চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৪

শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তা ও করণীয়

রীপা পালিত ও মুহাম্মদ শাহ্ আলম

২১ অক্টোবর, ২০২৪ | ৮:০১ অপরাহ্ণ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে- স্বাস্থ্য মানে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাতিকভাবে সম্পূর্ণ ভালো থাকা, শুধু রোগ বা অসুখের অনুপস্থিতি নয়। তাই সুস্থতা বলতে শুধু শারীরিকভাবে সুস্থ থাকাই বোঝায় না, সুস্বাস্থ্যে মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাতিক দিকগুলোও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য শুধু ব্যক্তিগত বিষয়াবলি, যেমন তার চিন্তা-চেতনা, আবেগ-আচরণের ওপর নির্ভর করে না, এ ক্ষেত্রে পারিবারিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পারিবারিক-সামাজিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধ, জীবনযাত্রার মান, সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তা, সার্বিক সাংস্কৃতিক আবহ, বিনোদন, শিক্ষা ও কর্মপরিবেশ সব কিছুই ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য তথা সার্বিক স্বাস্থ্যের প্রভাবক।

ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ ((WFMH) -এর প্রাক্তন ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল রিচার্ড ডিক হান্টার কর্তৃক গৃহিত উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রতি বছর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালিত হয়ে আসছে। এ বছর এ দিবসটির মূল ভাবনা “It is Time to Prioritize Mental Health in the Workplace”- ‘কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য গুরুত্ব দেওয়ার এখনই সময়’। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটে উক্ত প্রতিপাদ্যটি যথার্থ এবং সময়োপযোগী।

মানুষের জীবনের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ কাটে তার কর্মক্ষেত্রে। বর্তমান সময়ে কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা, কাজের চাপ, সময়ের সংকট এবং ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখার চ্যালেঞ্জ কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে থাকে।

কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব
কর্মক্ষেত্রে মানসিক সুস্থতার অর্থ হলো কাজের চাপ সামলানো, সমস্যা সমাধান করার দক্ষতা এবং সহকর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। কর্মী যদি মানসিকভাবে সুস্থ থাকেন, তাহলে তাঁর কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং প্রতিষ্ঠান লাভবান হয়। অন্যদিকে মানসিক সুস্থতা বজায় রাখা না গেলে কর্মক্ষমতা, সৃজনশীলতা ও পেশাগত সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। মানসিক চাপ বা উদ্বেগ বেশি হলে ব্যক্তি কাজের প্রতি মনোযোগ হারায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কমে যায়, উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়। দীর্ঘমেয়াদি মানসিক অবসাদ বা অসুস্থতার ফলে ব্যক্তির কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতির হার বাড়তে থাকে, যা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর।

মানসিক সমস্যার কারণ যখন কর্মক্ষেত্র
মানসিক রোগের কারণ হিসেবে নির্দিষ্টভাবে কোনো বিষয়কে দায়ী করা যায় না। তবে অনেক বিষয় রয়েছে, ব্যক্তির জীবনে যেগুলোর উপস্থিতি রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। কর্মক্ষেত্রের নানা বিষয়ও মানসিক সমস্যা বা রোগের জন্য দায়ী বা ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় হিসেবে গণ্য হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে :

কাজের চাপ: একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অনেক কাজ শেষ করতে গিয়ে কর্মীরা মানসিক চাপ অনুভব করেন। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রত্যাশার অতিরিক্ত চাপ কর্মীদের মধ্যে মানসিক উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়। কাজের এই চাপ দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকলে এটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

কাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্যহীনতা: বর্তমান সময়ে কর্মজীবন ও ব্যক্তিজীবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত কঠিন। অনেক কর্মীকে বাড়ি থেকেও অফিসের কাজ করতে হয়। এর ফলে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা থেকে সৃষ্টি হতে পারে মানসিক সমস্যা।

কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ: কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে। সহকর্মীদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, অন্যকে নিচু দেখানোর বা অপমান করার প্রবণতা, দলাদলি, ভয়ভীতি প্রদর্শন, হুমকি, শত্রুতামূলক আচরণ, অপেশাদার আচরণ, ঊর্ধ্বতনদের অন্যায্য দাবি, কাজের যথাযথ স্বীকৃতি না পাওয়া, সব সময় চাকরি হারানোর আশঙ্কা ইত্যাদি কাজের পরিবেশ নষ্ট করার পাশাপাশি কর্মীদের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করে।

আমাদের সমাজে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে প্রায়ই কুসংস্কার এবং ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। ফলে মানসিক সমস্যা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক কর্মী মানসিক চাপ বা উদ্বেগের কারণে সমস্যায় ভুগলেও, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং কর্মক্ষেত্রের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে তারা প্রায়শই সাহায্য নিতে দ্বিধা করেন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্র: একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কতটা গুণগত মানের ও শিক্ষাবান্ধব; তা প্রধানত মূলায়িত হয়ে থাকে- সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কতটা মানসিক স্বাস্থ্যবান্ধব। অপরদিকে শিক্ষার্থীরা হলো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান উপজীব্য তথা স্টেকহোল্ডারস। শিক্ষা গ্রহণই হলো একজন শিক্ষার্থীর প্রধানতম কর্ম। তাইতো যে কোন পরিচয় দেওয়ার সময় চাকুরি কলামে আমরা উল্লেখ করি ছাত্র অথবা শিক্ষার্থী। অর্থ্যাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্র হিসেবে স্বীকৃত।
শিক্ষার্থীর উন্নয়ন শুধুমাত্র পড়াশোনার সাফল্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানসিক, শারীরিক এবং সামাজিক উন্নয়নও শিক্ষা জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বর্তমান সমাজে দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিবেশ, প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা, পারিবারিক এবং সামাজিক চাপ সবকিছু মিলে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।

শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার গুরুত্ব
শিক্ষার্থীর জীবনে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। মানসিকভাবে সুস্থ শিক্ষার্থী ভালোভাবে পড়াশোনা করতে সক্ষম হয়, সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে, এবং জীবনযাত্রার বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়। মানসিক অস্থিরতা বা মানসিক সমস্যার কারণে শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস কমে যেতে পারে, যা তাদের গুণগত মানের শিক্ষা অর্জনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা হতাশা দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষার্থীর একাডেমিক এবং ব্যক্তিগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যার প্রধান কারণগুলো হলো:
শিক্ষাগত চাপ: অতিরিক্ত পড়াশোনা এবং পরীক্ষা ভিত্তিক প্রতিযোগিতা শিক্ষার্থীদের মাঝে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে।
পারিবারিক চাপ: অনেক সময় পরিবার থেকে অত্যধিক প্রত্যাশা শিক্ষার্থীদের জন্য মানসিক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
-সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব: ডিজিটাল যুগে সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার অনেক শিক্ষার্থীকে মানসিকভাবে অস্থির করে তোলে। নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা করার মনোভাব এবং জনপ্রিয় হওয়ার চাপ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
-বুলিং, র‌্যাগিং এবং সহপাঠীদের দ্বারা মানসিক নির্যাতন: অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র‌্যাগিং এবং সহপাঠীদের কাছ থেকে বুলিং, বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়, যা তাদের মানসিক অবস্থা বিপন্ন করে তোলে। তাছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ধরণের সর্ম্পকজনিত চাপ।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা যেখানে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পারে। নিচে কিছু করণীয় পদক্ষেপ আলোচনা করা হলো:

১. মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা কর্মসূচি
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষার্থীরা প্রায়ই মানসিক চাপ, হতাশা বা উদ্বেগের মতো সমস্যাগুলিকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়, যা আসলে মানসিক সমস্যার একটি লক্ষণ হতে পারে। এই ধরনের সমস্যাগুলি নির্ণয়ের জন্য নিয়মিত মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কর্মশালা, আলোচনা এবং সেমিনারের আয়োজন করা উচিত। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবক এবং শিক্ষকদেরও এই বিষয়ে সচেতন করা প্রয়োজন, যাতে তারা শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যাগুলি দ্রæত সনাক্ত করতে পারে এবং তাদের সঠিকভাবে সমর্থন করতে পারে।

২. পরামর্শদাতা ও মনোবিজ্ঞানীর নিয়োগ
প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পেশাদার পরামর্শদাতা এবং মনোবিজ্ঞানীর নিয়োগ অত্যন্ত জরুরি। এই বিশেষজ্ঞরা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে কাজ করতে এবং তাদের মানসিক শক্তি বাড়াতে সাহায্য করতে পারেন। অনেক সময় শিক্ষার্থীরা তাদের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সমস্যাগুলোর কথা অন্যদের সাথে শেয়ার করতে দ্বিধাবোধ করে। এমন পরিস্থিতিতে একজন পরামর্শদাতা তাদের সাথে গোপনীয়ভাবে আলোচনা করতে পারেন এবং তাদের মানসিক সমাধানের পথ দেখাতে পারেন।

৩. বন্ধুত্বপূর্ণ ও সুরক্ষিত পরিবেশ সৃষ্টি
একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ও সুরক্ষিত পরিবেশ শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করার অন্যতম প্রধান উপায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন পরিবেশ থাকা উচিত যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের সমস্যাগুলি নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে পারে এবং সমাধান খুঁজে পেতে পারে। শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার্থীদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব প্রদর্শন করা, যাতে তারা নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারেন এবং মানসিক চাপমুক্ত থাকতে পারেন।

৪. সৃজনশীল ও শারীরিক কার্যক্রমের গুরুত্ব
মানসিক চাপ কমাতে শারীরিক ও সৃজনশীল কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাধুলা, শিল্পকলা, সংগীত, এবং নাটকের মতো সৃজনশীল কার্যক্রমের প্রতি গুরুত্ব দেওয় উচিত। গবেষণায় দেখা গেছে, শারীরিক কার্যকলাপ যেমন দৌঁড়ানো, সাঁতার কাটা বা খেলাধুলা মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে। একইভাবে, সৃজনশীল কার্যকলাপ যেমন শিল্পকর্ম, নাটক বা সংগীত শিক্ষার্থীদের মানসিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করে এবং তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।

৫. পরীক্ষার চাপ হ্রাসে ব্যবস্থা
বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরীক্ষার চাপ শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। শিক্ষার্থীদের উপর অযথা চাপ সৃষ্টি না করে তাদের ব্যক্তিগত দক্ষতা উন্নয়ন উৎসাহিত করা প্রয়োজন। পরীক্ষার ফলাফলই জীবনের চূড়ান্ত মাপকাঠি নয় এই বিষয়টি শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক উভয়কেই বুঝতে হবে। তাই, পরীক্ষার সময় শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ কমাতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

৬. মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা
প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের মানসিক সমস্যার কথা বলে সমাধান খুঁজে পেতে পারেন। এই কেন্দ্রগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য গাইডলাইন, পরামর্শ, এবং প্রয়োজনীয় মানসিক সহায়তা প্রদান করা দরকার। এছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যাতে শিক্ষার্থীরা সহজেই সহায়তা পেতে পারে।

শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এক্সপ্রেসিভ সাইকোথেরাপি ও থিয়েটার থেরাপির মতো সৃজনশীল ও স্বতস্ফূর্ত পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা
শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে এক্সেেপ্রসিভ সাইকোথেরাপি এবং থিয়েটার থেরাপির মতো সৃজনশীল ও স্বতঃস্ফূর্ত পদ্ধতিগুলির ব্যবহার দ্রæত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। প্রচলিত মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা পদ্ধতির পাশাপাশি এই ধরনের সৃজনশীল থেরাপিগুলো শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ, উদ্বেগ, হতাশা এবং অন্যান্য মানসিক সমস্যার মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

এক্সপ্রেসিভ সাইকোথেরাপির ভূমিকা
এক্সপ্রেসিভ সাইকোথেরাপি: একটি সৃজনশীল প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে ব্যক্তিরা নিজেদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে সক্ষম হয়। এটি সংগীত, চিত্রকলা, নৃত্য, সাহিত্য বা নাটকের মতো বিভিন্ন সৃজনশীল কার্যকলাপের মাধ্যমে মনের ভেতরের আবেগ এবং চিন্তাকে প্রকাশ করার সুযোগ দেয়। শিক্ষার্থীরা নিজেদের ভিতরের সংকট, ভয়, বা মানসিক দ্বন্দ্ব সম্পর্কে সরাসরি কথা বলতে না পারলেও সৃজনশীল অভিব্যক্তির মাধ্যমে এই সমস্ত বিষয়গুলো প্রকাশ করতে পারে।

এক্সপ্রেসিভ সাইকোথেরাপির উপকারিতা
১. আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি: সৃজনশীল পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজেদের চিন্তা এবং আবেগকে প্রকাশ করতে পারে, যা তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।
২. আবেগ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক: সৃজনশীল থেরাপি শিক্ষার্থীদের আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে সাহায্য করে। এতে তারা তাদের মনোবেদনা, রাগ, দুঃখ বা উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে।
৩. মানসিক চাপ হ্রাস: শারীরিক এবং সৃজনশীল কার্যকলাপ মানসিক চাপ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাচ্ছন্দ্য এনে দেয় এবং তাদের একাডেমিক ও সামাজিক জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এক্সপ্রেসিভ সাইকোথেরাপি ও থিয়েটার থেরাপির প্রয়োজনীয়তা:
আত্মপরিচয় বিকাশ: সৃজনশীল থেরাপি শিক্ষার্থীদের তাদের ব্যক্তিত্ব এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধের সাথে পরিচিত হতে সাহায্য করে। তারা নিজেদের সীমাবদ্ধতা এবং শক্তি সম্পর্কে সচেতন হয়।
ট্রমা নিরাময়: অনেক সময় শিক্ষার্থীরা পারিবারিক, সামাজিক বা একাডেমিক কারণে মানসিক আঘাত পায়। থিয়েটার থেরাপির মতো পদ্ধতিগুলো শিক্ষার্থীদের সেই মানসিক আঘাত থেকে মুক্তি দিতে সাহায্য করে। এটি তাদের ভেতরের কষ্টগুলোকে মঞ্চের মাধ্যমে বাইরে নিয়ে আসে, যা নিরাময়ের পথ তৈরি করে।
মানসিক স্থিতিশীলতা উন্নয়ন: এক্সপ্রেসিভ থেরাপিগুলো শিক্ষার্থীদের মানসিক স্থিতিশীলতা বাড়ায়। তারা নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রেখে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হতে শেখে, যা তাদের মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করে।

কয়েকটি সুপারিশ
 আবাসিক হলগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্যবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার কার্যকর উদ্যোগ নেয়া ও মেন্টাল হেলথ সুপারভাইজার নিয়োগ করা;
 অনুষদভিত্তিক ছাত্র পরামর্শক নিযুক্ত আছেন। একজন সম্মানিত অধ্যাপক অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এই পদায়নগুলো পূর্ণকালীন করে একজন সাইকোথেরাপিস্ট/ক্লিনিক্যাল সাইকোথেরাপিস্ট ও একজন এক্সপ্রেসিভ সাইকোথেরাপিস্ট নিয়োগ দেয়া হলে শিক্ষার্থীগণ সাবক্ষণিকভাবে পেশাদার কাউন্সিলিং সেবা পাবে।
 প্রাথমিকভাবে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে একটি এক্সপ্রেসিভ সাইকোথেরাপি সেন্টার স্থাপন করা, যাতে করে কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের গ্রæপভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা যায়।
 পর্যায়ক্রমে অনুষদভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা সেবা চালু করে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা সহজলভ্য করা।
 বিভাগভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়ত ও সেবা গ্রহণ বিষয়ক অরিয়েন্টেশন।
 মানসিক স্বাস্থ্য সেবায় প্রফেশনাল গড়ে তুলতে এক্সপ্রেসিভ সাইকোথরাপি বিষয়ক উচ্চতর ডিগ্রি চালু করা।

পরিশেষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মানসিকভাবে সুস্থ শিক্ষার্থী তার শিক্ষা জীবনে সাফল্য অর্জন করতে এবং সমাজের একজন সক্রিয় সদস্য হতে সক্ষম হয়। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকলে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষায় আরও মনোযোগী হতে পারে এবং নিজেদের সক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে পারে। এজন্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধি, মানসিক সহায়তার ব্যবস্থা এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মচারীদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যা কেবলমাত্র সম্ভব নূন্যতম একটি সুসংগঠিত মানসিক স্বাস্থ্য সহায়ক কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে।

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট