
জুলাই আন্দোলনে সরকার পতনের পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে এ বছরের ১ নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে কমবেশি ৪৭৬টি ঘটনায় অন্তত ১০৭৩ জন গণমাধ্যমকর্মী হামলা, মামলা, হত্যা, হুমকি, হয়রানি, কারান্তরিন, পরিবারের সদস্যদের ওপর হামলা, বাসা বা সম্পত্তি নষ্ট করাসহ চাকুরিচ্যুতি, চাকরি থেকে অব্যাহতি কিংবা বরখাস্ত হয়েছেন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রকাশিত প্রবন্ধে এ চাঞ্চল্যকর তথ্য তুলে ধরা হয়।
আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস-২০২৫ উপলক্ষে মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর)ে ধানমন্ডির মাইডাস ভবনের টিআইবি কার্যালয়ে ‘কর্তৃত্ববাদ পতন-পরবর্তী বাংলাদেশের গণমাধ্যমের পরিস্থিতি’ শীর্ষক আলোচনায় গণমাধ্যমসূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন ডেপুটি কো-অর্ডিনেটর জাফর সাদিক।
তিনি জানান, এই সময়ের মধ্যে ২৫৯টি ঘটনায় ৪৫৯ জন গণমাধ্যমকর্মী হামলার শিকার হয়েছেন। ৮৯টি ঘটনায় ৯৯ জনকে নানা হুমকি দেওয়া হয়েছে। ৩০টি ঘটনায় ৭০ জনকে হয়রানি করা হয়েছে। ১৯টি ঘটনায় অন্তত ২৭ জনকে আটক করা হয়েছে। ০৯ টি ঘটনায় ১৭ জন পরিবারের সদস্য হামলার অথবা বাড়িঘর ধ্বংসের শিকার হয়েছেন। ৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে, ৫টি ঘটনায় ১৮৯ জন সাংবাদিককে চাকুরিচ্যুত, দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি কিংবা বরখাস্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, “কর্তৃত্ববাদের পতন পরবর্তী সময়ে আশা করা হয়েছিল, গণমাধ্যমের জন্য এক ধরনের উন্মুক্ত পরিবেশ ও অবাধ সাংবাদিকতার পথ উন্মুক্ত হবে। পূর্বতন নেতিবাচক চর্চার ধারাবাহিকতা বন্ধ হবে, কিংবা হ্রাস পাবে। কিন্তু বিগত ১৬ মাসের বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলছে। বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশ ১৬ ধাপ এগিয়ে ১৪৯তম হলে, এতে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, এখনো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং পূর্বে বিরাজমান নেতিবাচক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করা যায়নি, এমনকি কিছু সম্ভাবনা দেখা গেলেও তা নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে।”
মূল প্রবন্ধে তিনি আরও বলেন, “২০২৪ এর ৫ আগস্টের পর পূর্বের ধারাতেই গণমাধ্যমের ব্যবস্থাপনা পর্ষদসহ, উচ্চ পদধারী সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের রাতারাতি বদল ঘটে যায়। বিদ্যমান বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় এই বদল হয় বলে জানা যায়। এসময় কমপক্ষে আটটি সংবাদপত্রের সম্পাদক এবং ১১টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের বার্তা প্রধানকে বরখাস্ত করা হয়েছে বা ‘পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ সরকার পরিবর্তনের পরপরই নিজ থেকেই চাকরি থেকে সরে গেছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমের নির্বাহী সম্পাদক, প্রধান বার্তা সম্পাদক এবং বার্তা সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতেও পরিবর্তন এসেছে।”
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে তিনি জানান, এসময় অন্তত ২৯টি গণমাধ্যমের শীর্ষ পদগুলোতে বিভিন্ন রদ-বদল এবং একটি অনলাইন পোর্টালের মালিকানায় বদল এসেছে। অনেকক্ষেত্রেই এই পরিবর্তনগুলি সবসময় স্বচ্ছভাবে হয়নি। এই পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক ক্ষেত্রেই মালিকপক্ষ বা নতুন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে চেষ্টা করছে। উদাহরণস্বরূপ– ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের মালিকানাধীন নিউজ টোয়েন্টি ফোর, কালের কণ্ঠ, ডেইলি সান, বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে এবং দৈনিক জনকণ্ঠ, একাত্তর, ডিবিসি ও সময় টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পর্ষদ, সম্পাদক, প্রধান বার্তা সম্পাদক, প্রধান প্রতিবেদকসহ বিভিন্ন পদে কর্মরত আগের সাংবাদিক ও কর্মকর্তাদের সরিয়ে দলীয় রাজনীতির প্রভাব-সংশ্লিষ্ট অনেক সংবাদকর্মী ও ব্যক্তি যুক্ত হন।
এতে আরও বলা হয়, কর্তৃত্ববাদী শাসনকালে সরকারি দলের নেতা এবং তাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও সাংবাদিকদেরকেই গণমাধ্যমের নিবন্ধন দেওয়া হয়। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন পুরোনো এ ধারার বদলে বাংলাদেশ গণমাধ্যম কমিশনের মাধ্যমে সব ধরনের নিবন্ধন ও যাচাইয়ের কার্যক্রম পরিচালনার সুপারিশ করে। কিন্তু এবছরের মাঝামাঝি পুরোনো প্রক্রিয়াতেই নেক্সট টিভি এবং লাইভ টিভি নামে আরো দুটি নতুন টেলিভিশন চ্যানেল অনুমোদন দিয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়। টিভি দুটির লাইসেন্স পেয়েছে গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের একাংশকে নিয়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটির দুইজন নেতা- যাদের মধ্যে একজন আবার পরবর্তীতে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিরও নেতা। এ ছাড়া বন্ধ করে দেওয়া চ্যানেলগুলোর মধ্যে চ্যানেল ওয়ান আবার কার্যক্রম শুরু করেছে, দিগন্ত টিভি কার্যক্রম শুরুর প্রক্রিয়ায় আছে। আমার দেশ পুনরায় প্রকাশিত হচ্ছে। এর বাইরে স্টার টিভি (পূর্বে সাম্পান টিভি নামে নিবন্ধনপ্রাপ্ত) নামে আরেকটি টেলিভিশন সম্প্রচারের অপেক্ষায় আছে। মাঝে গ্রিন টেলিভিশন বন্ধ হয়ে গেলেও গত অক্টোবর থেকে পুনরায় সম্প্রচারে এসেছে।
সব মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে ৩২৭০টি সংবাদপত্র ও সাময়িকী রয়েছে; এর মধ্যে ঢাকায় ১৩৭১টি এবং ঢাকার বাইরে ১৮৯৮টি। বেসরকারি টেলিভিশন রয়েছে ৫০টি, যার মধ্যে সম্প্রচারে রয়েছে ৩৪টি। অর্থাৎ বিটিভিসহ সরকারি- বেসরকারি টেলিভিশন রয়েছে ৫০টিরও বেশি। নিবন্ধিত অনলাইন নিউজপোর্টাল রয়েছে– ৪০৬টি; এর মধ্যে ২১৩টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল আর ১৯৬টি পত্রিকার অনলাইন পোর্টাল। এর বাইরে ২৮টি অনুমোদিত এফএম চ্যানেল থাকলেও সম্প্রচার কার্যক্রম চালাচ্ছে ১৯টি বেসরকারি রেডিও।
পূর্বকোণ/আরআর/পারভেজ