চট্টগ্রাম বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে এশিয়ার বিপুল বিনিয়োগের সুপ্ত সম্ভাবনা
প্রভা হেলথের সিইও সিলভানা কাদের সিনহা। ছবি: সংগৃহীত

ফোর্বসের নিবন্ধ

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে এশিয়ার বিপুল বিনিয়োগের সুপ্ত সম্ভাবনা

অনলাইন ডেস্ক

১৫ এপ্রিল, ২০২৫ | ৮:৩২ অপরাহ্ণ

দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ বাংলাদেশ। এই দেশের জনসংখ্যা ১৮ কোটিরও বেশি। বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর বাংলাদেশ অন্যতম। ভারতের চেয়ে ধারাবাহিকভাবে মাথাপিছু জিডিপি বেশি হওয়ায়; বাংলাদেশ ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৫তম বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এই প্রবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে- যুব জনসংখ্যা, সম্প্রসারিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং দ্রুত নগরায়ণ।

 

অস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভূত বিখ্যাত পরামর্শক ও শিক্ষাবিদ পিটার ড্রকার বলেছিলেন, ‘জনমিতিই ভবিষ্যত নির্ধারণ করে।’ আজ যারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছেন, তাদের সামনে রয়েছে এক বিরল সুযোগ। আইএমএফের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৬ সালে বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশেরও বেশি হবে।

 

প্রভা হেলথের সিইও সিলভানা কাদের সিনহা জানান, ১৯৫৪ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তানের অধীনে ছিলো। ওই সময় আমার দাদা হামিদুর রহমান সিনহা একটি ওষুধ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। কোম্পানিটির নাম ছিলো একমি ল্যাবরেটরিজ। আর এই প্রতিষ্টান এই দেশের সবচেয়ে পুরানো ও বর্তমানে অন্যতম সফল প্রতিষ্ঠান। কোম্পানিটি এখন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত। ১৯৫০-এর দশকে বাংলাদেশের আঞ্চলিক বাজারে প্রায় ৮০ শতাংশ ওষুধই ভেজাল ছিল। অনেক আমদানি করা ওষুধ ছিলো ব্যয়বহুল।

 

তবে আজ ওষুধ শিল্প বাংলাদেশে দ্রুত বর্ধনশীল একটি খাত এবং এই অঞ্চলের সবচেয়ে গতিশীল ওষুধ খাতগুলোর মধ্যে একটি। বাংলাদেশ এখন বিশ্বব্যাপী ওষুধ উৎপাদনে ৬ষ্ঠ বৃহত্তম দেশ। এটি স্থানীয় উৎপাদনের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করে। এই বিষয়টি বাংলাদেশকে কয়েকটি উদীয়মান অর্থনীতির মধ্যে একটিতে পরিণত করেছে, যারা ওষুধ উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশি ওষুধ কোম্পানিগুলো ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৫০ টিরও বেশি দেশে রপ্তানি করে।

 

তিনি জানান, দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি পরিবার মধ্যবিত্ত ও বিত্তবান শ্রেণিতে উন্নীত হওয়ায় উন্নত স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা বাড়ছে। ২০১০ সাল থেকে স্বাস্থ্য খাত ১০ শতাংশেরও বেশি সিএজিআর বা চক্রবৃদ্ধি বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হারে বাড়ছে, যা দেশের মোট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চেয়ে বেশি। সামাজিক উন্নয়নের সূচকগুলোতে বাংলাদেশ এই অঞ্চলের অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে ভালো করছে, যা সরকারি ব্যবস্থার কার্যকারিতা প্রতিফলিত করে।

 

উল্লেখযোগ্যভাবে, দেশের স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৭৫ শতাংশের বেশি আসে বেসরকারি খাত থেকে, যা ভোক্তার আচরণে পরিবর্তন এবং বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের জন্য সুযোগের বিশালতাকে তুলে ধরে। এমনকি ৩৭ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের প্রথম পর্যায়ে বেসরকারি ব্যবস্থাকে বেছে নিচ্ছে।

 

তবে, বিদ্যমান স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো- প্রতি হাজার জনে মাত্র একটি শয্যা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশের চেয়ে কমসংখ্যক দক্ষ স্বাস্থ্যসেবা পেশাদার- ক্রমবর্ধমান চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এই অবস্থায় যারা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করতে চান, তারা একেবারে প্রথম থেকেই শুরু করতে পারেন।

 

তিনি আরও জানান, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগের এখনই উপযুক্ত সময়। মানসম্পন্ন সেবার একটি সুস্পষ্ট চাহিদা পূরণে বিনিয়োগকারীরা এখনো একেবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকেই বিনিয়োগ শুরু করতে পারেন। সরকারও বিদেশিদের কাছে এখানে বিনিয়োগ আকর্ষণীয় করে তুলছে।

 

বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের তুলনায় কম এবং ২০৪০ সালের মধ্যে এটি দ্বিগুণ হবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।

 

গত দুই দশকে হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা ছয়গুণ বেড়েছে এবং আরও অনেক বেশি সুযোগ রয়েছে, বিশেষ করে যারা মানকে প্রাধান্য দেয় তাদের জন্য। রোগীরা ক্রমশ মানকে প্রাধান্য দিচ্ছে এবং সচেতন হচ্ছে। বাংলাদেশে এবং অনেক নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে মানুষের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ শুধু দারিদ্র্য নয়, স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মানেরও অভাব। এসব দেশে আরও মৌলিক মানের অবকাঠামোতে বিনিয়োগের প্রয়োজন—ক্লিনিক, ল্যাব, হাসপাতাল, প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এবং আরও অনেক কিছু।

 

স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোতে বিনিয়োগ কেবল জরুরি প্রয়োজনগুলোই সমাধান করে না, বরং উল্লেখযোগ্য আর্থিক মুনাফারও প্রতিশ্রুতি দেয়। এশিয়াজুড়ে স্বাস্থ্যসেবা খাতে বিলিয়নিয়ারের উত্থান থেকে এটি প্রমাণিত। একটি ভালো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তৈরি করা কেবল জনস্বাস্থ্যের জন্যই ভালো নয়, এটি একটি স্মার্ট আর্থিক বিনিয়োগও।

 

অবকাঠামো ছাড়াও, বিনিয়োগকারীদের উচিত ওষুধ, ওষুধ তৈরি, এপিআই (কাঁচামাল) উৎপাদন এবং বায়োটেকের (জৈবপ্রযুক্তি) দিকে নজর দেওয়া। বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্পের জন্য শতভাগ বিদেশি মালিকানা এবং কর ছাড়ের মতো প্রণোদনা দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করছে।

 

বর্তমানে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশের স্বাস্থ্য বিমা রয়েছে। এই পরিসংখ্যান স্বাস্থ্য বিমা খাতে এক বিশাল, অব্যবহৃত বাজারের নির্দেশক। ব্যাপক স্বাস্থ্য বিমা প্রকল্প তৈরি করা চিকিৎসা ব্যয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত আর্থিক ঝুঁকি কমাতে এবং স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ বাড়াতে পারে।

 

বাংলাদেশের ডিজিটাল স্বাস্থ্য বাজার এরই মধ্যেই ১০ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আগামী বছরগুলোতে এই বাজার প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

 

প্রযুক্তি কেবল স্বাস্থ্যসেবার ভবিষ্যৎ নয়, বর্তমান। এটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালকে ত্বরান্বিত করছে, ওষুধ কোম্পানি ও সরবরাহকারীদের পথ সুগম করছে, দূরবর্তী পর্যবেক্ষণের (টেলিমেডিসিন ইত্যাদি) মাধ্যমে চিকিৎসা প্রাপ্তি সহজ করছে এবং দেশজুড়ে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ সম্প্রসারিত করছে।

 

ডিজিটাল অ্যাকসেস সমান্তরালভাবে বাড়ছে। ২০২২ সালে যেখানে বাংলাদেশি পরিবারগুলোর ইন্টারনেট ব্যবহারের হার ৩৮ শতাংশ ছিল, ২০২৪ সালে তা বেড়ে ৫০ শতাংশ হয়েছে। একই সময় ব্যক্তিগত ব্যবহার ৩৭ শতাংশ থেকে ৪৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

 

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত আজ এশিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে একটি। উন্নত সেবা পেতে আগ্রহী জনসংখ্যা, বেসরকারি অংশগ্রহণকে উৎসাহদানকারী সরকার এবং চাহিদা ধারাবাহিকভাবে সরবরাহের চেয়ে বেশি হওয়ায়, এটি এক বিশাল সুযোগের মুহূর্ত। বিনিয়োগকারীদের এই বাজারে আগেভাগে প্রবেশের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের ভবিষ্যৎ গঠন এবং যুগান্তকারী ব্যবসা গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে।

 

পূর্বকোণ/পারভেজ

 

শেয়ার করুন