চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

সর্বশেষ:

সিয়াটল টু নিউ ইয়র্ক : উই আর দ্যা সিক্স গাইজ

আতিকুল ইসলাম

৫ এপ্রিল, ২০২১ | ৫:১৩ পূর্বাহ্ণ

‘সিয়াটল টু নিউইয়র্ক : উই আর দ্যা সিক্স গাইজ’ মূলত স্বপ্নের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ছয় ভাগ্যসন্ধানী তরুণের স্বপ্নযাত্রার এক দুর্দান্ত অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী। এতে মার্কিনমুল্লুকে গমন, যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল শহর থেকে নিউইয়র্ক শহরে বাসে যাতায়াত, সেখানে ভাগ্য অন্বেষণ, প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে নিজেদের মানিয়ে নিয়ে ভাগ্য জয়সহ নানা বিষয় যেমন চমৎকারভাবে উঠে এসেছে, তেমনি সেখানকার সংস্কৃতি, জীবনপ্রণালী, বহির্বিশ্ব বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো থেকে গমনকৃত ভাগ্যসন্ধানীদের টিকে থাকা ও জীবনজয়ের লড়াই চমৎকারভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। আজ প্রকাশিত হলো সূচনাপর্ব। সুখপাঠ্য এই লেখাটি পড়ে সন্ধিৎসু বোদ্ধা পাঠক এক দুর্দান্ত অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ যেমন পাবেন, তেমনি নানা জিজ্ঞাসারও জবাব পাবেন।

সময়টা জানুয়ারির মাঝামাঝি। আমরা ছ’ বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের সিয়াটল শহরের সিয়াটাক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছালাম। থাই এয়ারওয়েজের বোয়িং ৭৪৭ ফ্লাইট নং ঞএ৭৪০ বিমানটির চাকা যখন রানওয়ে স্পর্শ করল, বুকটা একটু কেঁপে উঠল। আনন্দ এবং অজানা ভয়, দুটোই মনটাকে জুড়ে দিলো। ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়াতেই একজন অফিসার আমাদের আলাদা করে একটি রুমের ভেতরে নিয়ে গেলেন। তারা বিশ্বস করতে চাইলেন না যে আমরা পড়াশুনা করতে এসেছি যদিও আমাদের সকলের কাছেই বৈধ স্টুডেন্ট ভিসা ছিল। একে একে সবাইকে জেরা করলেন।

যে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ভর্তি হয়ে এসেছিলাম, সে সকল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খোঁজ খবর করলেন তারা। নেতিবাচক কিছুই পেলেন না। বারবার জিগ্যেস করলেন আমরা কেন এসেছি এবং সত্য বললে ছেড়ে দেবেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি। এ যেন রাশিয়ান স্পাইদের জেরা করা। দু’তিনবার করে আমাদের সবার স্যুটকেস চেক করলেন। কিছুই খেতে দিলেন না। বন্ধুদের মধ্যে যারা সিগারেট খান, তারা সিগারেট ধরালেন। আমাকেও একটা দেয়া হল। সিগারেট যে খিদে বাড়ায় তা জানতাম না। পেটে যেন আগুন ধরল। এক বন্ধুর মা কিছু পিঠা দিয়েছিলেন তাই খেয়ে পেটের ক্ষুধা কিছুটা হলেও মিটালাম।

দিনের দু’টোর দিকে তারা সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেবেন। থাই এয়ারওয়েজের পোশাক পরিহিত একজন ভদ্রলোক এলেন। তার মুখে মহাবিরক্তির চিহ্ন। আমরা এখন তার জন্য উটকো ঝামেলা। বলে রাখা ভাল যে আমরা এসেছি ওয়ান ওয়ে টিকেট করে। টিকেটের দাম পড়েছিল বাংলাদেশী টাকায় ১৬,২০০ টাকা। আামদের ফেরত পাঠিয়ে দিলে এয়ারলাইন্সকেই যাবার ব্যবস্থা করতে হবে। চারটের দিকে নতুন এক দল অফিসার এলেন। পুরোনোদের বাড়ি ফিরবার পালা। নতুনদের মধ্যে একজন ছিলেন খুব সম্ভবত পাকিস্তানি। মনে হল আমাদের প্রতি তার দয়া হল। জানি না কি বললেন অন্যদের। তিনি জানালেন্ সহসাই আমাদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হবে। থাই এয়ারওয়েজের ভদ্রলোকটিকেও জানানো হলো। তিনি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। চলে যাবার সময় আমাদের বলে গেলেন আমরা যেন জীবনে কোনিদনই থাই এয়ারওয়েজে না ছড়ি। তার কথা আজো ফেলতে পারিনি। শ্বেতাঙ্গ এক সুন্দরী মহিলা অফিসার এসে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন আমরা কি যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশ করতে চাই? আমরা সবাই মাথা নাড়ালাম। তিনি বললেন, ‘অল সিক্স অফ ইউ, ওকে কাম উইথ মি’। আমাদের তিনি তাঁর ইমিগ্রেশন কাউন্টারে নিয়ে গেলেন। একে একে আমাদের সবার পাসপোর্টে সীল মেরে দিলেন আর বললেন, ‘ওয়েলকাম টু দি ইউনাইটেড স্টেটস।’ আমেরিকানরা আমেরিকাকে বলেন, ‘ইউনাইটেড স্টেটস।’ উত্তরে সুন্দর করে কি বলতে হবে তাতো জানি না। থ্যাংক ইউ পর্যন্ত বলতে পারলাম। আমাদের মাছে একজন আবেগের বশবর্তী হয়ে মহিলাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলেন। পাকিস্তানী অফিসার এসে আমাদের উর্দুতে বললেন, ‘জালদিসে নিকাল যাও ইহাসে।’ সহজ উর্দুু, বুঝতে বেগ পেতে হল না। অর্থাৎ মত পাল্টাবার আগেই তাড়াতাড়ি ভাগো।

সিয়াটাক এয়ারপোর্টের মেইন টার্মিনালটা ইমিগ্রেশন ভবনের বেশ দূরে। মনরেলে (সড়হড়ৎধরষ) করে যেতে হয়। আমরা লাগেজ নিয়ে মনরেলে উঠলাম। দেখি সেই ইমিগ্রেশন অফিসাররাও আমাদের সাথে উঠেছেন। সবার ভয়ে হাত-পা কাঁপছে। অফিসাররা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকলেন। আমাদের দিকে ফিরেও তাকালেন না। অল্প সময় পর টার্মিনালে পৌঁছালাম। আমরা তাদের আগে নামতে দিলাম। তারা নামছেন। শেষজন আমাদের দিকে ফিরে বললেন, ‘ওই আর ওয়াচিং ইউ।’ সহযাত্রী শাহিনের মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। আর ভয়ে আমার যে কি হল তা না বলাই ভাল।

মেইন টার্মিনালে পৌঁছে সবাই বাথরুম সেরে নিলেন। মনোরেলে থেকে নামবার সময় আমার প্যান্টটা একটু ভিজেগিয়েছিলো তা পাল্টে নিলাম। এবার নিউইয়র্ক শহরে যাবার পালা। জানা গেলো সিয়াটল থেকে নিউইয়র্ক পর্যন্ত জনপ্রতি বিমান ভাড়া ৬০০ মর্কিন ডলার। তাও কিনা ওয়ান-ওয়ে। এ দেশে কোথাও ভ্রমণ করতে হলে কমপক্ষে দু’সপ্তাহ আগে টিকেট কাটতে হয়। কেউই এত টাকা দিয়ে যেতে রাজি হল না। ঠিক করলাম বাসেই যাবো নিউইয়র্ক শহর। ভাংগা ভাংগা ইংরেজিতে এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম বাসে করে কিভাবে নিউইয়র্ক যাওয়া যায়। তিনি অবাক হয়ে বললেন, এতো অনেকদূর, তোমরা কি ঠিক বাসে করে নিউইয়র্ক যাবে? আমাদেরতো কিছু করবার নেই, তাই বাসে গেলেও আমাদের অসুবিধা নেই। আমাদের তিনি বলে দিলেন পাবলিক বাস নিয়ে ডাউনটাউন সিয়াটল যেতে এবং সেখান থেকে দূরপাল্লার বাস টার্মিনাল থেকে গ্রেহাউ- বাস নিতে।

আমরা এরাইভাল লাউঞ্জের বাইরে এসে রাস্তায় নামতেই দেখি সারি বেঁধে অনেকগুলো থামে বিশাল বিশাল পতাকা ঝুলছে। যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা শনাক্ত করতে বেশি বেগ পেতে হল না। সাদা এবং লাল স্ট্রাইপের পতাকা, এক পাশে চারকোণা নীল রঙের একটি বর্গের মাঝে অনেকগুলো সাদা তারা। দূর থেকে দেখেই বলে দেয়া যায়। হঠাৎ ঝটকা হাওয়া পতাকাগুলোকে দোলাতে থাকল। সহযাত্রী আতাউর উচ্ছ্বসিত হয়ে মৃদু হেসে বললেন পতাকাগুলো যেন আমাদের সংবর্ধনা দিয়ে এ দেশে বরণ করে নিল। তার একটু সামনেই বাসস্টপে আমরা বাসের অপেক্ষায় দাঁড়ালাম।

দূরে মাউন্ট রেইনারের (Mount Rainier) বরফাচ্ছন্ন চূড়া দেখা যাচ্ছিল। একটি বাস এলো, কিন্তু সাহস করে উঠলাম না। তারপর কিছু পর আরেকটু বাস এলো, তাতেও উঠলাম না। এদিকে অন্ধকার হতে চলেছে। শীতের মৌসুমে সূর্য অস্ত যায় পৌনে পাঁচটায়। ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি। দশ মিনিট পর যখন তৃতীয় বাসটি এলো, আর দেরি না করে ভাড়া না দিয়েই উঠে পড়লাম। বাস প্রায় ফাঁকা।
আমরা সবাই বাসের পিছনের সারিতে গিয়ে বসলাম। যুক্তরাষ্ট্রে পাবলিক বাসে কোনো হেল্পার বা কন্ডাক্টর থাকে না, বাস ড্রাইভারকেই একটি মেশিনের মাধ্যমে ভাড়া সংগ্রহ করতে হয়। PA (Public Announcement) সিস্টেমে বাস ড্রাইভার ঘোষণা করলেন, ‘সিক্স গাইজ্্, প্লিজ পে ইওর বাস ফেয়ার।’ এক ডলার করে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ড্রাইভার সাহেবকে বোঝাতে সক্ষম হলাম যে আমরা গ্রেহাউন্ড বাস স্টেশনে যেতে চাইছি। তিনি বুঝতে পারলেন আমরা এ দেশে নতুন এসেছি। সিয়াটল শহরটি এয়াপোর্ট থেকে একটু দূরে। প্রায় ৩৫ মিনিট পর তিনি আমাদের শহরের একটি ইন্টারসেকশনে নামিয়ে দিলেন।
এখান থেকে আমাদের অন্য বাস ধরতে হবে। জায়গাটা স্পেস নীডলের খুব কাছে। স্পেস নীডল একটি শহর পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। ১৯৬২ সালে তৈরি এ টাওয়ারটি উচ্চতায় ৬০৫ফুট। উপরে অবজারভেশন ডেক থেকে সিয়াটল শহরের চারপাশ সবই দেখা যায়। শহরটি যতই দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। এরই মাঝে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমাদের বাস ড্রাইভারটি বাস থেকে নেমে আমাদের সাথেই দাঁড়িয়ে রইলেন। অন্য একটি বাস এলো দু’মিনট পর।

(পরের অংশ দেখুন আগামীকাল)

পূর্বকোণ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট