আজ ২১ রমজান; ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের দিন। আজ থেকে রমজানের ৩য় দশক নাজাত পর্বের মেহনত শুরু হলো। মক্কা বিজয় ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গৌরবজনক অধ্যায়। মক্কা হল পৃথিবীর প্রাচীনতম নগরী ও আধ্যাত্মিক কেন্দ্র; যা আবাদ করেছিলেন সাইয়েদুনা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও তদীয় পুত্র হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মস্থান মক্কায় ইসলামের রাজনৈতিক বিজয় সূচিত হয় ৮ম হিজরীর পবিত্র রমজান মাসে। রমজানুল মোবারকের ১০ তারিখ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনাতুল মুনাওয়ারাহ হতে ১০ হাজার সাহাবীর বিশাল বহর নিয়ে মক্কা অভিমূখে যাত্রা করেন। নবীজীর যাত্রাপথ ছিল উত্তপ্ত বালুকাময়; বন্ধুর। মরুভূমির তীব্রতায় ছিল না কোন উপযোগী সমরাস্ত্র, সেনা ছাউনী কিংবা যানবাহন। ২৮০ মাইলের পথ পাড়ি দিয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কার সন্নিকটে ‘মার-উয-যাহরান’ নামক গিরি উপত্যকায় যাত্রা বিরতি করেন।
এখানে সন্ধ্যায় হাজার হাজার লন্টন জ্বালানো হলে অদূরে মক্কাবাসী তা দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। মক্কার কুরাইশ সরদার আবু সুফিয়ান তার দুই সহচরসহ উপত্যকায় গুপ্তচরবৃত্তি করতে এসে সাহাবীদের হাতে ধরা পড়ে যান। সাহাবীগণ তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে গেলে এক পর্যায়ে তিনি ইসলাম ধর্ম কবুল করেন। মহানবীর চৌকস রণ কৌশলে পরদিন সাহাবীগণ অনেকটা বিনা বাধায় বিজয়ী বেশে মক্কা নগরীতে প্রবেশ করেন। উপমহাদেশের খ্যাতনামা ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভীর ‘নবীয়ে রহমত’ নামক অনন্য সীরতগ্রন্থের আলোকে দিনটি ছিল ২১ রমজান; শুক্রবার।
মক্কা বিজয়ের সত্যায়নে আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তাঁর রসূলকে সত্য স্বপ্ন দেখিয়েছেন, আল্লাহ চাহেন তো তোমরা অবশ্যই মসজিদে হারামে প্রবেশ করবে নিরাপদে মস্তক মুন্ডন অবস্থায় এবং কেশ কর্তিত অবস্থায়। তোমরা কাউকে ভয় করবে না। অত:পর তিনি জানেন, যা তোমরা জানো না। এছাড়া তিনি দিয়েছেন তোমাদের একটি আসন্ন বিজয়। তিনিই তাঁর রসূলকে হিদায়াত ও সত্যধর্মসহ প্রেরণ করেছেন। যাতে একে অন্য সমস্ত ধর্মের উপর জয়যুক্ত করেন। সত্য প্রতিষ্ঠাতারূপে আল্লাহই যথেষ্ট” (আল-কুরআন,সূরাতুল ফাত্হ-২৭-২৮)।
মহানবী মক্কা শহরে প্রবেশ করেই বায়তুল্লাহ শরীফের দিকে রওয়ানা হন আর আদেশ দেন কা‘বা শরীফকে ৩৬০টি মূর্তি থেকে পবিত্র করার জন্য এবং সে আদেশ অতি দ্রুত কার্যকর হয়। কারণ নবীর বাণী হলো, ‘বুয়িছতু লি কাছরাতিল আছনাম’- ‘আমি প্রেরিত হয়েছি মূর্তি ভাঙ্গার জন্যেই’। মূর্তি অপসারিত হলে নবীজী কা‘বা শরীফে ঢুকে সালাত আদায় শেষে উপস্থিত মক্কাবাসীদের উদ্দেশ্য করে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন।
তিনি বলেন, ‘তোমাদের বিরুদ্ধে আজ আর আমার কোন অভিযোগ নেই। যাও, তোমরা মুক্ত। মনে রেখ, সর্বপ্রকার গর্ব-প্রতিহিংসা ও রক্তপণ আমার দুই পদতলে। কেবল কা‘বার অভিভাবকত্ব ও পানি পানের বিষয় এর ব্যতিক্রম। ওহে কুরাইশ সম্প্রদায়! জাহিলি যুগের গর্ব ও বংশ গৌরব আল্লাহ নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। সমস্ত মানুষ আদম সন্তান আর আদম মাটি থেকে সৃষ্ট’। এ প্রসঙ্গে কবি গোলাম মোস্তফা তার ‘বিশ্বনবী’ গ্রন্থে চমৎকার মন্তব্য করেন, ‘কত সুন্দর-কত অদ্ভূত এ বিজয়! রক্তপাত নাই! ধ্বংস বিভীষিকা নাই! প্রেম দিয়া, পূণ্য দিয়া, ক্ষমার মধ্য দিয়া এ বিজয় সূচিত হইলো।’
সত্যিই মহানবীর মক্কা বিজয় দেশ বিজয় নয়, একটি আদর্শের বিজয়। এ বিজয়ে প্রমাণিত হল ইসলাম সত্য ধর্ম। ইসলাম ধর্মে মূর্তি-ভাস্কর্যের কোন স্থান নেই। এ ধর্মে অত্যাচার-অবিচারের পর বিজয় অনিবার্য।
পূর্বকোণ/ইব