূর্ণভাবে আমদানিনির্ভর ও বহুজাতিক কোম্পানির দখলে। এই বৈষম্যের অবসানে তিনি উদ্যোগ নেন জাতীয় ওষুধনীতি প্রণয়নের। পৃষ্ঠপোষকতা পান তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের। বৈদেশিক নির্ভরতার অপসারণ করে দেশীয় ওষুধশিল্প বিকাশে ওষুধনীতি আপোষহীন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে বহুজাতিক ঔষধ কোম্পানী ও তাদের এদেশীয় দোসর ও দুঃখজনকভাবে কিছু সুবিধাভোগী চিকিৎসক সমাজ। জেনারেল এরশাদের নেতিবাচক ভাবমূর্তি পুঁজি করে ডাক্তার জাফরুল্লাহকে তারা গণবিরোধী খল চরিত্রে পরিণত করার প্রয়াস পায় কিন্তু ব্যর্থ হয়ে একসময় ধীরে ধীরে পাততাড়ি গুছিয়ে এ দেশ হতে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলে। সেই শূন্যস্থান পূরণে আজ দেশে গড়ে উঠেছে হাজার কোটি টাকার ঔষধশিল্প। দেশীয় চাহিদার ৯৭ ভাগ ঔষধই এখন দেশে উৎপন্ন হয়। জীবনরক্ষাকারী ঔষধ মূল্য এখন সাধারণের নাগালের ভেতর। দেশের গ-ি পেরিয়ে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের ১৫০টি দেশে বাংলাদেশের ঔষধ রপ্তানি হচ্ছে। এই গৌরবের অন্যতম অংশীদার ঔষধনীতির স্বপ্নদ্রষ্টা ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী। কিন্ত দেশে কোন ঔষধশিল্প প্রতিষ্ঠানকে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় নি।

 

তার আরেকটি কীর্তি গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে এ দেশের বৃহত্তম ১০০ শয্যাবিশিষ্ট ডায়ালাইসিস কেন্দ্র স্থাপন। দরিদ্র রোগীদের নামমাত্র অথবা বিনামূল্যে জীবনরক্ষাকারী এই বিশেষায়িত সেবা প্রদানের সুযোগ সৃষ্টির জন্য তিনি অমর হয়ে থাকবেন। কিন্তু তার মরদেহ সমাধিস্থ হতে না হতেই ধর্মের ধ্বজাধারী এক শ্রেণির মানুষ আজ প্রশ্ন তুলছেন ডা. জাফরুল্লাহ কি ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক ছিলেন? মৃত্যুর পর তাঁর গন্তব্য কি দোজখে হবে? সেইসব ধর্মনেতাদের কাছে আমার বিনীত প্রশ্ন ইসলাম মানবতার ধর্ম কিন্তু এঁরা কি কখনো নিজেদের মানবতার সেবায় নিয়োজিত করেছেন? গনমানুষের কল্যাণে কোন কর্মটি তাঁরা নিজের বলে উল্লেখ করতে পারেন। শুনতে পাই এঁদের কেউ কেউ প্রতিরাতের জলসায় ঘণ্টা দু’এক ওয়াজ করার জন্য লক্ষাধিক টাকা পারিশ্রমিক নিয়ে থাকেন। এইভাবে তাঁদের সম্পদ স্ফীত হয়ে আর সহায় সম্বলহীন এই মানুষটি মধ্যমানের একটি হাসপাতালে মৃত্যুর প্রহর গুনেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি হয়তো ধর্মাচারী ছিলেন না কিন্তু ইসলামবিদ্বেষী ছিলেন এমনটা কখনো শোনা যায় নি।
কীর্তিমানরা যুগে যুগে জন্ম নেন না। শতবর্ষ-পরে দু-একজন জন্ম নেন। বীরচট্টলার রাউজানে একদা জন্ম নিয়েছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত বিপ্লবী নেতা মাস্টারদা সূর্যসেন। শতবর্ষ-পরে রাউজানে জন্ম নিয়েছেন এই দেশের স্বাধীনতার আরো একজন সূর্যসৈনিক মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
কর্মমূখর গণমানুষের এই বন্ধুটি সারাজীবন বৈরিতার উজান ঠেলে গেছেন কিন্তু কোনো কিছুই তাঁকে স্থবির করতে পারেনি। অনাড়ম্বর সাদাসিধে মলিন পোষাকের এই মাটির মানুষটি আবার ফিরে গেছেন তাঁর প্রিয় সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পূন্যভূমিতে। হাদিসে আছে- ‘যে বিশ্বমানবের হিতসাধন করে সেই শ্রেষ্ঠ মানুষ’। জাফরুল্লাহ চৌধুরী সেই কাতারের একজন। আমরা তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।

ডা. মো. সাজেদুল হাসান
বাংলাদেশ সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট