চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

টেকসই রোগীকেন্দ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা গঠনের কৌশলগত দৃষ্টি : কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা

টেকসই রোগীকেন্দ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা গঠনের কৌশলগত দৃষ্টি : কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা

ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন

১১ ডিসেম্বর, ২০২৫ | ৭:৩৮ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশ তার স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিকাশের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, কিন্তু আমাদের মেডিকেল শিক্ষা কাঠামো এখনো অতিমাত্রায় চিকিৎসককেন্দ্রিক, সেকেলে ও অসম্পূর্ণ। প্রতিবছর প্রায় ১ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য আবেদন করেন, কিন্তু সুযোগ পান মাত্র সাড়ে ১২ হাজারের মতো। বিশালসংখ্যক, প্রায় ৯০ হাজার যোগ্য, পরিশ্রমী ও স্বাস্থ্যসেবায় আগ্রহী শিক্ষার্থী কোনো বিকল্প পথ না পেয়ে সম্পূর্ণভাবে শিক্ষাচক্রের বাইরে পড়ে যান।

 

এই বিশাল মানবসম্পদ আজও অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। অথচ একই বাংলাদেশে দক্ষ নার্স, ফিজিওথেরাপিস্ট, রেডিওগ্রাফার, ল্যাব টেকনোলজিস্ট, রেডিয়েশন থেরাপিস্ট, নিউট্রিশনিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, প্যারামেডিকস প্রভৃতি সহযোগী স্বাস্থ্যকর্মীর মারাত্মক সংকট বিদ্যমান। এই বৈপরীত্য শুধুমাত্র স্বাস্থ্যসেবায় জটিলতা বাড়ায় না, বরং ডাক্তারদের উপর অপ্রয়োজনীয় চাপ বাড়ায়, রোগীসেবার মান কমিয়ে দেয়, এবং চিকিৎসাব্যবস্থাকে অদক্ষ করে তোলে। এই বাস্তবতাকে সামনে রেখে আজ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিক সংস্কার এবং একটি জাতীয় সহযোগী স্বাস্থ্যকর্মী উন্নয়ন কাঠামো গঠন। এখানে কিছু প্রস্তাবনা ও বিশ্লেষণ পেশ করছি।

 

পর্ব ১: মেডিকেল শিক্ষাকাঠামোর সীমাবদ্ধতা : ১. ভর্তিপ্রক্রিয়া অতি সংকীর্ণ ও মুখস্থনির্ভর বর্তমান ভর্তিপ্রক্রিয়া সম্পূর্ণ নির্ভরশীল পরীক্ষার নম্বরের ওপর। মানবিক গুণাবলী- যেমন সহানুভূতি, যোগাযোগ দক্ষতা, নেতৃত্ব, দলগত কাজের মনোভাব, কোথাও মূল্যায়িত হয় না। অথচ চিকিৎসা একটি মানবসেবামূলক পেশা, যেখানে একাডেমিক মেধার পাশাপাশি মানসিক দৃঢ়তা, ধৈর্য ও নৈতিকতা সমান গুরুত্বপূর্ণ। ২. পেশাগত সচেতনতার অভাব : অনেক শিক্ষার্থী পরিবার বা সামাজিক চাপের কারণে চিকিৎসা পেশা বেছে নেয়। বাস্তব কর্মপরিবেশ সম্পর্কে তাদের জ্ঞান সীমিত হওয়ায় পরবর্তী সময়ে হতাশা, পেশার প্রতি অনাগ্রহ এমনকি কর্মক্ষেত্রে অপেশাদার আচরণ দেখা যায়। ৩. বাস্তব অভিজ্ঞতার সংকট : ভর্তি-পূর্ব কোনো হাসপাতালে শ্যাডোয়িং, কমিউনিটি সার্ভিস বা স্বাস্থ্যখাতের বাস্তব পরিস্থিতির সাথে পরিচিতি, এসব কিছুর কোনো কাঠামো নেই। ফলে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও পেশার বাস্তবতার মধ্যে বড় বিভাজন তৈরি হয়। ৪. মুখস্থনির্ভর শিক্ষা : প্রশ্নোত্তরমুখী ভর্তির পদ্ধতি সমালোচনামূলক চিন্তা, সমস্যা সমাধান, ক্লিনিক্যাল যুক্তি, এসব দক্ষতার বিকাশে বাধা দেয়।

 

পর্ব ২: কৌশলগত সংস্কার, যা এখনই জরুরি : ১. সমন্বিত ভর্তি মানদণ্ড প্রবর্তন- স্ট্রাকচার্ড ইন্টারভিউ, পারসোনাল স্টেটমেন্ট, অ্যাপটিটিউড টেস্ট (যেমন MCAT/UCA মডেল), কমিউনিটি সার্ভিস ও নেতৃত্ব অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন, এগুলো শিক্ষার্থীদের মানবিক গুণাবলী ও পেশাগত উপযুক্ততা মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ২. ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং ও প্রি-মেডিকেল ওরিয়েন্টেশন চালু : ভর্তি-পূর্ব শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পর্কে বাস্তব ধারণা দেওয়া জরুরি। ‘স্টুডেন্ট শ্যাডোয়িং প্রোগ্রাম’ চালু করা গেলে শিক্ষার্থীরা চিকিৎসাপেশার প্রকৃত চিত্র সম্পর্কে সচেতন হবে। ৩. মনস্তাত্ত্বিক মূল্যায়ন: স্বাস্থ্যসেবা একটি চাপপূর্ণ ক্ষেত্র, তাই mental resilience বা মানসিক প্রস্তুতি মূল্যায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। ৪. সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন : চিকিৎসাকে কেবল মর্যাদা ও আয়ের উৎস নয়Íবরং মানবসেবার আহ্বান হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে। পরিবার, শিক্ষক এবং সমাজকে এই পরিবর্তনে ভূমিকা নিতে হবে।

 

পর্ব ৩: দক্ষ সহযোগী স্বাস্থ্যকর্মী গঠনের জাতীয় কাঠামো : একটি আধুনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা কখনোই শুধুমাত্র ডাক্তার দিয়ে পরিচালিত হতে পারে না। রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা, পুনর্বাসন, সার্জারি, ক্যানসার চিকিৎসা, ইমেজিং, মাঠ-পর্যায়ের জরুরি সেবাÍসবকিছুতেই সহযোগী স্বাস্থ্যকর্মীর অপরিহার্য ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে নার্সের সংকট, ল্যাব টেকনোলজিস্টের সংকট, রেডিওলজির টেকনোলজিস্টের সংকট, রেডিয়েশন থেরাপি টেকনোলজিস্টের সংকট, ফিজিও/অকুপেশনাল থেরাপিস্টের ঘাটতি, নিউট্রিশনিস্ট, সাইকোলজিস্ট, ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্টের অভাব, মেডিকেল আইটি ও হেলথকেয়ার ম্যানেজমেন্টে দক্ষ লোকের ঘাটতি সবই প্রকট। অথচ প্রতি বছর ৯০,০০০ অনির্বাচিত শিক্ষার্থী-এই সংকট দূর করার বিশাল সুযোগ।

 

তাই দরকার: ‘জাতীয় সহযোগী স্বাস্থ্যকর্মী উন্নয়ন পুল’ প্রতিষ্ঠা, এমবিবিএস ভর্তি ফলাফলের পরে অনির্বাচিত প্রার্থীদের বিভিন্ন সহযোগী স্বাস্থ্যপেশায় ভর্তির সুযোগ, আলাদা ভর্তিপরীক্ষা ছাড়াই একটি একক কেন্দ্রীয় পুল, পেশাভিত্তিক আসন সংখ্যা নির্ধারণ, আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ, প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট আধুনিকীকরণ, বিদ্যমান নার্সিং ও প্যারামেডিকেল ইনস্টিটিউটগুলোকে উন্নীত করে ‘সহযোগী স্বাস্থ্য কলেজ’ করা, WHO, IAEA International Society of Radiographers & Radiological Technologists (ISRRT) –এর মান অনুযায়ী পাঠ্যক্রম, সিমুলেশন ল্যাব, ডিজিটাল ইমেজিং প্রশিক্ষণ, রেডিয়েশন পরিকল্পনা সুবিধা, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে উন্নয়ন, প্রণোদনা তৈরি, বৃত্তি ও স্টাইপেন্ড, ক্যারিয়ার গ্রোথ, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, সম্মানজনক পেশাগত পরিচয় নির্মাণ।

 

পর্ব ৪: প্রস্তাবিত রোডম্যাপ (১-১০ বছর) : বছর ১-নীতি উন্নয়ন, মেডিকেল শিক্ষা সংস্কার টাস্কফোর্স, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, DGHS, UGC, BMDC -সমন্বিত উদ্যোগ। বছর ২-৩ পাইলট প্রকল্প, ৫টি বিভাগে সহযোগী স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, প্রি-মেডিকেল ওরিয়েন্টেশন চালু, বছর ৪-৬ জাতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন, নতুন ভর্তি মানদণ্ড, ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং বাধ্যতামূলক

 

স্ট্যান্ডার্ডাইজড অ্যাপটিটিউড টেস্ট চালু। বছর ৭-১০ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, WHO, IAEA–এর মানদণ্ড পূরণ, আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে কৌশলগত সহযোগিতা, বিদেশে কর্মসংস্থান ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির সুযোগ।

 

কেন এখনই এই রূপান্তর দরকার? ১. রোগীসেবার মানোন্নয়ন, দক্ষ সহযোগী স্বাস্থ্যকর্মী রোগীসেবা দ্রুত, নিরাপদ ও মানবিক করে। ২. ডাক্তারদের কর্মচাপ হ্রাস দলগত কাজের মাধ্যমে ডাক্তাররা রোগ নির্ণয়, গবেষণা ও জটিল সিদ্ধান্তে বেশি মনোযোগ দিতে পারবেন। ৩. আন্তর্জাতিক দক্ষতার সাথে প্রতিযোগিতা বিশ্বমানে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীরা দেশের জন্য সম্মান ও অর্থ Í উভয়ই বয়ে আনবে। ৪. টেকসই স্বাস্থ্যব্যবস্থা সুষম মানবসম্পদ বণ্টনের মাধ্যমে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও কার্যকর স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিত হবে।

 

উপসংহার : বাংলাদেশে মেডিকেল শিক্ষা সংস্কারের লক্ষ্য বেশি ডাক্তার তৈরি করা নয়, বরং একটি সমন্বিত, মানবিক, দক্ষ ও রোগী-কেন্দ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা। যদি আমরা ভর্তি প্রক্রিয়ায় মানবিক মূল্যবোধকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি এবং ৯০ হাজার অনির্বাচিত শিক্ষার্থীকে দেশের সহযোগী স্বাস্থ্যখাতে সুশৃঙ্খলভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশ স্বাস্থ্যখাতে এক নতুন যুগের সূচনা করতে পারে। যেখানে- প্রত্যেক যোগ্যশিক্ষার্থী নিজের স্থান খুঁজে পাবে। প্রত্যেক রোগী পাবে বিশ্বমানের সেবা। এবং বাংলাদেশ গড়ে তুলবে একটি আধুনিক, টেকসই ও দক্ষ স্বাস্থ্যসেবা দল।

ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, সেইন্টজন রেজিওনাল হসপিটাল, নিউব্রান্সউইক; এসিস্টেন্ট প্রফেসর, ডালহাউসী ইউনিভার্সিটি, কানাডা।

 

পূর্বকোণ/এএইচসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট