বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপসহ বেশ কিছু বিষয়ে আনা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইন প্রশ্নে রুলের ওপর শুনানি শেষ হয়েছে। এ–সংক্রান্ত পৃথক রিটের ওপর কবে রায় হবে, তা আগামীকাল বৃহস্পতিবার জানা যাবে। রায়ের দিন ধার্যের জন্য বিষয়টি আগামীকাল কার্যতালিকায় থাকবে।
শুনানি শেষে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ বুধবার এ সিদ্ধান্ত জানান। পৃথক রিটের ওপর আজ দ্বাদশ দিনে শুনানি শেষ হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আনা পঞ্চদশ সংশোধনী আইন চ্যালেঞ্জ করে গত ১৮ আগস্ট সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি রিট করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট গত ১৯ আগস্ট রুল দেন। রুলে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না—তা জানতে চাওয়া হয়।
ওই রুলে ইন্টারভেনার (আদালতকে সহায়তা করতে) হিসেবে বিএনপি, গণফোরাম, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, সংস্থা, ব্যক্তিসহ বেশ কয়েকজন যুক্ত হন। শুনানিতে রিট আবেদনকারী, বিএনপি, রাষ্ট্রপক্ষ, জামায়াত, গণফোরাম, ব্যক্তি ও সংস্থার পক্ষে তাদের আইনজীবীরা বক্তব্য তুলে ধরেন।
রুলের ওপর গত ৩০ অক্টোবর, ৬ নভেম্বর, ৭ নভেম্বর, ১০ নভেম্বর, ১৩ নভেম্বর, ১৪ নভেম্বর, ২০ নভেম্বর, ২৫ নভেম্বর, ২৭ ও ২৮ নভেম্বর এবং ১ ডিসেম্বর (গত রোববার) শুনানি হয়। গত রোববার শুনানি নিয়ে আদালত আজ বুধবার শুনানির দিন রাখেন।
গত অক্টোবরে পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ১৭টি ধারার বৈধতা নিয়ে নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন একটি রিট আবেদন করেন। এই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ২৯ অক্টোবর হাইকোর্টের একই বেঞ্চ রুল দেন। রুলে আইনের ওই ধারাগুলো কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না—তা জানতে চাওয়া হয়। এই রুলের ওপর আজ শুনানি হয়।
আদালতে রিট আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফিদা এম কামাল ও আইনজীবী এ এস এম শাহরিয়ার কবির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদ উদ্দিন।
বিদ্যমান সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা থাকে না বলে শুনানিতে উল্লেখ করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফিদা এম কামাল। তিনি বলেন, আইন প্রণয়নই সংসদ সদস্যের মূল কাজ। অথচ কালভার্ট বানানো, ম্যানেজমেন্ট কমিটি ইত্যাদি বিষয়ে কনসার্ন দেখা যায়। জনগণ সার্বভৌম হলেও তাদের আশা–আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখা যায় না। এক রায়ে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদে ৭০ শতাংশ সংসদ সদস্য ব্যবসায়ী। এখানে অর্থই চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
ফিদা এম কামাল বলেন, এক কোটি দুই কোটি টাকা সুদহীন দেওয়া হবে, চলে আসো—এমন লোক সংসদ সদস্য হন। জনগণ কি অর্থ পায়? হয়তো কয়েক দিনের বাজারের টাকা। যিনি এক, দুই বা পাঁচ কোটি টাকা খরচ করবেন, তিনি ৫০ কোটি টাকা উঠিয়ে নেবেন। এ জন্য ভদ্রলোকেরা আসতে পারছেন না। অতীতে চিকিৎসক, স্কলার, শিক্ষক ও আইনজীবীরা সংসদ সদস্য হতেন। ৭০ শতাংশ ব্যবসায়ী, এটি অকল্পনীয়। সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোট বাধ্যতামূলক হলেও পঞ্চদশ সংশোধনীর ক্ষেত্রে তা হয়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
রিট আবেদনকারীর অপর আইনজীবী এ এস এম শাহরিয়ার কবির বলেন, ১৯৭৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো উপায় ছিল না সংবিধানে। যে কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। পঞ্চদশ সংশোধনী হচ্ছে আমিত্ব—আমি যা করব তাই, এর বাইরে কিছু হবে না। অর্থাৎ এক ব্যক্তির শাসন কায়েমের জন্য ওই সংশোধনী আনা হয়, যা সংবিধানের মূল চেতনা এবং জনগণের ইচ্ছার পরিপন্থী। বিদ্যমান ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পক্ষেও মত তুলে ধরেন এই আইনজীবী। পাশাপাশি দুটি রিটের ওপর একসঙ্গে রায় দেওয়ার আবেদন রাখেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পাস হয়। ২০১১ সালের ৩ জুলাই এ-সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের অন্তত ১৭টি ধারার বৈধতা নিয়েই মো. মোফাজ্জল হোসেন রিটটি করেন।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপের পাশাপাশি জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়। অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী করে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানও যুক্ত করা হয়। আগে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনে নির্বাচন করার বিধান থাকলেও ওই সংশোধনীতে পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিষয়টি সংযোজন করা হয়।
পূর্বকোণ/আরআর/পারভেজ