প্রথম বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তাঁর স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন স্রেফ একজন গৃহবধূ। বিপদগামী সেনা সদস্যদের হাতে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শহীদ না হলে দেশের মানুষ তাঁকে গৃহবধূ হিসেবেই পেতেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ায় বেগম খালেদা জিয়া নাগরিকদের আহবানে ফিরে আসেন রাজনীতিতে। হাল ধরেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের রূপকার জিয়াউর রহমানের গড়ে তোলা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির। জিয়াউর রহমানের এভারেস্ট চূড়াসম জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে বেগম খালেদা জিয়া দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। তাকে অনেকে তখন
ফিলিপাইনের রাজনৈতিক নেতা কোরাজন অ্যাকুইন’র সাথে তুলনা করে বাংলার কোরোজন বলে সম্বোধন করেন।
তখন ক্ষমতায় জিয়াউর রহমান হত্যাকান্ডের সুবধাভোগী স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তার সহযোগী আওয়ামীলীগ। তলে তলে তার সাথে আওয়ামীলীগ সম্পর্ক বজায় রেখে সুবিধা আদায় করতো। স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে দেশজুড়ে খালেদা জিয়া ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এরশাদ বিরোধী আন্দেলনে তাঁকে বার বার আটক
করা হলেও আন্দোলন থেকে সরে যাননি। আপোষহীন নেত্রীর উপমা পান তিনি। তিনি এরশাদকে হটিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক শাসন পুনরুদ্ধার করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে। রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের মধ্যে
প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে যতগুলি নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, সবগুলোতেই জয়লাভ করেছেন। তাঁর এই জনপ্রিয়তা ও আপোষহীন ভূমিকা বিরোধীদের ভাল না লাগারই কথা । তাই তাঁকে দেশি-বিদেশি ষণড়যন্ত্রকারীরা একহয়ে ক্ষমতার বাইরে রাখতে সচেষ্ট এবং সফল হয়।
এই সুবাধে দেশে দেড় দশকেরও বেশি সময় ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়। খালেদা জিয়ার জীবনের বড় অংশ কাটে কারাগার-বাসা-হাসপাতালে। এভাবে চলছিল তাঁর কষ্টের জীবন।তাঁর বিরুদ্ধে ধারাবাকিভাবে চালানো হয় অপপ্রচার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, সাথে স্রষ্টার কৃপায় দেশনেত্রী আবার ফিরে এলেন দেশ-জনতার কাছে। দীর্ঘদিন পর রাষ্ট্রীয় মঞ্চে দেখা গেল তাকে। একযুগ পর সশস্ত্র বাহিনী দিবসে সেনাকুঞ্জে অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।সেনাকুঞ্জের অনুষ্ঠানে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং খালেদা জিয়া যখন আলাপ করছিলেন সে মুহূর্তে গণবিক্ষোভের মুখে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা ভারতে কী করছিলেন তা জানার উপায় নেই। তবে নিয়তির পরিহাস যে কতোটা নির্মম হতে পারে তা হয়তো শেখ হাসিনা অনুভব করতে পারছেন।
২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচনের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হতে থাকে। এক পর্যায়ে খালেদা জিয়াকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। পরে তিনি নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেলেও কার্যত ছিলেন বন্দি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওপরও শেখ হাসিনার দীর্ঘ স্বৈরতান্ত্রিক শাসনামলের কোপ পড়ে। তাকে প্রথমে
গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অপসারণ করা হয়। সুদখোরসহ নানা উপাধি দিয়ে তার ওপর আক্রমণ শানান শেখ হাসিনা। একপর্যায়ে তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হতে থাকে। আদালতের ‘খাঁচায় বন্দি’ নোবেল জয়ীকে দেখে সারা দুনিয়া।
৫ই আগস্ট গণ অভুত্থানের পর দৃশ্যপটে নাটকীয় পরিবর্তন আসে। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর দ্রুতই মুক্তি মেলে খালেদা জিয়ার। ফ্রান্সে অবস্থানরত ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভাবছিলেন দেশে ফিরে তাকে কারাগারে যেতে হয় কি-না?
কিন্তু মাতৃভূমি থেকে তার ডাক আসে সরকার প্রধান হওয়ার। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং খালেদা জিয়া যখন সেনাকুঞ্জে কুশল বিনিময় করছিলেন তখন অনেকে ভাবছিলেন বছর দুয়েক আগে তাদের নিয়ে শেখ হাসিনার করা একটি মন্তব্যের কথা। সেদিনের বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেছিলেন,“একটি এমডি পদের জন্য পদ্মা সেতুর মতো সেতুর টাকা বন্ধ করেছে,তাকে পদ্মা নদীতে দুইটা চুবানি দিয়ে তোলা উচিত। মরে যাতে না যায়,পদ্মা নদীতে একটু চুবানি দিয়ে সেতুতে তুলে দেয়া উচিত। তাহলে যদি শিক্ষা হয়। পদ্মা সেতুর অর্থ বন্ধ করালো ড. ইউনূস। কেন? গ্রামীণ ব্যাংকের একটি এমডি পদে তাকে থাকতে হবে।”
ওইদিনের বক্তব্যে শেখ হাসিনা আরও বলেন, “খালেদা জিয়া বলেছিল যে, জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানাচ্ছে,কারণ বিভিন্ন স্প্যানগুলো যে বসাচ্ছে, ওটা ছিল তার কাছে জোড়াতালি দেয়া। তো বলছিল,জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানাচ্ছে,ওখানে চড়া যাবে না।চড়লে ভেঙে পড়বে। আবার তার সঙ্গে তার কিছু দোসররাও।তাদেরকে কি করা উচিত? পদ্মা সেতুতে নিয়ে যেয়ে,ওখান থেকে পদ্মা নদীতে টুস করে ফেলে দেয়া উচিত।”
ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং খালেদা জিয়াকে পদ্মা নদীতে ফেলার সুযোগ পেলেন না শেখ হাসিনা। তারা সেদিন পাশাপাশি বসে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করলেন। তখন দিল্লির কোথাও বসে শেখ হাসিনা হয়তো দেখছিলেন এই দৃশ্য। হায়! কোথা থেকে কি
হয়ে গেল!যদিও রাজনীতির পণ্ডিতরা তাকে বারবারই হুঁশিয়ার করছিলেন বহুদিন ধরেই। বলেছিলেন- সব দরজা-জানালা বন্ধ করতে নেই। সমঝোতার কিছু পথ খোলা রাখতে হয়। না হয় শেষ পর্যন্ত কোনো হিসাবই মেলে না। আওয়ামী লীগ নেতারাই এখন
বলছেন,বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন আয়োজন ভুল ছিল!কিন্তু শেখ হাসিনা যখন মসনদে ছিলেন তখন কেউ হয়তো তাকে সেটা বলার সাহস পাননি।অনুগত মিডিয়াও কেবল তোষামোদ করে গেছে।মনে করিয়ে দেয়নি রাজনীতিতে এক সময় থামতে হয়।
শেখ হাসিনা এখন মলিন বদনখানি নিয়ে নয়নজলে সেনাকুঞ্জের অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়ার হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখছেন। আরও দেখছেন,তাঁর এই হাস্যোজ্জ্বল পদার্পণে পুরো অনুষ্ঠানস্থল হয়ে ওঠেছিল অভাবনীয় প্রাণবন্ত ও বিপুল উৎসবমুখর। নতুন করে আবার মেলবন্ধন রচিত হয়েছে জনতা ও সৈনিকের মধ্যে।
সেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আনন্দ আপ্লুত অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বললেন,আজ আমরা বিশেষভাবে সৌভাগ্যবান এবং সম্মানিত যে, বাংলাদেশের তিন বারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এখানে আমাদের মাঝে উপস্থিত আছেন। সঙ্গে ছিলেন তার ছোট ছেলে মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি।খালেদা জিয়াকে অনুষ্ঠানে দেখে
কেঁদে ফেলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বৈষম্যবিরোধী রক্তাক্ত আন্দোলনের একটি অর্জনে মুক্ত খালেদা জিয়া। ড.ইউনূস-খালেদা জিয়ার আলোকিত ছবি দেখে যাদের মানসিক রোগ আরও কিছুটা বেড়েছে,তারেক জিয়ার ফেরার দিনের দৃশ্য দেখে তাদের অবস্থা কেমন হবে ? ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি মানুষের সমাবেশ হবে কি সেদিন ? তা দেখে পলাতক
হাসিনা ও তার সমর্থকদের মানসিক রোগ ঠিক কতটা বাড়বে? আশা করি বিএনপির নেতা-কর্মী-সমর্থকরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বের অবদান কখনও অস্বীকার করবেন না,ভুলেও যাবেন না।
লেখক: ব্যুরো প্রধান, বাংলাভিশন, চট্টগ্রাম
পূর্বকোণ/এএইচ