১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঐতিহাসিক ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণার মধ্য দিয়েই কার্যত স্বাধীনতার ডাক দেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণাদায়ী ওই ভাষণ এখন ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে বিশ্ব বাসীর সামনে। নানা গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণটি বিশ্বসেরা ভাষণগুলোর অন্যতম। বিশ্বসেরা ভাষণ নিয়ে প্রকাশিত যুক্তরাজ্যের একটি প্রকাশনায় তা স্থান পেয়েছে। ভাষণের বইটির নাম ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস- দ্য স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্টরি’। বইটির সঙ্কলক : জ্যাকব এফ ফিল্ড। খৃস্টপূর্ব ৪৩১ সাল থেকে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সেরা ভাষণ নিয়ে ২২৩ পৃষ্ঠার বই এটি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিলের ভাষণ থেকে নেওয়া শিরোনামের এই সঙ্কলন গ্রন্থের শেষ ভাষণটি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের ‘টিয়ারস ডাউন ওয়াল’। বইটির ২০১ পৃষ্ঠায় ‘দ্য স্ট্রাগল দিস টাইম ইজ ট্য স্ট্রাগল ফর ইন্ডিপেন্ডেন্স’ শিরোনামে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি বিশ্বসেরা ভাষণের একটি, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে বিশ্বসেরা ভাষণ নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে অনেক প্রকাশনা রয়েছে। কোনোটিতে আগে অন্তর্ভুক্ত ছিল না ভাষণটি। এই প্রথম আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বসেরা ভাষণগুলোর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলো ৭ মার্চের ভাষণ। এখন আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বসেরার তালিকায় স্থান পেল বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি। একইসঙ্গে ইউনেস্কোও ভাষণটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করেছে। স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্বসম্পদ হিসেবে। এটি আমাদের জন্যে অনেক আনন্দের।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি দিন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের এই দিনে এক রাজনৈতিক কবি সমগ্র জাতিকে শুনিয়েছিলেন এক মহাকাব্যিক কবিতা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই দিনে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক উত্তাল জনসমুদ্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন।
তিনি লাখো জনতার উদ্দেশে দেয়া সে ঐতিহাসিক ভাষণে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তখনকার রেসকোর্স ময়দানে জড়ো হওয়া মানুষ সেদিন মন্ত্রমুগ্ধের মতো আবিষ্ট হয়েছিল সেই বজ্রকণ্ঠে। দেশের মানুষ একটি দন্ডে একাত্ম হয়েছিল- সেদিনই প্রথম। বঙ্গবন্ধুর সে বজ্রনির্ঘোষ ঘোষণাই ছিল প্রকৃতপক্ষে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ভিত্তি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ভাষণটি কখনো পুরনো হবার নয়। কারণ, সে ভাষণটি ছিল বাঙালি জাতির হাজার বছরের আরাধ্য ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রের জন্মের ভিত্তি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে তা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে মহান মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি বিবেচনায় মুক্তিকামী দেশপ্রেমিক বাঙালি জনগোষ্ঠী স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রক্তাক্ত স্বাধীনতার যুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জয় হয় স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতির। দখলদার মুক্ত হয় বাংলাদেশ। বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে ভাস্বর হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। সংগতকারণে ৭ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের কাছে অন্যরকম মহিমায় ভাস্বর একটি দিন আর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি বাঙালি জাতির স্বপ্ন পূরণের দিকনির্দেশনার ‘ম্যাগনাকার্টা’ হিসেবে বিবেচিত।
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু ষাটের দশকে বাঙালির মুক্তিসনদ হিসেবে ‘আমাদের বাঁচার দাবি ছয় দফা’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন। সে দলিলের ভিত্তিতে বাঙালি জাতি সত্তরের নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছিল বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দলকে। বঙ্গবন্ধু ৬ দফায় প্রচারণার জন্য ষাটের দশকে ‘নতুন দিন’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। সম্পাদক ছিলেন কবি নজরুলের অনুরাগী এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন সুফি জুলফিকার হায়দার। পত্রিকাটি অবশ্য দীর্ঘায়ু হয়নি। বঙ্গবন্ধু কচিকাঁচার আসরের মাধ্যমে ভবিষ্যতের বাঙালি গড়ে তুলতে নেপথ্য ভূমিকা রেখেছিলেন।
ষাটের দশকে যারা কচিকাঁচার আসর করতেন, তাদের অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর প্রায় সব ভাষণেই কাব্য, ভাষা, ছন্দ, মাত্রা, অনুপ্রাসের অনুরণন মেলে। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানের ভাষণের দিকে তাকালে দেখা যায় তার কাব্যভাষা। ‘ভাইয়েরা আমার, পাকিস্তানের ইতিহাস, দুঃখের ইতিহাস। বাইশ বছর হয়ে গেল, পাকিস্তানের সরকার এই দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারে নাই। ভাইয়েরা আমার, আজ আপনাদের সামনে বিরাট পরীক্ষা। আপনারা কী করবেন, কী করছেন, আপনারা স্বাধীন দেশের মতো বাস করতে চান কী চান না। ভাইয়েরা আমার, আজ ২২ বছর স্বাধীনতা পেয়েছি। কী পেয়েছি আমরা পেয়েছি গুলি, পেয়েছি অত্যাচার, পেয়েছি জুলুম, পেয়েছি হুঙ্কার, পেয়েছি দুর্নীতি, পেয়েছি বুক খাঁ খাঁ করা আর্তনাদ। গরিব যখন কিছু দাবি করে তাদের ওপর গুলি চালিয়ে দেয়া হয়। শ্রমিক যখন দাবি করে, তাদের অত্যাচার করা হয়। মজুর যখন দাবি করে, তাদের ওপর জুলুম করা হয়। ২২ বছরের ইতিহাস, খুনের ইতিহাস।
২২ বছরের ইতিহাস মীর জাফরের ইতিহাস। ২২ বছরের ইতিহাস, খুবই করুণ ইতিহাস।’ এই যে ভাষণ, যেখানে বাংলা ও বাংলার মানুষের আর্তনাদ, হাহাকার আর শোষণের কথা বলা হয়েছে, তাতে শব্দচয়ন ও ব্যবহারে পরিমিতিবোধ ও প্রয়োজনীয়তার প্রাধান্য মেলে। দুঃখের চালচিত্রের কথা বলেই তিনি থেমে থাকেন নি। তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের কথাও বলেছেন। যে ভাষায় যে শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করেছেন, তাতে বঙ্গবন্ধুর চমৎকার ভাষাবোধ পরিলক্ষিত হয়। ভাষাবিজ্ঞানের মাপকাঠিতে বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শব্দচয়ণ এবং বাক্যবিন্যাসে বঙ্গবন্ধুর পারদর্শীতা এবং দূরদর্শীতা অনন্যসাধারণ।
ভাষণ নিয়ে গবেষণাকারীরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন, বঙ্গবন্ধুর সব ভাষণই স্বতঃস্ফূর্ত এবং সুষ্পষ্ট বার্তাবাহী। ছোট ছোট বাক্য, কিন্তু অর্থের দ্যোতনা অনেক বেশি। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর বেতার-টিভিতে সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ ভাষণ দেন। সেখানেও তার ভাষাসৌকর্য উল্লেখ করার মতো। বাংলাদেশের সব মানুষের মনের কথাগুলোই তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর কাব্যিক ভাষণে। ‘২৩টি বছরের অত্যাচার, অবিচার, শোষণ ও শাসনে বাংলার মানুষ আজ নিঃস্ব, সর্বহারা।
ক্ষুধায় তাদের অন্ন নেই, পরনে নেই বস্ত্র, সংস্থান নেই বাসস্থানের। বাঙালার অতীত আজ সুপ্ত, বর্তমান অনিশ্চিত, ভবিষ্যৎ অন্ধকার। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ঢেলে দিয়ে আজও যারা ঘুমিয়ে আছেন, তাদের এবার ডাক দিয়ে কেবল বলে যেতে চাই, জাগো, বাঙালি জাগো। তোমাদের জাগরণেই এ দেশের সাত কোটি মানুষের মুক্তি।’ বাংলার শোষিত মানুষের মধ্যে বিপ্লবীচেতনা জাগাতে সহজ-সরল ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করেছেন বঙ্গবন্ধু। প্রতিটি বাক্য নানা দ্যোতনা বহন করে।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে যে ভাষণ দেন, তাতেও আবেগপূর্ণ ভাষার আড়ালে প্রতিরোধী হওয়ার, কঠিন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পটভূমি এ ভাষণে মেলে। সে ভাষণে তিনি দৃপ্তকণ্ঠে বলেছেন, ‘প্রয়োজনে বাঙালি আরও রক্ত দেবে, জীবন দেবে কিন্তু স্বাধিকারের প্রশ্নে কোনো আপস করবে না। বাংলার মানুষ যাতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে, বরকত-সালাম-রফিক-শফিকরা নিজেদের জীবন দিয়ে সেই পথ দেখিয়ে গেছেন। বাহান্ন সালে রক্তদানের পর বাষট্টি, ছেষট্টি, ঊনসত্তরে-বারবার বাঙালিকে রক্ত দিতে হয়েছে।
কিন্তু আজও সেই স্বাধিকার আদায় হয়নি। আজও আমাদের স্বাধিকারের দাবি বানচাল করে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। এই ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার জন্য বাংলার ঘরে ঘরে প্রস্তুত হতে হবে। এবার চূড়ান্ত সংগ্রাম। আর এই সংগ্রামে আমরা গাজী হয়ে ফিরে আসতে চাই। চরম ত্যাগের এবং প্রস্তুতির বাণী নিয়ে আপনারা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ুন। বাংলার প্রতিটি ঘরকে স্বাধিকারের এক একটি দূর্গে পরিণত করে দেখিয়ে দিন বাঙালিকে পায়ের নিচে দাবিরে রাখার শক্তি পৃথিবীতে কারো নেই।’ আর এই ‘দাবিয়ে রাখা’ ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে ‘দাবায়ে রাখবার পারবা না’ হয়ে উঠে এসেছিল। এ ভাষণের অন্তরজুড়ে রয়েছে একটি দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ দিকেনির্দেশনা ও করণীয়। তিনি ভবিষ্যৎদ্রষ্টার মতোই বলেছেন, ‘সামনে আমাদের কঠিন দিন। আমি হয়তো আপনাদের মাঝে নাও থাকতে পারি। মানুুষকে মরতেই হয়। জানি না, আবার কবে আপনাদের সামনে এসে দাঁড়াতে পারব।
তাই আজ আমি আপনাদের এবং বাঙলার সব মানুষকে ডেকে বলছি, চরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হন বাংলার মানুষ যেন শোষিত না হয়। বঞ্চিত না হয়। বাঙালি যেন আর অপমান-লাঞ্ছিত না হয়। দেখবেন, শহীদের রক্ত যেন বৃথা না যায়, যতদিন বাংলার আকাশ-বাতাস, মাঠ-নদী থাকবে, ততদিন শহীদরা অমর হয়ে থাকবেন। বীর শহীদদের অতৃপ্ত আত্মা আজ দুয়রে দুয়ারে ফরিয়াদ করে ফিরছে; বাঙালি তোমরা কাপুরুষ হইও না। চরম ত্যাগের বিনিময়ে হলেও স্বাধিকার আদায় কর, বাংলার মানুষের প্রতি আমার আহ্বান-প্রস্তুত হোন।’
সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পর সংবিধানসম্মতভাবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। পাকিস্তান রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার কথা ছিল আওয়ামী লীগের। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ১ মার্চের বেতারভাষণে স্থগিত করে দেন আইনপরিষদের সভা। এ যেন বারুদে আগুন ধরিয়ে দেয়া। দুই দশকের বেশি সময় ধরে পশ্চিমপাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলার মানুষকে শোষণ করেছে। দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেয়া পাকিস্তানে ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে কেড়ে নেয়ার অপচেষ্টা হয়েছে।
কিন্তু বায়ান্নের মহান ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা-আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান প্রভৃতির মাধ্যমে বাঙালি জাতি তার দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছে। শেষপর্যন্ত তারা আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে কোণঠাসা করতে পারেনি। কিন্তু শোষণ-বঞ্চনা, নিপীড়ন-নির্যাতন অব্যাহতই ছিল। তারা বাংলার জনগণকে ন্যায্য অধিকার থেকে সবসময় বঞ্চিত রেখেছে। বাংলার জনগণ সবসময় হয়েছে চরম শোষণ-বঞ্চনার শিকার। অবশেষে বাংলার মানুষ মুক্তির জন্যে সব ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত হয়ে গেলো। কারণ পিঠ ঠেকেছে দেয়ালে। এবার সময় হয়ে গেছে এসপার-ওসপার করার। বিভিন্ন তৎপরতায় মুক্তিকামী জনতার অভিব্যক্তি প্রকাশ পেতে শুরু করলো। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারলেন এখন মোক্ষম সময় এসে গেছে। মুক্তির লড়াইয়ে সামিল হতে হবে জাতিকে। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সেই দিকনির্দেশনাই দিয়েছে।
সত্যিকার অর্থে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের শত নিপীড়ন উপেক্ষা করে বীর বাঙালি অস্ত্র ধারণের পূর্বে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে এদিনই স্বাধীনতার ডাক দেয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল… তোমাদের যা কিছু আছ তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।’ আওয়ামীলাগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলারও আহ্বান জানান তিনি। ভাষণে তিনি বলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।’ প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক রেসকোর্সে যখন এ ভাষণ দিচ্ছিলেন ঠিক ওইদিনই ঢাকায় এসে পৌঁছান জেনারেল টিক্কা খান ও রাও ফরমান আলী। তারা গণতান্ত্রিক উপায়ে সমস্যার সমাধান না করে সামরিক কায়দায় বাঙালিদের নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু পাক-শাসকদের মতি-গতি বুঝেই তাই মার্চের ভাষণে স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রস্তুতির জন্যে জাতিকে আহ্বান জানান। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবিতে ৬ মার্চ পর্যন্ত ঘোষিত হরতাল, অসহযোগ আন্দোলন শেষ হওয়ার পরই ৭ মার্চের জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন সকাল থেকেই চারদিক থেকে মানুষের ঢল নামে রেসকোর্স ময়দানে। লাখো মানুষের পদভারে ঢাকা পরিণত হয় উদ্বেলিত নগরে। ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ-বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ স্লোগানে মুখরিত হয় রেসকোর্স ময়দান। মুক্তিপাগল জনতার প্রত্যাশা পূরণ হয় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে। বঙ্গবন্ধু ২২ মিনিটে তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম ভাষণটিতে বাংলার মানুষের প্রাণের দাবির প্রতিধ্বনি করেন। বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যে বঙ্গবন্ধু যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ৭ মার্চের ভাষণে তার সুস্পষ্ট ছাপ রয়েছে।
যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততোদিন এ ভাষণের চেতনা ও আদর্শ আমাদের সবার কাছে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। এ পর্যন্ত অনেকেই বিশ্বের অন্যতম সেরা এ ভাষণের ভিন্ন ভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করেছেন। তবে কাব্যিক ছন্দের এই ভাষণের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্যা কখনই হারায় নি, হারাবেও না। যতদিন স্বাধীনতাযুদ্ধের স্বপ্ন পরিপূর্ণ না হবে, অর্থনৈতিক মুক্তি না আসবে, ততদিন এ ভাষণ জাতিকে প্রেরণা যোগাবে। কারণ বাঙালির জন্যে ঘুরে দাঁড়ানোর এবং পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে যে দেশটির দেখা মেলে, তার অবয়ব তৈরির কাজটি করেছিল ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। আবার সারাবিশ্বের শোষিত-অধিকারবঞ্চিত এবং স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী জনতাকেও এই ভাষণ পথ দেখাবে, প্রেরণা যোগাবে। আর যেহেতু যতদিন বিশ্ব থাকবে, ততোদিন থাকবে শোষিত ও শোষক শ্রেণি; সংগতকারণে ততোদিন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণও প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবে বিশ্বময়।
বঙ্গবন্ধুর সমগ্রজীবনে একটিই ব্রত ছিল, বাঙালি জাতির স্বপ্ন পূরণ করা, বাংলা ও বাঙালির মুক্তির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, এই রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে আমরা বাঙালিরা নির্যাতিত-নিষ্পেষিত হব। তাই এ থেকে জনগণের মুক্তির জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন আন্দোলন-সংগ্রামের পথ। ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারির মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৫৬-এর শাসনতন্ত্রের জন্য আন্দোলন, ’৬২-এর ১৭ সেপ্টেম্বরের শিক্ষা আন্দোলন, ৬৩-এর রবীন্দ্রচর্চা আন্দোলন, ৬৪-এর সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন এবং ৬৬-এর ছয়দফা আন্দোলন, ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই বঙ্গবন্ধুর ছিল একচ্ছত্র নেতৃত্ব।
এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ও বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একাত্তরের ১৬ডিসেম্বর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন আর স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু ছিল বঙ্গবন্ধুর নিত্যসঙ্গী। তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন বহুবার। একাধিকবার ফাঁসির মঞ্চ তৈরি হয়েছিল তার জন্য। বাঙালির প্রতি তার বিশ্বাস ও আস্থা ছিল আকাশচুম্বী। সে জন্যই হাসি মুখে, নির্ভীকচিত্তে মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সবধরনের জুলুম-নির্যাতন বরণ করেছেন তিনি। আমৃত্যু একটি গণতান্ত্রিক, প্রগতিবাদী ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। আমাদের সবার উচিত হবে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নের বাংলাদেশের যথাযথ রূপায়ণে কাজ করে যাওয়া। আর এটিই তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সর্বোত্তম উপায়।
এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ম্লান হওয়ার নয়। তার প্রতি জাতির শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অকৃত্রিম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ নস্যাতের যখন ষড়যন্ত্র চলে, দেশকে যখন গণতন্ত্রের পথ থেকে সরিয়ে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত রাখার অপচেষ্টা হয়, তখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর আজীবন আপসহীন সংগ্রামের জীবনগাথা আমাদের সামনে আলোকবর্তিতা হয়ে থাকে। জুলুম-নির্যাতন উপেক্ষা করে পাকিস্তানি আমলে রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা এবং স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি বারবার বলেছেন আত্মশুদ্ধি ও আত্মবিশ্লেষণের কথা। নীতি-আদর্শ থেকে সরে আসার বিষয়ে বারবার তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে তিনি বলেছেন, ‘ যে কোনো মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়, তারা জীবনে কোনো ভালো কাজ করতে পারে নাই। এ বিশ্বাস আমার ছিল।’ তাঁর এই আদর্শ আমাদের চলার পথের পাথেয় হতে পারে। (চলবে)
পূর্বকোণ/এএ