দেশের সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে ৪০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা নিবন্ধন ও চালকের হাতে নামমাত্র ফিতে লাইসেন্স প্রদান করা গেলে বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হতে পারে; এমনটাই দাবি করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
সোমবার (২৫ নভেম্বর) সকালে রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে জরুরিভিত্তিতে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ছোট যানবাহন চলাচল নীতিমালা প্রণয়নের দাবিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এই দাবি করেন।
তিনি বলেন, বিগত আওয়ামী লীগের আমলে সারাদেশে ৪০ লাখ ব্যাটারিরিকশা থেকে দৈনিক ১১০ কোটি করে বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়েছে। এই চাঁদাবাজির কারণে রাজধানীর প্রধান সড়কসহ দেশের সকল সড়ক-মহাসড়ক, নগর-বন্দরে ব্যাটারিরিকশার দৌরাত্ম্য বেড়ে চরম আকার ধারণ করেছে।
তিনি আরও বলেন, অবাধে আমদানি, স্থানীয় গেরেজে তৈরি করে সহজে রাস্তায় নামানোর অবাধে সুযোগ থাকায় এবং দেশে সহজে কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় স্বল্পপুঁজিতে লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষ ব্যাটারিরিকশা কিনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছে। প্রশিক্ষণবিহিন লাখ লাখ শ্রমজীবীর হাতে এসব অটোর স্টিয়ারিংয়ের কারণে সড়ক নিরাপত্তায় ভয়ানক ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী, সরকার পরিবর্তনের পরে দেশের সড়ক থেকে ট্রাফিক পুলিশ উঠে গেলে ব্যাটারিরিকশা আরও বেপরোয়া হয়ে রাজধানীসহ দেশের প্রধান প্রধান সড়ক-মহাসড়কে অবাধে চলাচল শুরু করে। এ পরিস্থিতিতে ১৯ নভেম্বর হাইকোর্ট তিনদিনের মধ্যে ঢাকা মহানগরীর সড়কে ব্যাটারিরিকশা চলাচল বন্ধ বা বিধিনিষেধ আরোপের নির্দেশ দেয়। আমরা এই আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য হাইকোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী আরও বলেন, সরকার ২০২১ সালে ‘থ্রি-হুইলার ও সমজাতীয় মোটরযানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা-২০২১’ নামে একটি খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করে। অথচ করোনা সংক্রমণে গণপরিবহন বন্ধের সুবাধে ২০২১-২০২২ সালে ১৬ লাখ ব্যাটারিরিকশা ও ২০ লাখ মোটরসাইকেল রাস্তায় নামে। এসব যানবাহনের কারণে সৃষ্ট যানজট ও দুর্ঘটনা দ্বিগুণ হলেও অদৃশ্য কারণে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় নীতিমালাটি চূড়ান্ত করেনি। ভারত থেকে একচেটিয়া সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মাহিন্দ্রা, অটোটেম্পো, হিউম্যান হলার আমদানি অব্যাহত রাখতে তৎকালীন সরকার এই নীতিমালা থেকে সরে এসেছিল বলে অভিযোগ করে তিনি জরুরি ভিত্তিতে এই নীতিমালা প্রণয়নের দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে কিছু সুপারিশ করা হয়। সেগুলো হলো-
১. যাত্রী কল্যাণ সমিতি, ব্যাটারিচালিত রিকশা মালিক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সাথে আলোচনা করে ‘থ্রি-হুইলার ও সমজাতীয় মোটরযানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা-২০২১’-এর খসড়া নীতিমালা চূড়ান্ত করে গেজেট আকারে প্রকাশ করতে হবে।
২. বুয়েট, চুয়েট, রুয়েট ও সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রতিটি ব্যাটারিচালিত রিকশার বডি মোডিফাই করে ব্রেক ও গতির সমতা এনে সড়ক নিরাপত্তায় ঝুঁকিমুক্ত নিশ্চিত করে সার্টিফাইসহ নিবন্ধন নিতে হবে।
৩. সড়কের সক্ষমতা বিবেচনা করে সিলিং নির্ধারণ করে দেশের সকল সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে, বিআরটিএ’র নিয়ন্ত্রণে তাদের আওতাধীন এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশার নিবন্ধন প্রদান করতে হবে।
৪. প্রতিটি ব্যাটারিচালিত রিকশার চালককে নূন্যতম এক সপ্তাহের মৌলিক প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। প্রশিক্ষণ সমাপ্তকারীদের নামমাত্র ফি নিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানোর ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান করতে হবে। প্রশিক্ষণহীন কোন ব্যক্তি যাতে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে রাস্তায় নামতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. প্রতিটি ব্যাটরিচালিত রিকশায় ট্রাফিক বিভাগের সাথে সংযোগ স্থাপন করে জিপিএস লাগানো বাধ্যতামূলক করতে হবে। জিপিএস ট্যাকিংয়ের মাধ্যমে গতি নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে।
৬. ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা জাতীয় মহাসড়কে চলাচল কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। রাজধানীসহ দেশের শহরগুলোর প্রধান সড়কে ইজিবাইক চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে।
৭. জরুরিভিত্তিতে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও যন্ত্রাংশ আমদানি বন্ধ করতে হবে।
৮. ব্যাটারিচালিত রিকশার ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধে প্রতিটি এলাকার নিবন্ধন প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ ও যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতামত এবং যাত্রী সাধারণের সাথে গণশুনানি করে এলাকাভিত্তিক ভাড়া নির্ধারণ করে দিতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, রিকশা, ব্যাটারিরিকশা, ভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান লিপন, চট্টগ্রাম ইলেকট্রিক থ্রি হুইলার যানবাহন মালিক ও চালক ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. সিদ্দিক মিয়া, চট্টগ্রাম ইলেকট্রিক চার্জার রিকশা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সানাউল্লাহ চৌধুরী, যাত্রী কল্যাণ সমিতির সহ-সভাপতি তাওহীদুল হক, যুগ্ম-মহাসচিব এম মনিরুল হক, প্রচার সম্পাদক মাহমুদুল হাসান প্রমুখ।
পূর্বকোণ/মাহমুদ