১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে ভুলে গেলে চলবে না বলে মনে করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পাশাপাশি তিনি মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের বক্তব্য প্রত্যাহার করা উচিত। তিনি বলেন, ‘দয়া করে রাজনৈতিক দলগুলোকে বা রাজনীতিকে আপনাদের প্রতিপক্ষ বানাবেন না।’
শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) বিকালে শহীদ বুদ্দিজীবী দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই মন্তব্য করেন। রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিএনপির আয়োজনে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। শনিবার (১৪ ডিসেম্বর) বুদ্ধিজীবী দিবসের দিন সকাল ১১টায় বিএনপির নেতারা মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন।
রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করার চেষ্টা করছে বলে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম যে বক্তব্যে দিয়েছেন তার প্রতিক্রিয়ায় মির্জা ফখরুল বলেন, ‘একজন উপদেষ্টা যখন এই কথা বলেন যে, রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য কাজ করছে– এটা ঘোরতর অভিযোগ। আমি এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এ ধরনের উক্তি তার প্রত্যাহার করা উচিত।’
বিএনপি মহাসচিব যোগ করেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোকে বা রাজনীতিকে আপনাদের প্রতিপক্ষ বানাবেন না। রাজনৈতিক দলগুলো আপনাদের সহযোগিতা করছে…। সেখানে আপনি যদি বলেন, এটা ব্যর্থ করার জন্য কাজ করছে…। আমাদের চেয়ারম্যান বলেছেন, আমরা হাজার বার বলেছি, এই সরকার ব্যর্থ হওয়া মানে, জনগণ ব্যর্থ হয়ে যাবে, আমরা ব্যর্থ হয়ে যাবো। তাহলে এ রকম কথা কেনও বলবেন আপনি?’
একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানসহ বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘একাত্তর একটু পেছনে রাখার এখন একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটা আরেকটা ষড়যন্ত্রের অংশ। দেশের মূল ইতিহাস থেকে জাতিকে দূরে সরিয়ে দেওয়া…। এই বিষয়টা নিয়ে আমাদের সজাগ থাকতে হবে।’
বিএনপি মহাসচিব সতর্ক করে বলেন, ‘আমাদের মূল যে ইতিহাস, আজ এই স্বাধীন বাংলাদেশ, এই ইতিহাস নিয়ে এসে আমরা ২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি। সেই ইতিহাস যেন বিকৃত না করি। গত ১৫ বছর ধরে ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, ঠিক তেমনই করে এখন যাতে ইতিহাস বিকৃত না হয়, সে জন্য সবাইকে সজাগ থাকার অনুরোধ করছি।’
নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘যারা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসুন এই শপথ নেই– আমরা নিজেদের গড়ে তুলবো একটি উপযোগী রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেব, গণতন্ত্রের কর্মী হিসেবে এবং বিএনপির একজন কর্মী হিসেবে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘গণতন্ত্রের কথা আমরা বলছি, সেই গণতন্ত্র একটা কথার কথা নয়। এটা একটা কালচার, এটা একটা সংস্কৃতি। আপনি-আমি কীভাবে কথা বলবো, প্রতিবেশির সঙ্গে আমার কেমন কথা বলবো, আমার রাজনীতির প্রতিপক্ষের সঙ্গে কীভাবে কথা বলবো, সেই বিষয়গুলো আমাদের গণতন্ত্রের ভেতর দিয়ে শিখতে হবে।’
‘গণতন্ত্র মানে এই নয় যে, আওয়ামী লীগ করলে তাকে গলা কেটে ফেলো; আর বিএনপি করলে তার মুণ্ডচ্ছেদ করো। গণতন্ত্র হচ্ছে, পরমত সহিষ্ণুতা। তোমার কথা বলার অধিকার আছে, আমার বিরুদ্ধেও কথা বলার অধিকার আছে। আমি সেটাকে রক্ষা করবো এটাই হলো গণতন্ত্র।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এখন সময়টা সবচেয়ে কঠিন। আপনার একটা পদক্ষেপ যদি ভুল হয়, পেছনে পড়ে যাবেন, খাদে পড়ে যাবেন। যদি সঠিকভাবে পা দিতে পারেন, তাহলে সামনে এগিয়ে যাবেন।’
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই দিবসগুলো আপনারা অবহেলা করবেন না, জানার চেষ্টা করবেন। অনেকে জানেই না কী হয়েছিল। ওই দিন কী তালি মারার দিবস, না তালি মারার দিবস না; ওই দিন কি মিলাদ করার দিবস, না খিচুড়ি খাওয়ার দিবস…। আমাদের দেশের সবচেয়ে বরণ্যে ব্যক্তিদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ভালো শিক্ষকদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘তাদের তুলে নিয়ে গেছে। ফ্যাসিস্ট সরকার আমাদেরও তুলে নিয়ে যেতো। আমাদের গুম করে দিতো, ঠিক ওইভাবে তাদের (শহীদ বুদ্ধিজীবীদের) তুলে নিয়ে গেছে। বাসা থেকে নেওয়ার সময়ে জিজ্ঞেস করা হতো, কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। তারা বলতো, কিছুক্ষণ পরে চলে আসবে। এভাবে নিয়ে গেছে। নেওয়ার পর আর ফিরে আসেনি। রায়ের বাজারে তাদের হাত-পা বাধা মরদেহ পাওয়া গেছে। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে, বুদ্ধিজীবীদের কেনও প্রাণ দিতে হলো।’
‘তখনও আয়নাঘরের মতো ঘর ছিল। আয়নাঘরে কেন নিয়ে যাওয়া হয়েছে ছেলেদের? কেনও নিয়ে যাওয়া হয়েছে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের? একটাই উদ্দেশ্য ছিল, ভয় পাইয়ে দেওয়া, শেষ করা, ধবংস করা। কেন? হাসিনার ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে হবে, সে জন্য আয়নাঘরে নিয়ে যাওয়া হতো।’ যোগ করেন মির্জা ফখরুল।
বৃহস্পতিবার লন্ডন থেকে দেশে ফেরা বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘প্রতিটি মুহূর্ত এখন আমাদের সর্তকতার সঙ্গে পা ফেলতে হবে। আমাদের প্রতিটি কথা মেপে বলা দরকার। আমরা এমন কোনও কথা বলবো না যা আমাদের বিজয়কে নষ্ট করে দেয়, অর্জনকে বিনষ্ট করে দেয়।’
বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন– দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, সালাহউদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপ-উপাচার্য্ অধ্যাপক মামুন আহমেদ প্রমুখ।
পূর্বকোণ/আরআর/পারভেজ